
দেশে কর্মসংস্থানের বাজারে এক উদ্বেগজনক চিত্র ফুটে উঠেছে। এক বছরের ব্যবধানে দেশে বেকারের সংখ্যা যেমন বেড়েছে, তেমনি আশঙ্কাজনকভাবে সংকুচিত হয়েছে মোট কর্মে নিয়োজিত জনগোষ্ঠী। সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হলো, উচ্চশিক্ষিতদের মধ্যেই বেকারত্বের হার সর্বোচ্চ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) কর্তৃক প্রকাশিত “শ্রমশক্তি জরিপ ২০২৪”-এর চূড়ান্ত প্রতিবেদন এই সংকটময় পরিস্থিতিকে সামনে এনেছে।
প্রতিবেদন অনুসারে, ২০২৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশে মোট বেকারের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২৬ লাখ ২০ হাজারে, যা ২০২৩ সালে ছিল ২৪ লাখ ৬০ হাজার। অর্থাৎ, মাত্র এক বছরের ব্যবধানে দেশে বেকার বেড়েছে এক লাখ ৬০ হাজার মানুষ। সার্বিকভাবে বেকারত্বের হার ৩ দশমিক ৩৫ শতাংশ থেকে বেড়ে ৩ দশমিক ৬৫ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।
জরিপের সবচেয়ে উদ্বেগজনক তথ্য হলো, শিক্ষাগত যোগ্যতা যত বেশি, বেকারত্বের হারও তত বেশি। দেশে মোট বেকারের মধ্যে সর্বোচ্চ ১৩ দশমিক ৫৪ শতাংশই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক বা স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী। এর বিপরীতে, উচ্চ মাধ্যমিক সম্পন্ন করা জনগোষ্ঠীর মধ্যে বেকারত্বের হার ৭ দশমিক ১৩ শতাংশ এবং মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরোনোদের মধ্যে এই হার মাত্র ১ দশমিক ৯৬ শতাংশ। সবচেয়ে কম বেকারত্বের হার আনুষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকা ব্যক্তিদের মধ্যে, যা মাত্র ১ দশমিক ২৫ শতাংশ। এই পরিসংখ্যান দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা ও শ্রমবাজারের মধ্যেকার ক্রমবর্ধমান ব্যবধানকে স্পষ্ট করে তুলেছে।
লিঙ্গভিত্তিক বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত এক বছরে দেশে পুরুষ বেকারের সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। ২০২৪ সাল শেষে পুরুষ বেকারের সংখ্যা ১৮ লাখে দাঁড়িয়েছে, যা এক বছর আগে ছিল ১৬ লাখ ৪০ হাজার। অন্যদিকে, নারী বেকারের সংখ্যা আট লাখ ২০ হাজারে অপরিবর্তিত রয়েছে।
ভৌগোলিকভাবে, দেশের সবচেয়ে বেশি বেকার মানুষের বাস রাজধানী ঢাকা বিভাগে, যেখানে ছয় লাখ ৮৭ হাজার মানুষ কর্মহীন। এর পরেই রয়েছে চট্টগ্রাম ও রাজশাহী বিভাগ, যেখানে বেকারের সংখ্যা যথাক্রমে পাঁচ লাখ ৮৪ হাজার এবং তিন লাখ ৫৭ হাজার।
বেকারত্ব বাড়ার পাশাপাশি দেশের শ্রমবাজারের জন্য আরও বড় দুঃসংবাদ হলো কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর সংকোচন। বিবিএসের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে দেশের শ্রমশক্তিতে অংশগ্রহণকারী মানুষের হার কমে ৫৮ দশমিক ৯০ শতাংশে দাঁড়িয়েছে, যা ২০২৩ সালে ছিল ৬০ দশমিক ৯০ শতাংশ। এই সময়ে কৃষি, শিল্প এবং সেবা—সব খাতেই কর্মে নিয়োজিত মানুষের সংখ্যা কমেছে।
সব মিলিয়ে দেশের মোট কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা এক বছরে ১৭ লাখ ২০ হাজার জন কমে সাত কোটি ১৭ লাখ ৩০ হাজারে নেমে এসেছে। একই সময়ে, শ্রমশক্তির বাইরে থাকা মানুষের সংখ্যা ৪ কোটি ৭১ লাখ থেকে বেড়ে ৫ কোটি ৫০ হাজারে দাঁড়িয়েছে, যা প্রমাণ করে বিপুল সংখ্যক মানুষ কাজের সন্ধান করা থেকেও বিরত থাকছেন।
বিবিএসের এই প্রতিবেদনটি দেশের অর্থনীতির জন্য একটি সতর্কবার্তা। একদিকে যেমন নতুন কর্মসংস্থান তৈরি হচ্ছে না, অন্যদিকে কর্মক্ষম মানুষ শ্রমবাজার থেকে ছিটকে পড়ছে, যা একটি দীর্ঘমেয়াদী সংকটের ইঙ্গিত বহন করছে।
