
দীর্ঘ ৪৪ বছরের অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (চাকসু) নেতৃত্বে নাটকীয় প্রত্যাবর্তন ঘটেছে ইসলামী ছাত্রশিবিরের। তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা, বিক্ষিপ্ত উত্তেজনা এবং পাল্টাপাল্টি অভিযোগের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ভিপি (সহ-সভাপতি) ও জিএস (সাধারণ সম্পাদক) সহ মোট ২৪টি পদে জয়লাভ করেছে শিবির সমর্থিত প্যানেল ‘সম্প্রীতির শিক্ষার্থী জোট’। এই জয়ের মাধ্যমে দীর্ঘ চার দশকের বেশি সময় পর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রাজনীতির শীর্ষ নেতৃত্বে ফিরল সংগঠনটি।
আজ বৃহস্পতিবার ভোরে প্রধান নির্বাচন কমিশনার অধ্যাপক মনির উদ্দিন ফলাফল ঘোষণা করেন। ঘোষিত ফল অনুযায়ী, সহ-সভাপতি (ভিপি) পদে ৭ হাজার ৯৮৩ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছেন সম্প্রীতির শিক্ষার্থী জোটের প্রার্থী মো. ইব্রাহিম হোসেন। তিনি ছাত্রশিবিরের চট্টগ্রাম মহানগর দক্ষিণের সভাপতি এবং ইতিহাস বিভাগের এমফিল গবেষক। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছাত্রদল সমর্থিত প্যানেলের সাজ্জাদ হোসেন পেয়েছেন ৪ হাজার ৩৭৪ ভোট।
সাধারণ সম্পাদক (জিএস) পদে ৮ হাজার ৩১ ভোট পেয়ে বিজয়ী হয়েছেন একই প্যানেলের সাঈদ বিন হাবিব। তিনি বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রশিবিরের সাহিত্য সম্পাদক ও ইতিহাস বিভাগের স্নাতকোত্তরের শিক্ষার্থী। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছাত্রদলের মো. শাফায়াত পেয়েছেন ২ হাজার ৭৩৪ ভোট।
তবে চাকসুর ২৬টি পদের মধ্যে সহ-সাধারণ সম্পাদক (এজিএস) পদে ৭ হাজার ১৪ ভোট পেয়ে জয়ী হয়েছেন ছাত্রদল প্যানেলের প্রার্থী আইয়ুবুর রহমান। তার প্রতিদ্বন্দ্বী শিবির প্যানেলের সাজ্জাদ হোছন পেয়েছেন ৫ হাজার ৪৫ ভোট। এছাড়া সহ-খেলাধুলা ও ক্রীড়া সম্পাদক পদে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে জয় পেয়েছেন তামান্না মাহবুব।
চাকসুর ইতিহাসে ছাত্রশিবিরের সর্বশেষ জয় এসেছিল ১৯৮১ সালে, যখন ভিপি হয়েছিলেন জসিম উদ্দিন সরকার এবং জিএস হয়েছিলেন আবদুল গাফফার। এরপর কেটে গেছে ৪৪ বছর। দীর্ঘ এই সময় পর আবারও সংগঠনটির প্রার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ পেলেন।
উত্তেজনায় ভরা ভোটের রাত
ভোটগ্রহণ শান্তিপূর্ণভাবে শেষ হলেও ফলাফল ঘোষণা কেন্দ্র করে রাতভর ক্যাম্পাসে ছিল টানটান উত্তেজনা। বুধবার মধ্যরাতে সোহরাওয়ার্দী হল সংসদের ফল ঘোষণা নিয়ে ছাত্রদল ও ছাত্রশিবিরের কর্মীদের মধ্যে হট্টগোল শুরু হয়। কারচুপির অভিযোগ তুলে ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক মো. কামাল উদ্দিনকে প্রকৌশল অনুষদ ভবনে প্রায় আড়াই ঘণ্টা অবরুদ্ধ করে রাখেন। তাদের অভিযোগ ছিল, সোহরাওয়ার্দী হলের ভিপি পদে তাদের প্রার্থী জমাদিউল আওয়ালকে কারচুপির মাধ্যমে হারানো হয়েছে। পরে ফলাফল পুনর্বিবেচনার আশ্বাসে রাত সোয়া তিনটার দিকে সহ-উপাচার্যকে মুক্ত করা হয়।
একই সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকে বিএনপি-ছাত্রদল এবং জামায়াত-ছাত্রশিবিরের নেতাকর্মীরা মুখোমুখি অবস্থান নিলে পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। বিপুল সংখ্যক পুলিশ ও বিজিবি সদস্যের উপস্থিতিতে বড় কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা এড়ানো সম্ভব হয়।
নির্বাচন নিয়ে অভিযোগ ও সমালোচনা
দিনভর নির্বাচনে ভোটারদের উচ্ছ্বাস থাকলেও বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগ ওঠে। অমোচনীয় কালির ব্যবহার না হওয়া, যা সহজেই মুছে যাচ্ছিল, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন প্রায় সব প্যানেলের প্রার্থীরা। ছাত্রদল সমর্থিত ভিপি প্রার্থী সাজ্জাদ হোসেন এবং জিএস প্রার্থী শাফায়াত হোসেন নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা নিয়ে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তারা অভিযোগ করেন, বারবার অভিযোগ জানানোর পরও কমিশন অসহায়ত্ব প্রকাশ করেছে এবং লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়েছে।
অন্যদিকে, ছাত্রশিবির সমর্থিত ভিপি প্রার্থী মো. ইব্রাহীম হোসেন অভিযোগ করেন, ছাত্রদলের বহিরাগতরা কেন্দ্রে প্রবেশ করলেও প্রশাসন তাদের আটকাতে ব্যর্থ হয়েছে। এছাড়াও বামপন্থী প্যানেলগুলোর পক্ষ থেকেও প্রশাসনের পক্ষপাতমূলক আচরণের অভিযোগ আনা হয়। কারচুপির অভিযোগ এনে ‘রেভ্যুলেশন ফর স্টেট অব হিউম্যানিটি’ প্যানেল নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেয়।
প্রায় ৭০ শতাংশ ভোট পড়ার এই নির্বাচনে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ ছিল চোখে পড়ার মতো। দীর্ঘ ৩৫ বছর পর অনুষ্ঠিত এই নির্বাচনকে ঘিরে শিক্ষার্থীদের মধ্যে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা দেখা যায়। তবে বিভিন্ন অভিযোগ ও উত্তেজনার ঘটনা এই ঐতিহাসিক নির্বাচনকে কিছুটা ম্লান করেছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
