
আজ ২৮ সেপ্টেম্বর, আন্তর্জাতিক তথ্য অধিকার দিবস। বিশ্বজুড়ে যখন তথ্যের অবাধ প্রবাহ, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার সংকল্প পুনর্ব্যক্ত করা হচ্ছে, তখন বাংলাদেশে আমরা এক গভীর পরিহাসের মুখোমুখি। যে প্রতিষ্ঠানটি—তথ্য কমিশন—নাগরিকের তথ্য প্রাপ্তির সাংবিধানিক অধিকারের রক্ষাকবচ, সেটি নিজেই আজ অস্তিত্বের সংকটে।
এক বছরেরও বেশি সময় ধরে শীর্ষ নেতৃত্বশূন্য অবস্থায় পড়ে থেকে প্রতিষ্ঠানটি কার্যত একটি নিথর দেহে পরিণত হয়েছে। এমন এক পরিস্থিতিতে এই দিবস পালন করা কেবল আনুষ্ঠানিকতা নয়, বরং এটি আমাদের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার এক করুণ ব্যর্থতাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য—‘পরিবেশ রক্ষায় ডিজিটাল যুগে তথ্যের অধিকার নিশ্চিতকরণ’—যেখানে পরিবেশগত তথ্যের স্বচ্ছতা এবং ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে সঠিক তথ্যের সুরক্ষা জরুরি, সেখানে আমাদের মূল সুরক্ষাকারী প্রতিষ্ঠানটির এই পঙ্গুত্ব অত্যন্ত হতাশাজনক।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর এক বছরের বেশি সময় কেটে গেলেও তথ্য কমিশন পুনর্গঠনে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ দেখা যায়নি। গত বছরের সেপ্টেম্বরে প্রধান তথ্য কমিশনার ও এক জন কমিশনারের পদত্যাগ এবং চলতি বছরের জানুয়ারিতে আরেক কমিশনারের অপসারণের পর থেকে কমিশন অভিভাবকহীন। সর্বশেষ সেপ্টেম্বরে সচিবের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল হওয়ায় প্রতিষ্ঠানটির শীর্ষস্তর পুরোপুরি শূন্য হয়ে পড়েছে।
এর পরিণতি ভয়াবহ। কমিশনের দৈনন্দিন কার্যক্রম পুরোপুরি স্থবির। সূত্রমতে, দায়ের হওয়া হাজারো অভিযোগ নিষ্পত্তির অপেক্ষায় পড়ে থাকছে, কোনো অভিযোগের শুনানি হচ্ছে না। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কাজ কেবল অফিসে আসা-যাওয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। আর্থিক ক্ষমতা না থাকায় কমিশনের স্বাভাবিক কার্যক্রম চালানোও অসম্ভব হয়ে পড়েছে; অবস্থা এতটাই করুণ যে, কর্মকর্তারা চাঁদা তুলে দাপ্তরিক গাড়ি ব্যবহার করতে বাধ্য হচ্ছেন। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) যথার্থই এই পরিস্থিতিকে রাষ্ট্রীয় দায়িত্বের প্রতি সরকারের ‘অগ্রহণযোগ্য অবহেলা’ এবং একটি ‘বিব্রতকর রেকর্ড’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছে। যখন নাগরিকরা তথ্য চেয়ে পাচ্ছেন না এবং প্রতিকারের জন্য যাওয়ার কোনো জায়গা নেই, তখন তা রাষ্ট্রীয় জবাবদিহিতার মৃত্যুকে নির্দেশ করে।
আমরা জানি, গণমাধ্যম ও নাগরিক সমাজের দীর্ঘদিনের আন্দোলনের ফসল হিসেবে ২০০৯ সালে তথ্য অধিকার আইনটি প্রণীত হয়। আন্তর্জাতিকভাবে এটি বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী আইন হিসেবে স্বীকৃতিও পেয়েছে। কানাডাভিত্তিক ‘সেন্টার ফর ল অ্যান্ড ডেমোক্রেসি’র মূল্যায়নে এটি বিশ্বের শীর্ষ ২০টি আইনের মধ্যে স্থান করে নিয়েছে। কিন্তু আইনের শক্তি কেবল কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ থেকেছে। গত ১৫ বছরে নাগরিকরা এর সুফল থেকে বহুলাংশে বঞ্চিত হয়েছে।
