
নাগরিক কোলাহল আর যান্ত্রিক জীবনের ক্লান্তি ছেড়ে মন যখন একটুখানি প্রকৃতির স্নিগ্ধ ছোঁয়া চায়, তখন খাগড়াছড়ির দীঘিনালার তৈদুছড়া ঝর্ণা হতে পারে এক আদর্শ গন্তব্য। পাহাড়ের বুক চিরে অবিরাম ধারায় ঝরে পড়া জলের কলকল সুর আর চারপাশের সবুজ নিসর্গ এখানে প্রকৃতিকে এক জীবন্ত ক্যানভাসে রূপ দিয়েছে, যা ভ্রমণপিপাসু যেকোনো মানুষকে সৌন্দর্যের মোহে ডুবিয়ে দিতে পারে।
“তৈদুছড়া” শব্দটি ত্রিপুরা বা চাকমা ভাষা থেকে এসেছে। এর আঞ্চলিক অর্থ বেশ সহজ—‘তৈ’ মানে পানি আর ‘ছড়া’ মানে ঝিরি বা ছোট নদী। নামের মতোই এটি প্রকৃতির এক অনন্য সৃষ্টি, যেখানে পানি আর পাহাড় মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। খাগড়াছড়ির দীঘিনালা উপজেলা সদর থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরে, মেরুং ইউনিয়নের দুর্গম সীমানাপাড়ায় এই মায়াবী ঝর্ণার অবস্থান।
তৈদুছড়ার পথে যাত্রা করাটাও যেন এক ভিন্ন রকম অ্যাডভেঞ্চার। দীঘিনালা-খাগড়াছড়ি মূল সড়ক থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার ভেতরে এর পথ। সীমানাপাড়া পর্যন্ত প্রায় ৭ কিলোমিটার রাস্তা গাড়ি বা মোটরসাইকেলে যাওয়া গেলেও বাকি পথটুকু হেঁটে পাড়ি দিতে হয়। এই হাঁটা পথেই মূলত প্রকৃতির আসল রূপ উন্মোচিত হয়। উঁচু-নিচু খাড়া পাহাড়ের গা বেয়ে চলার সময় চোখে পড়ে সবুজে ঘেরা জুম চাষের ক্ষেত, ছোট ছোট জুম ঘর আর বাতাসে দোল খাওয়া সোনালি ধানের শিষ। মনে হয় যেন, প্রকৃতি নিজ হাতে পরম যত্নে পুরো এলাকাটি সাজিয়ে রেখেছে।

ঝর্ণার কাছাকাছি পৌঁছানোর পথটি কিছুটা চ্যালেঞ্জিং। খাড়া পাহাড় আর পিচ্ছিল পাথুরে ঝিরিপথ মনে কিছুটা ভয়ের সঞ্চার করলেও সেই রোমাঞ্চই ভ্রমণকে দ্বিগুণ আনন্দময় করে তোলে। দীর্ঘ পথ পাড়ি দেওয়ার পর যখন তৈদুছড়া ঝর্ণার প্রথম দেখা মেলে, তখন পথের সব ক্লান্তি এক নিমিষেই উবে যায়। চারদিকে বিশাল সব পাথর, জলের টলমলে শব্দ আর শীতল স্পর্শ এক প্রশান্তির চাদরে ঢেকে দেয়।
ঝর্ণাটি দেখতে অনবদ্য। প্রায় ৬০ ফুট উঁচু থেকে ধাপে ধাপে গড়িয়ে পড়ছে স্বচ্ছ পানির ধারা। দেখে মনে হয়, যেন কোনো নিপুণ শিল্পী পাহাড়ের গা খোদাই করে একটি বিশাল সিঁড়ি তৈরি করেছেন আর সেই সিঁড়ি বেয়েই নেমে আসছে জলরাশি। দর্শনার্থীরা সেই সিঁড়িতে গা ভিজিয়ে, শীতল পাথরকে আলিঙ্গন করে পথের ক্লান্তি দূর করেন।
সম্প্রতি ঝর্ণাটি ঘুরে আসা দীঘিনালা প্রেসক্লাবের সদস্য হাসান মোর্শেদ রিফাত তার মুগ্ধতা প্রকাশ করে বলেন, “এত সুন্দর আর অপরূপ ঝর্ণা দেখে আমি অভিভূত। সিঁড়ি দিয়ে গড়িয়ে পড়া পানিতে গা ভেজানোর পর দীর্ঘ পথ হেঁটে আসার সব কষ্ট নিমিষেই দূর হয়ে গেছে।”
দীঘিনালার ছোট-বড় অনেক ঝর্ণার মধ্যে তৈদুছড়া তার স্বকীয় সৌন্দর্যে উজ্জ্বল। এ বিষয়ে দীঘিনালা উপজেলা নির্বাহী অফিসার মুহাম্মাদ ইনামুল হাছান বলেন, “প্রকৃতির মাঝে এমন অপরূপ সৌন্দর্যের ঝর্ণা দেখে আমি মুগ্ধ। এখানকার পানি গড়িয়ে পড়ার দৃশ্য এবং বিশাল পাথরগুলো অন্য ঝর্ণা থেকে এটিকে সৌন্দর্যের আলাদা মাত্রা দিয়েছে। পর্যটনবান্ধব করা গেলে এটি ভ্রমণপিপাসুদের জন্য এক আকর্ষণীয় গন্তব্য হয়ে উঠবে।”
