মাতারবাড়ী নিয়ে ‘সিঙ্গাপুরের স্বপ্ন’, বাস্তবে পায়রার ব্যর্থতার ভয়


কক্সবাজারের মহেশখালী-মাতারবাড়ীকে ঘিরে ৩০ বছর মেয়াদি একটি মহাপরিকল্পনা করতে যাচ্ছে সরকার, যার লক্ষ্য সিঙ্গাপুরের আদলে একটি উন্নত অর্থনৈতিক কেন্দ্র গড়ে তোলা। তবে প্রায় ৫৭ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত মাতারবাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্রের হতাশাজনক উৎপাদন, ব্যয়বহুল নৌ-চ্যানেল রক্ষণাবেক্ষণ এবং পায়রা বন্দরের ‘ব্যর্থতার’ অভিজ্ঞতা সামনে রেখে এই নতুন পরিকল্পনাটির বাস্তবায়ন নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞ ও অর্থনীতিবিদরা।

অন্তর্বর্তী সরকারের পরিকল্পনা অনুযায়ী, গভীর সমুদ্রবন্দর, বিদ্যুৎকেন্দ্র, এলএনজি টার্মিনাল ও অর্থনৈতিক অঞ্চল মিলিয়ে মহেশখালী-মাতারবাড়ী এলাকাটি দেশের একটি শক্তিশালী অর্থনৈতিক হাবে পরিণত হবে, যা জিডিপিতে ১৫০ বিলিয়ন ডলার যোগ করবে।

তবে এই উচ্চাকাঙ্ক্ষী পরিকল্পনার পেছনে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা হচ্ছে পটুয়াখালীর পায়রা বন্দরের অভিজ্ঞতাকে। সেখানে রাবনাবাদ চ্যানেলের নাব্য সংকটের কারণে বড় জাহাজ ভিড়তে না পারায় কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র ও বন্দরকেন্দ্রিক লজিস্টিক হাব গড়ে তোলার পরিকল্পনা সফল হয়নি, যা এখন দেশের অর্থনীতির জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে মনে করেন অনেক অর্থনীতিবিদ।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মাতারবাড়ীর সম্ভাবনা থাকলেও পায়রার মতো ভুল পরিকল্পনা ও দুর্বল সংযোগ ব্যবস্থার কারণে এটিও ব্যর্থ প্রকল্পে পরিণত হতে পারে।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. সামছুল হক বলেন, “শুধু বড় বড় স্থাপনা নির্মাণ করলেই কোনো জায়গা সিঙ্গাপুরের মতো হয় না। সিঙ্গাপুরের আসল বৈশিষ্ট্য হলো তার চৌকস ও দুর্নীতিহীন শাসন ব্যবস্থা। আমাদের শাসন ব্যবস্থায় উন্নতি না হলে শুধু দালানকোঠা বানিয়ে কোনো উন্নয়নই টেকসই হবে না।”

একইভাবে প্রকল্পে অনিয়ম-দুর্নীতির আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন পানিসম্পদ ও বন্দর বিশেষজ্ঞ ড. আইনুন নিশাত। তিনি বলেন, “অতীতে আমরা দেখেছি এ ধরনের প্রকল্প বাস্তবায়নে অনিয়ম-দুর্নীতি হয়েছে। এ প্রকল্পে যে এমন কিছু হবে না, তা আমরা নিশ্চিত নই।”

ব্যবসায়ীরা বলছেন, চট্টগ্রাম বন্দরের সঙ্গে ঢাকার মতো অর্থনৈতিক কেন্দ্রগুলোর দুর্বল সংযোগ দেশের আমদানি-রপ্তানিতে বড় বাধা। মাতারবাড়ী বন্দরের সঙ্গে উন্নত যোগাযোগ করিডোর তৈরি করতে না পারলে এর সুফল পাওয়া যাবে না। বিকেএমইএ সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, “যত ভালো বন্দরই আমরা বানাই না কেন, দেশের অর্থনীতির কেন্দ্রগুলোর সঙ্গে সংযোগ না থাকলে সেটার সুফল পাওয়া যাবে না।”

এরই মধ্যে মাতারবাড়ীর চালু হওয়া প্রকল্পগুলো নানা সমস্যার সম্মুখীন। ৫৭ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্রটি গত ৭ সেপ্টেম্বর মাত্র ২৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ করেছে, যা তার সক্ষমতার মাত্র ২১ শতাংশ। কেন্দ্রটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক রক্ষণাবেক্ষণের কারণে উৎপাদন কম হওয়ার কথা জানালেও বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) সঙ্গে চুক্তি না হওয়ায় কেন্দ্রটি কোনো বিল পাচ্ছে না বলে জানিয়েছেন।

অন্যদিকে, প্রকল্পের আওতায় নির্মিত ১৪ দশমিক ৩ কিলোমিটার দীর্ঘ নৌ-চ্যানেলটি রক্ষণাবেক্ষণে প্রতি বছর প্রায় ৩০৪ কোটি টাকা ড্রেজিং ব্যয় হবে বলে জাইকার এক সমীক্ষায় বলা হয়েছে।

পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের সিইও মাশরুর রিয়াজ নগর উন্নয়নের চেয়ে প্রকল্পটির অবকাঠামোগত মূল্যের ওপর জোর দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। তিনি বলেন, “এটার ভ্যালু হচ্ছে বন্দর, এনার্জি হাব। এগুলোকে নিয়ে একটি সাউথ এশিয়ান সরবরাহ চেইন করিডোর তৈরি করা সম্ভব এবং সেদিকেই আমাদের মনোযোগ দেওয়া উচিত।”

এসব সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও পরিকল্পনাটি নিয়ে আশাবাদী সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন। তিনি বলেন, “আমরা এটাতে আশান্বিত হতে চাই। অতীতে রাজনৈতিক সরকারের মতো অনেক উৎসব-আয়োজন করেও যেন এর ফলাফল শূন্য না হয়। কাজের অগ্রগতি দেখেই বোঝা যাবে ফলাফল কেমন হবে।”