চট্টগ্রামের নৈরাজ্য: এই অন্ধকারের দায় কার?


চট্টগ্রাম কি ক্রমশ এক অনিরাপদ জনপদে পরিণত হচ্ছে? গত কয়েক দিনের বিচ্ছিন্ন কিন্তু ভয়াবহ তিনটি ঘটনা অন্তত সেই অশুভ ইঙ্গিতই বহন করে। দিনের আলোয় প্রকাশ্য সড়কে ব্যবসায়ীকে গুলি করে হত্যা, পুলিশের কাছ থেকে আসামি ছিনিয়ে নেওয়ার মতো ঔদ্ধত্য, এবং সত্য তুলে আনতে গিয়ে সাংবাদিকদের ওপর নৃশংস হামলা—এই তিনটি ঘটনাই একটি সম্মিলিত চিত্র তৈরি করে, যা চট্টগ্রামের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির কঙ্কালসার চেহারাটাকে সামনে নিয়ে আসে। প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, এই চরম অবনতির দায় কার? কেন এবং কাদের প্রশ্রয়ে অপরাধীরা এতটা বেপরোয়া হয়ে ওঠার সাহস পাচ্ছে?

ঘটনাগুলোর দিকে তাকালে আঁতকে উঠতে হয়। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় হাটহাজারীর মদুনাঘাটে প্রাইভেট কারে থাকা ব্যবসায়ী মুহাম্মদ আবদুল হাকিমকে মোটরসাইকেল আরোহী সন্ত্রাসীরা গুলি করে হত্যা করেছে। নিহত আবদুল হাকিম রাউজানের বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন এবং বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরীর অনুসারী হিসেবে পরিচিত।

এটি নিছক কোনো বিচ্ছিন্ন হত্যাকাণ্ড নয়। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে রাউজানের রাজনৈতিক সহিংসতার দীর্ঘ ইতিহাস। ২০২৪ সালের আগস্ট-পরবর্তী সময়ে রাউজানে যে ১৩টি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে, তার ১০টিই রাজনৈতিক। এই পরিসংখ্যানই বলে দেয়, রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীরা কতটা সক্রিয়।

আবদুল হাকিমের হত্যাকাণ্ড প্রমাণ করে, দুর্বৃত্তদের নেটওয়ার্ক এতটাই শক্তিশালী যে তারা দিনের আলোয় চলন্ত গাড়িকে নিশানা করে হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে পালিয়ে যেতে পারে। এটি কেবল একজন ব্যক্তির মৃত্যু নয়, এটি রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার প্রতি অপরাধীদের একটি খোলা চ্যালেঞ্জ।

একই দিনে যখন শহরের এক প্রান্তে এমন হত্যাকাণ্ড ঘটছে, তখন অন্য প্রান্তে, পতেঙ্গার কাঠগড় এলাকায়, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার অসহায়ত্বের এক নগ্ন প্রদর্শনী হলো। অবৈধ ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা আটকের পর ট্রাফিক কনস্টেবল নজরুল ইসলাম যখন সেটি নিয়ে আসছিলেন, তখন ৫০-৬০ জনের একটি ‘মব’ বা উচ্ছৃঙ্খল জনতা তাকে আহত করে গাড়িটি ছিনিয়ে নিয়ে যায়। দুঃখজনকভাবে, পাশে অন্য পুলিশ সদস্যরা উপস্থিত থাকলেও তারা ছিলেন অসহায় দর্শক।

এই ঘটনাটি কোনো সাধারণ অপরাধ নয়। এটি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার প্রতীক পুলিশের ওপর সরাসরি আঘাত। যখন সাধারণ মানুষ আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকেই প্রকাশ্যে লাঞ্ছিত করে এবং নিজেদের হাতে আইন তুলে নেয়, তখন বুঝতে হবে সমাজের গভীরে আইনের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভয় দুটোই তলানিতে ঠেকেছে।

নগর পুলিশের উপকমিশনার (ট্রাফিক বন্দর) কবীর আহমেদ এবং নগর ট্রাফিক পুলিশ পরিদর্শক (পতেঙ্গা) সেলিম খানের বক্তব্যে গাড়িটি উদ্ধারে অভিযান এবং মামলার প্রস্তুতির কথা বলা হলেও, যে ক্ষতি হওয়ার তা হয়ে গেছে। এই ঘটনায় অপরাধীরা একটি বার্তা পেয়েছে—একজোট হলে আইনকে বুড়ো আঙুল দেখানো সম্ভব।

