যখন ‘লাইফলাইন’ হয়ে উঠে ‘ডেথলাইন’


দেশের অর্থনীতির লাইফলাইন বা জীবনরেখা হিসেবে পরিচিত ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক। এই পথ ধরে প্রতিদিন হাজার হাজার যানবাহন ছুটে চলে দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে, বহন করে উন্নয়ন আর অগ্রগতির বার্তা। কিন্তু এই উন্নয়নের পথের একটি অংশ যখন ধীরে ধীরে মৃত্যুর ফাঁদে পরিণত হয়, তখন শঙ্কা আর আতঙ্ক গ্রাস করে।

ঠিক এমনই এক ভয়ংকর বাস্তবতার নাম ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের মিরসরাই অংশ। ঝকঝকে প্রশস্ত এই সড়কটি যেন এক মৃত্যু উপত্যকা, যেখানে গত এক বছরে ৪৩টি তাজা প্রাণ ঝরে গেছে, আর পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন ১৩৪ জন। এই পরিসংখ্যান কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং আমাদের সম্মিলিত উদাসীনতা ও অব্যবস্থাপনার এক নির্মম দলিল।

প্রশ্ন হলো, কেন এই ২৮ কিলোমিটার মহাসড়ক এত ভয়ংকর হয়ে উঠল? তথ্য বলছে, এই পথের মূল দানব হয়ে উঠেছে ভারী যানবাহন, বিশেষ করে ট্রাক এবং লরি। গত এক বছরে ঘটা ৮২টি দুর্ঘটনার ৬৫ শতাংশের জন্যই দায়ী এসব যানবাহন। বেপরোয়া গতি, যান্ত্রিক ত্রুটি, অদক্ষ চালক আর যেখানে-সেখানে অবৈধ পার্কিং—এই চতুর্মুখী চক্রে পিষ্ট হচ্ছে সাধারণ মানুষের জীবন।

মনে হয়, মহাসড়কে চলার জন্য যেন কোনো নিয়ম নেই, আইন নেই। যার শক্তি বেশি, পুরো রাস্তাটাই যেন তার। ট্রাক-লরির চালকদের বেপরোয়া মনোভাবের কাছে অন্য যানবাহনগুলো অসহায়। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে ভাঙাচোরা রাস্তা আর গর্তের বিড়ম্বনা। ফলে একটি ছোট ভুল বা সামান্য অসতর্কতা মুহূর্তেই কেড়ে নিচ্ছে একেকটি জীবন। প্রাণহানির তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে থাকা মোটরসাইকেল দুর্ঘটনাগুলোও চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, এই সড়কে ছোট যানবাহনগুলোর জন্য সামান্যতম নিরাপত্তাও অবশিষ্ট নেই।

এই যে একের পর এক মৃত্যু, একে কি আমরা কেবলই ‘নিয়তি’ বা ‘দুর্ঘটনা’ বলে দায় সারব? নাকি এর গভীরে লুকিয়ে আছে আমাদের প্রশাসনিক দুর্বলতা, আইনের যথাযথ প্রয়োগে ঘাটতি এবং সামগ্রিক উদাসীনতা? হাইওয়ে পুলিশ বলছে, তারা নিয়মিত অভিযান চালায়, মামলা করে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, সেই মামলা কি এই মৃত্যুর মিছিল থামাতে পারছে? যদি পারত, তাহলে এক বছরে ৪৩টি লাশ আমাদের গুনতে হতো না।

বাস্তবতা হলো, চালকের চোখে ঘুম, বেপরোয়া গতি, মহাসড়কে তিন চাকার অবৈধ যান চলাচল—এসব বন্ধে যে কঠোর ও সমন্বিত পদক্ষেপ প্রয়োজন, তার ছিটেফোঁটাও দৃশ্যমান নয়। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যেন দুর্ঘটনার পর কারণ অনুসন্ধান আর মামলা দায়েরের বৃত্তেই আটকে আছে। প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের সদিচ্ছা বা সক্ষমতা, দুটোরই অভাব স্পষ্ট।

প্রতিটি দুর্ঘটনার পর আমরা পত্রিকার পাতায় বা টেলিভিশনের পর্দায় একটি হৃদয়বিদারক গল্প দেখি। কোনো পরিবার হয়তো হারিয়েছে তাদের একমাত্র উপার্জনক্ষম মানুষটিকে, কোনো শিশু হয়তো হয়েছে এতিম, কিংবা কোনো মা-বাবা হারিয়েছেন তাদের সম্ভাবনাময় সন্তানকে। এই মানবিক প্রতিবেদনগুলো আমাদের সাময়িকভাবে আবেগাপ্লুত করে, আমরা দুঃখ প্রকাশ করি।

কিন্তু এই আবেগ খুব বেশিদিন স্থায়ী হয় না। কয়েক দিন পরই আমরা ভুলে যাই সেই অসহায় পরিবারটির কথা। একমাত্র উপার্জনকারীকে হারিয়ে বাকিদের জীবন কীভাবে চলছে, কিংবা বাবা-মাকে হারিয়ে শিশুটির ভবিষ্যৎ কতটা অন্ধকারে, সেই খবর আর কেউ রাখে না। এই ভুলে যাওয়ার সংস্কৃতিই সম্ভবত আমাদের রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলোকে আরও বেশি উদাসীন করে তোলে। সড়কে মৃত্যুর এই পরিসংখ্যান তাদের কাছে শুধু একটি সংখ্যা হয়েই থেকে যায়, এর পেছনের রক্ত-মাংসের মানুষের কান্না তাদের স্পর্শ করে না।

এই হতাশাজনক পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসার পথ কি তবে বন্ধ? মোটেই না। প্রয়োজন শুধু সদিচ্ছা আর সমন্বিত পদক্ষেপের। এই মৃত্যুর মিছিল থামাতে হলে প্রথমেই নজর দিতে হবে ভারী যানবাহনগুলোর ওপর। ট্রাক-লরির চালকদের জন্য কঠোর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে, তাদের লাইসেন্স প্রদানে স্বচ্ছতা আনতে হবে এবং নিশ্চিত করতে হবে তাদের পর্যাপ্ত বিশ্রামের সুযোগ। মহাসড়কে অবৈধ পার্কিং পুরোপুরি বন্ধ করতে হবে এবং এর জন্য দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির বিধান করতে হবে। শুধু অভিযান আর নামমাত্র মামলা নয়, ট্রাফিক আইনের কঠোর প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।

পাশাপাশি, সড়কের নিয়মিত মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ জরুরি। সামান্য গর্ত বা ত্রুটিও যে বড় দুর্ঘটনার কারণ হতে পারে, তা কর্তৃপক্ষকে অনুধাবন করতে হবে। মহাসড়কে ধীরগতির যান, বিশেষ করে অটোরিকশা চলাচল সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করতে হবে। চালক, প্রশাসন, পুলিশ এবং সাধারণ মানুষ—সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা ছাড়া এই সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়।

আমরা উন্নয়নের মহাসড়ক চাই, মৃত্যুর ফাঁদ নয়। দেশের অর্থনৈতিক লাইফলাইন যেন মানুষের জীবনের বিনিময়ে তৈরি না হয়, তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব রাষ্ট্রকেই নিতে হবে। আর একটিও প্রাণ ঝরে যাওয়ার আগে আমাদের সম্মিলিত বিবেক জাগ্রত হোক।

লেখক : ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, একুশে পত্রিকা।