আর কত রক্ত ঝরলে ভাঙবে আমাদের ঘুম?


যখন একটি জাতি তার ভবিষ্যৎ নির্মাণ করতে চায়, তখন তার আয়না হয়ে দাঁড়ায় দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। এই বিদ্যাপীঠগুলো কেবল জ্ঞানার্জনের কেন্দ্র নয়, এগুলো একটি দেশের বিবেক, চেতনা এবং স্বপ্নের প্রতীক। কিন্তু আজ সেই আয়নায় আমরা কী দেখছি? আমরা দেখছি বিভীষিকা। দেখছি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের হাসপাতালে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে আমাদেরই সন্তানতুল্য তিন শিক্ষার্থী, যাদের মধ্যে একজনের জীবন-মৃত্যুর লড়াই চলছে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউতে)।

শুধু তিন জন নয়, প্রায় ১৮০ জন শিক্ষার্থীর আহত শরীর যেন পুরো বাংলাদেশকে রক্তাক্ত করছে। এই চিত্রটি বিচ্ছিন্ন কোনো দুর্ঘটনা নয়, এটি এক ভয়াল মহামারির লক্ষণ। শিক্ষার্থীদের ওপর পাশবিক হামলার পর অনির্দিষ্টকালের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেছে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্ত কার্যক্রম। জ্ঞানচর্চার বদলে সেখানে এখন বিরাজ করছে আতঙ্ক আর অনিশ্চয়তা। আগুনের লেলিহান শিখা কেবল দালানকোঠা নয়, পুড়িয়ে দিচ্ছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বহুদিনের ঐতিহ্য ও নিরাপত্তাকেও।

কয়েকদিন আগেই দেশের শ্রেষ্ঠ কারিগরি বিদ্যাপীঠ বুয়েটের ছাত্রদের রাজপথে যেভাবে পেটানো হলো, তা দেখে মনে হয়েছে রাষ্ট্রযন্ত্রের কাছে তার মেধাবী সন্তানদের চেয়েও বড় কোনো শত্রু আর নেই।

প্রশ্ন হলো, যারা দেশের ভবিষ্যৎ গড়বে, সেই সাধারণ ছাত্ররা হঠাৎ করে কেন ‘গণশত্রুতে’ পরিণত হলো? কেন রাষ্ট্রের যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দায়িত্ব তাদের রক্ষা করা, তারাই আজ খড়্গহস্ত? অথবা কেন কোনো এক বিক্ষুব্ধ জনতা আইন নিজের হাতে তুলে নিয়ে তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে? এই প্রশ্নগুলোর সরল কোনো উত্তর নেই। এর উত্তর খুঁজতে হলে আমাদের সমাজের গভীরে প্রবেশ করতে হবে।

আমাদের স্বীকার করতে হবে যে, এই সহিংসতা আকস্মিক কোনো বজ্রপাত নয়। এটি আমাদের সমাজে দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকা অসহিষ্ণুতা, বিচারহীনতার সংস্কৃতি এবং রাজনৈতিক বিভাজনের বিষবৃক্ষের এক ভয়াল ফল। ছাত্র রাজনীতির গৌরবোজ্জ্বল এক ইতিহাস রয়েছে আমাদের। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান এবং একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ—সর্বত্রই ছাত্রসমাজ ছিল অগ্রণী ভূমিকায়।

কিন্তু আজ সেই ছাত্ররাই যখন নিজেদের অধিকার বা দেশের কোনো সংকট নিয়ে কথা বলতে রাস্তায় নামছে, তখন তাদের কণ্ঠকে সম্মান জানানোর বদলে দমন করা হচ্ছে। এই মুহূর্তে সবচেয়ে জরুরি কাজ হলো, এই ক্রমবর্ধমান সহিংসতার লাগাম টেনে ধরা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, রাজনৈতিক নেতা এবং সাধারণ মানুষ—সবার কাছে আজ করজোড়ে মিনতি, এই উন্মত্ততা, এই হামলা, এই পারস্পরিক ঘৃণা ছড়ানো বন্ধ করুন। ভুলে গেলে চলবে না, মানুষ হয়ে মানুষের গায়ে হাত তোলা এক ভয়াবহ অপরাধ। ক্ষমতার দম্ভে, দলীয় পরিচয়ের অহংকারে আমরা যেন ভুলে না যাই যে, সব পরিচয়ের ঊর্ধ্বে আমাদের আসল পরিচয় আমরা মানুষ এবং আমাদের সবার রক্তের রং লাল।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, সকল রাজনৈতিক দল এবং দেশের প্রতিটি বিবেকবান নাগরিকের কাছে আজ একটাই জিজ্ঞাসা—আর কতদিন? আমাদের সমাজের নৈতিক অবক্ষয় ঠিক কতটা গভীরে পৌঁছালে আমরা উপলব্ধি করব যে, মব-সহিংসতার বিপরীতে শান্তি, ঘৃণার বদলে ভালোবাসা আর ক্ষমতার দম্ভের বদলে বিনয় প্রয়োজন? দুর্নীতির দানব যখন ক্যান্সারের মতো সমাজের প্রতিটি স্তরকে গিলে খাচ্ছে, তখন আমাদের কবে মনে হবে যে এর বিপরীতে শক্তিশালী নীতি ও নৈতিকতা প্রতিষ্ঠা করতে হবে? বিচারহীনতার সংস্কৃতি এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, অপরাধী জানে তার কোনো শাস্তি হবে না যদি তার রাজনৈতিক পরিচয় থাকে। এই সংস্কৃতিই নতুন অপরাধীদের জন্ম দিচ্ছে এবং ক্যাম্পাসগুলোকে পরিণত করছে ক্ষমতার মহড়ার ক্ষেত্রে।