এর মাত্র দুই দিন আগে, রোববার, সীতাকুণ্ডের জঙ্গল সলিমপুরে তথাকথিত ‘অভিশপ্ত ভূমিতে’ সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে দুর্বৃত্তদের পাশবিক হামলার শিকার হন এখন টিভির চট্টগ্রাম ব্যুরোর প্রধান হোসাইন জিয়াদ ও ক্যামেরাপারসন মো. পারভেজ। তাদের ওপর হামলা চালিয়ে মাথা ফাটিয়ে দেওয়া, ক্যামেরা ভাঙচুর এবং সর্বস্ব লুটে নেওয়ার ঘটনা প্রমাণ করে, অপরাধের অভয়ারণ্য হিসেবে পরিচিত এলাকাগুলোতে অপরাধীরা কতটা সংঘবদ্ধ এবং হিংস্র।

জঙ্গল সলিমপুরের দখল-বেদখল এবং অপরাধ জগতের খবর যারা প্রকাশ করতে চায়, তাদের কণ্ঠ রোধ করার জন্যই এই হামলা চালানো হয়েছে। যখন গণমাধ্যমকর্মীরাই অনিরাপদ, তখন সাধারণ মানুষের নিরাপত্তার প্রশ্নটি বাতুলতা মাত্র। এই হামলা সংবাদপত্রের স্বাধীনতার ওপর তো বটেই, একইসঙ্গে এটি একটি বার্তা যে, নির্দিষ্ট কিছু এলাকায় রাষ্ট্রের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই।

এই তিনটি বিচ্ছিন্ন ঘটনাকে এক সুতোয় গাঁথলে যে ছবিটি ফুটে ওঠে তা হলো—চট্টগ্রামে রাজনৈতিক আশ্রয়পুষ্ট সন্ত্রাসী, সংঘবদ্ধ অপরাধী চক্র এবং আইন হাতে তুলে নেওয়া সাধারণ মানুষের এক ভয়ঙ্কর সহাবস্থান তৈরি হয়েছে।

প্রশ্ন হলো, কেন এমন পরিস্থিতি তৈরি হলো? এর মূল কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো বিচারহীনতার সংস্কৃতি। অতীতের হত্যাকাণ্ড, সন্ত্রাস বা হামলার ঘটনাগুলোর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়ায় অপরাধীরা নতুন করে অপরাধ করতে দ্বিধা করে না। রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের স্বার্থে সন্ত্রাসীদের লালন-পালন করে, যা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাজকে কঠিন করে তোলে। বাহিনীর সদস্যদের মধ্যেও অনেক সময় রাজনৈতিক চাপ অথবা দুর্নীতির কারণে নিষ্ক্রিয়তা দেখা যায়।

ফলে অপরাধ দমন না হয়ে বরং অপরাধীরাই প্রশ্রয় পায়। আবদুল হাকিমের ক্ষেত্রে তার বালু উত্তোলনের ব্যবসার দিকটিও ফেলে দেওয়ার মতো নয়। চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীসহ বিভিন্ন এলাকায় অবৈধ বালু উত্তোলনকে কেন্দ্র করে প্রভাবশালী চক্রের বিবাদ এবং সহিংসতা এক নিয়মিত ঘটনা।

এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের পথ কী? প্রথম এবং প্রধান শর্ত হলো সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে সদিচ্ছা। সরকারকে অনুধাবন করতে হবে যে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে এবং একে শূন্য সহনশীলতা নীতিতে দমন করতে হবে। দ্বিতীয়ত, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ দিতে হবে। অপরাধী যে দলের বা যে মতেরই হোক না কেন, তাকে আইনের আওতায় আনার কঠোর বার্তা মাঠ পর্যায়ে পৌঁছে দিতে হবে। হাটহাজারী, পতেঙ্গা এবং সীতাকুণ্ডের ঘটনায় জড়িত প্রত্যেক অপরাধীকে দ্রুততম সময়ের মধ্যে গ্রেপ্তার করে বিচারের মুখোমুখি করতে হবে।

বিশেষ করে, পুলিশের ওপর হামলাকারী এবং সাংবাদিকদের আক্রমণকারীদের যদি দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া না যায়, তবে বাহিনীর মনোবল এবং গণমাধ্যমের স্বাধীনতা—দুটোই মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

প্রশাসনের পক্ষ থেকে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার এবং তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তারে একটি সমন্বিত ‘ক্র্যাশ প্রোগ্রাম’ হাতে নেওয়া এখন সময়ের দাবি। একই সঙ্গে, জঙ্গল সলিমপুরের মতো অপরাধের অভয়ারণ্যগুলো চিরতরে গুঁড়িয়ে দিতে হবে। চট্টগ্রামের সাধারণ মানুষ আজ নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। সরকারের, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কঠোর পদক্ষেপ কাগজে-কলমে নয়, বাস্তবে দৃশ্যমান হতে হবে। অন্যথায়, এই অন্ধকার আরও গভীর হবে এবং তার দায় রাষ্ট্র এড়াতে পারবে না।

লেখক : ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, একুশে পত্রিকা।