
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস দীর্ঘ ৩৫ বছরের নিদ্রা ভেঙে জেগে উঠেছে। এই জাগরণের নাম চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ বা চাকসু নির্বাচন। ক্যাম্পাসের বাতাসে এখন কেবল নির্বাচনী আমেজ নয়, বরং এক ধরনের মুক্তির আনন্দও ভেসে বেড়াচ্ছে। রেলস্টেশন থেকে অনুষদের করিডোর, ঝুপড়ির চায়ের আড্ডা থেকে লাইব্রেরির প্রাঙ্গণ—সর্বত্রই এক উৎসবমুখর পরিবেশ। গানে গানে প্রচারণা, বরের সাজে প্রচারপত্র বিলি কিংবা ঐতিহ্যবাহী গম্ভীরার সুরে ভোট প্রার্থনা—এই সৃজনশীলতা বলে দেয়, শিক্ষার্থীরা কেবল তাদের প্রতিনিধিই নির্বাচন করতে যাচ্ছে না, তারা ফিরে পেতে চাইছে হারিয়ে যাওয়া এক গণতান্ত্রিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। এই উৎসবের পটভূমিতে দাঁড়িয়ে যখন ছাত্রদল ও ছাত্রশিবির–সমর্থিত প্যানেলের ইশতেহারের দিকে তাকাই, তখন একই সঙ্গে আশা ও আশঙ্কার এক মিশ্র অনুভূতি তৈরি হয়।
উভয় প্যানেলের ইশতেহারেই যেন শিক্ষার্থীদের সকল দুঃখ-দুর্দশা এক বছরেই সমাধান করে দেওয়ার এক জাদুকরী প্রতিশ্রুতি রয়েছে। আবাসন–সংকট নিরসন, সেশনজট দূরীকরণ, শাটল ট্রেনের বগি বৃদ্ধি, খাবারের মান উন্নয়ন, নিরাপদ ও নারীবান্ধব ক্যাম্পাস নির্মাণ, গবেষণাখাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি, ডিজিটাল অটোমেশন—কোনো কিছুই বাদ পড়েনি। ছাত্রদলের আট দফা কিংবা ছাত্রশিবিরের ৩৩ দফা সংস্কার কর্মসূচি মনোযোগ দিয়ে পড়লে মনে হবে, এ যেন বিশ্ববিদ্যালয়ের কাঠামোগত পরিবর্তনের এক মহাপরিকল্পনা। তারা ‘লাঞ্চের পরে আসেন’ সংস্কৃতি দূর করতে চায়, শিক্ষার্থীদের জন্য ঘণ্টাভিত্তিক চাকরির ব্যবস্থা করতে চায়, এমনকি মানসিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করারও অঙ্গীকার করছে।
নিঃসন্দেহে, এই প্রতিশ্রুতিগুলো প্রত্যেক সাধারণ শিক্ষার্থীর মনের কথা। এগুলো সেই সব সমস্যা, যা বছরের পর বছর ধরে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনকে জর্জরিত করে রেখেছে। এই ইশতেহারগুলো প্রমাণ করে যে, নেতৃত্বপ্রত্যাশীরা শিক্ষার্থীদের মৌলিক সমস্যাগুলো চিহ্নিত করতে পেরেছেন।
কিন্তু প্রশ্ন ওঠে বাস্তবতার জমিনে দাঁড়িয়ে। অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষার্থী তাওসিফ হোসেন বা মার্কেটিং বিভাগের তৌহিদুল ইসলামের মতো অনেক শিক্ষার্থীর মনেই যে শঙ্কা—‘সব ইশতেহার একই রকম মনে হচ্ছে’ বা ‘মাত্র এক বছরে এতকিছু বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে কি না’—তা অমূলক নয়। এই সংশয় যৌক্তিক। কেননা, চাকসুর মেয়াদ মাত্র এক বছর। এই স্বল্প সময়ে নতুন হল নির্মাণ বা রেললাইন সম্প্রসারণের মতো দীর্ঘমেয়াদী প্রকল্প বাস্তবায়ন তো দূরের কথা, বিদ্যমান হলগুলোর আবাসন–সংকট নিরসনে ১০ শতাংশ আসন বৃদ্ধিও একটি বিশাল চ্যালেঞ্জ। প্রশাসনিক জটিলতা, বাজেটের সীমাবদ্ধতা এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব কর্মপ্রক্রিয়ার সঙ্গে খাপ খাইয়ে এই ‘বিপ্লবী’ পরিবর্তনগুলো সাধন করা কতটা সম্ভব, তা এক বিরাট প্রশ্ন। এখানেই ইশতেহারগুলোকে ‘প্রতিশ্রুতির ফুলঝুরি’ বলে মনে হয়।
নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাথায় রাখতে হবে, শিক্ষার্থীরা এখন অনেক বেশি সচেতন। সাদিয়া ইসলামের মতো নারী শিক্ষার্থীরা চান, নারীবান্ধব ক্যাম্পাসের প্রতিশ্রুতি যেন কেবল কাগজের পাতায় সীমাবদ্ধ না থাকে।