এর মূল কারণ, তথ্য গোপন রাখার প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কৃতি এবং দলীয় অনুগত ব্যক্তিদের কমিশনে নিয়োগ দিয়ে প্রতিষ্ঠানটিকে একটি দন্তহীন বাঘে পরিণত করার প্রবণতা। অতীতে দেখা গেছে, কমিশনের সদস্যরা নাগরিকের অধিকার প্রতিষ্ঠার চেয়ে ক্ষমতাসীনদের সন্তুষ্ট রাখতেই বেশি আগ্রহী ছিলেন। ফলে, টিআইবির গবেষণায় যখন উঠে আসে যে দেশের ৭৫ শতাংশ মানুষ এই আইন সম্পর্কেই অবগত নয়, তখন অবাক হওয়ার কিছু থাকে না। একটি শক্তিশালী আইন থাকা সত্ত্বেও প্রাতিষ্ঠানিক সদিচ্ছার অভাবে তা জনগণের কাছে পৌঁছাতে পারেনি।
আমরা এমন এক সময়ে বাস করছি, যখন তথ্যের অধিকারের ধারণাটি আরও জটিল ও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লব এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যুগে ভুল, বিকৃত ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত তথ্যের—অর্থাৎ ‘ইনফোডেমিক’—এর শিকার হওয়া আগের চেয়ে অনেক সহজ। ফ্যাক্ট-চেকিং সংস্থা রিউমার স্ক্যানারের তথ্যমতে, চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে ভুল তথ্য শনাক্তের হার গত বছরের তুলনায় ৩০ শতাংশ বেড়েছে, যার মধ্যে রাজনীতির অংশই সর্বাধিক। ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে যখন এত সহজে মিথ্যাচার ছড়ানো সম্ভব, তখন সরকারি ও প্রাতিষ্ঠানিক সঠিক তথ্যের অবাধ প্রবাহ নিশ্চিত করা আরও বেশি জরুরি। একজন নাগরিকের অধিকার রয়েছে কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে সঠিক তথ্য জেনে গুজবের প্রতিরোধ করার। কিন্তু তথ্যের অধিকার নিশ্চিত করার প্রতিষ্ঠানটিই যখন অকার্যকর থাকে, তখন ডিজিটাল যুগের এই নতুন যুদ্ধে আমরা নিরস্ত্র সৈনিকের মতো অসহায় হয়ে পড়ি।
তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় জুলাই মাসে তথ্য কমিশন গঠনের উদ্যোগের কথা জানিয়েছিল, কিন্তু দুই মাস পেরিয়ে গেলেও সেই উদ্যোগের বাস্তবায়ন দেখা যায়নি। এখন কেবল শূন্য পদে নিয়োগ দেওয়াই যথেষ্ট নয়। পুরোনো বৃত্তে ফিরে গিয়ে যদি আবারও দলীয় আনুগত্যের ভিত্তিতে কমিশনার নিয়োগ দেওয়া হয়, তবে তা হবে অর্থহীন। আমাদের প্রয়োজন সত্যিকারের সংস্কার।
টিআইবি প্রদত্ত সুপারিশগুলো এক্ষেত্রে প্রণিধানযোগ্য। প্রথমত, অবিলম্বে যোগ্য, সৎ এবং স্বার্থের দ্বন্দ্বমুক্ত ব্যক্তিদের নিয়োগ দিয়ে কমিশনের অচলাবস্থা দূর করতে হবে। দ্বিতীয়ত, অংশীজনদের মতামতের ভিত্তিতে তথ্য অধিকার আইনটিকে যুগোপযোগী করতে হবে। রাজনৈতিক দল ও ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানকে এই আইনের আওতায় আনা এখন সময়ের দাবি। সর্বোপরি, তথ্য কমিশনকে একটি সত্যিকারের স্বাধীন ও শক্তিশালী প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে হবে, যা সরকারের আজ্ঞাবহ না হয়ে জনগণের অধিকার রক্ষায় কাজ করবে। তা না হলে, আন্তর্জাতিক তথ্য অধিকার দিবস প্রতি বছর আসবে এবং যাবে, কিন্তু নাগরিকের তথ্য পাওয়ার অধিকার একটি অধরা স্বপ্নই থেকে যাবে।
লেখক: ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, একুশে পত্রিকা।