স্বাধীনতার ৫৪ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। এই দীর্ঘ সময়ে আমাদের অর্থনৈতিক উন্নতি হয়েছে, বড় বড় অবকাঠামো নির্মিত হয়েছে। কিন্তু আমরা কি একটি মানবিক ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গড়তে পেরেছি? আজও আমরা আমাদের সন্তানদের মেধা ও যোগ্যতার সঠিক মূল্যায়ন করতে শিখলাম না। দলীয়করণ আর স্বজনপ্রীতির নিক্তিতে মাপা হয় প্রায় সবকিছু। যে কোনো পদের জন্য যোগ্যতার চেয়েও বড় হয়ে ওঠে রাজনৈতিক পরিচয়। প্রতিহিংসার রাজনীতির আগুনে প্রতিনিয়ত পুড়ছে আইনের শাসন। যে কেউ ভিন্নমত প্রকাশ করলেই তার কপালে জুটে যায় ‘দেশদ্রোহী’ বা অন্য কোনো অপমানজনক ‘ট্যাগ’, অথবা তার কণ্ঠকে চিরতরে স্তব্ধ করে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়।

এই সংকীর্ণ ব্যক্তি বা দলীয় আনুগত্যের ঊর্ধ্বে উঠে কবে আমরা দেশ ও দেশের মানুষকে ভালোবাসতে শিখব? কবে ‘আমি’র ক্ষুদ্র গণ্ডি থেকে বেরিয়ে এসে ‘আমরা’ হতে পারব? কবে আমাদের চেতনায় মহাকালের সেই শ্বাশত বাণী প্রতিষ্ঠিত হবে যে, ‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই’? কবে আমরা কেবল ইট-পাথরের উন্নয়নের বদলে একটি দায় ও দরদের সমাজ, একটি মানবিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করার জন্য ব্যাকুল হব?

এই দেশটা তো আমাদের সবার। এর স্বাধীনতার জন্য লক্ষ প্রাণ ঝরেছে, হাজারো মা-বোনের সম্ভ্রম বিলীন হয়েছে। সেই অকল্পনীয় ত্যাগের বিনিময়ে পাওয়া এই স্বদেশকে আর কত ক্ষতবিক্ষত হতে দেখলে আমাদের বোধোদয় হবে? আর কত প্রাণ গেলে, আর কত অশান্তির আগুন চারদিকে জ্বললে আমাদের ঘুম ভাঙবে? আমরা কি আমাদের পূর্বপুরুষদের রক্তের সঙ্গে বেইমানি করছি না?

আজ সময় এসেছে সব বিভেদ ভুলে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়ানোর। সময় এসেছে একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়ার এবং ভিন্নমতকে সম্মান জানানোর সংস্কৃতি পুনরায় ফিরিয়ে আনার। ক্যাম্পাসে ছাত্রদের রক্ত আর এক ফোঁটাও দেখতে চাই না। আমরা চাই নিরাপদ ক্যাম্পাস, যেখানে থাকবে মেধার অবাধ চর্চা, জ্ঞানের আলোয় আলোকিত এক নতুন প্রজন্ম। সেই সুন্দর, নিরাপদ ও মানবিক বাংলাদেশ গড়তে আর এক মুহূর্তও দেরি করার সুযোগ নেই।

নইলে ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে, একাত্তরের বিজয়ী এক জাতি তার স্বাধীনতার ৫৪ বছর পর নিজের সন্তানদের নিরাপত্তা দিতে এবং তাদের কথা শুনতে ব্যর্থ হয়েছিল। সেই লজ্জা ঢাকার জায়গা আমাদের থাকবে না। তাই আবারও সেই পুরনো কিন্তু সবচেয়ে জরুরি প্রশ্নটিই বিবেকের দরজায় কড়া নাড়ে—আর কবে? আমরা আর কতকাল অপেক্ষা করব এক নতুন ভোরের জন্য?

লেখক : ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, একুশে পত্রিকা।