এই নির্বাচনী উৎসবের আড়ালে এক চিলতে শঙ্কার মেঘও জমেছে। একে অপরের বিরুদ্ধে নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘনের পাল্টাপাল্টি অভিযোগ সেই পুরনো অসুস্থ রাজনীতির কথাই মনে করিয়ে দেয়। শ্রেণিকক্ষে প্রবেশ করে প্রচারণা চালানো বা সাউন্ড সিস্টেম ব্যবহার করার মতো ঘটনাগুলো প্রমাণ করে, গণতান্ত্রিক রীতিনীতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়ার শিক্ষাটি এখনো হয়তো পুরোপুরি রপ্ত করা যায়নি। দীর্ঘ ৩৫ বছর পর যখন ছাত্র রাজনীতির গণতান্ত্রিক চর্চা ফিরে আসছে, তখন শুরুতেই এ ধরনের ঘটনা হতাশাব্যঞ্জক।
উদার ও গণতান্ত্রিক ক্যাম্পাস বিনির্মাণের স্বপ্ন দেখতে হলে আগে নিজেদের গণতান্ত্রিক আচরণবিধির প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। প্রার্থীরা যদি নিয়ম ভাঙার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হন, তবে সাধারণ শিক্ষার্থীরা তাদের ওপর আস্থা রাখবে কীভাবে?
তবে সবকিছুর ঊর্ধ্বে এই নির্বাচনের সবচেয়ে ইতিবাচক দিক হলো এর অংশগ্রহণমূলক ও উৎসবমুখর চরিত্র। তানজির রহমানের মতো প্রার্থীরা যখন গিটারে সুর তুলে সংস্কৃতির প্রসারের কথা বলেন, কিংবা হাবিবুর রহমানের সমর্থক শিমুল হোসেন যখন বর সেজে ভোটারদের মনোযোগ আকর্ষণ করেন, তখন বোঝা যায়, ছাত্র রাজনীতি মানে কেবল প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করা নয়, বরং নিজেদের সৃজনশীলতা দিয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের মন জয় করাও। এই নতুন ধারার প্রচারণার কৌশলগুলো ক্যাম্পাসে এক নির্মল আনন্দের বার্তা ছড়িয়ে দিচ্ছে। এটিই চাকসুর মূল স্পিরিট—প্রতিযোগিতা থাকবে, কিন্তু তা হবে সৌহার্দ্যপূর্ণ।
আগামী ১৫ অক্টোবর প্রায় ২৭ হাজার ভোটার তাদের রায় দেবেন। এই রায় কেবল কোনো ব্যক্তি বা প্যানেলকে নির্বাচিত করবে না, বরং আগামী দিনে ক্যাম্পাসের রাজনীতির গতিপথও নির্ধারণ করবে। শিক্ষার্থীদের উচিত হবে, ইশতেহারের রঙিন প্রতিশ্রুতিতে ভেসে না গিয়ে প্রার্থীদের যোগ্যতা, সদিচ্ছা ও বাস্তবায়নের পরিকল্পনা বিচার-বিশ্লেষণ করা। মনে রাখতে হবে, চাকসু কোনো আলাদিনের চেরাগ নয় যে এক ফুঁৎকারে সব সমস্যার সমাধান করে দেবে। কিন্তু এটি এমন একটি প্ল্যাটফর্ম, যা শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ের পথে প্রশাসন ও ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে একটি শক্তিশালী সেতুবন্ধন তৈরি করতে পারে।
দিন শেষে, এই নির্বাচনের সাফল্য নির্ভর করবে বিজয়ীদের কর্মপন্থার ওপর। তারা কি দলীয় রাজনীতির সংকীর্ণ গণ্ডিতে আবদ্ধ থাকবেন, নাকি সকল শিক্ষার্থীর প্রতিনিধি হয়ে উঠতে পারবেন? ৩৫ বছরের প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে যে গণতান্ত্রিক বসন্তের সূচনা হয়েছে, তার সুবাস যেন আগামী এক বছর এবং তারপরও ক্যাম্পাসের প্রতিটি আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে পড়ে—এটাই আমাদের একান্ত প্রত্যাশা। উৎসবের এই আমেজ যেন নির্বাচন-পরবর্তী সময়েও বজায় থাকে এবং প্রতিশ্রুতিগুলো যেন কেবল কথার কথা না হয়ে শিক্ষার্থীদের জীবনে দৃশ্যমান পরিবর্তন নিয়ে আসে।
লেখক : ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, একুশে পত্রিকা।
