
দীর্ঘ ৪৪ বছরের নিস্তব্ধতা ভেঙে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (চাকসু) নির্বাচনে ইসলামী ছাত্রশিবিরের নাটকীয় ও নিরঙ্কুশ বিজয় কেবল একটি ছাত্র সংগঠনের নাটকীয় প্রত্যাবর্তন নয়, বরং এটি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রাজনীতির গতিপথ, প্রশাসনিক সক্ষমতা এবং আগামী দিনের রাজনৈতিক সমীকরণের এক জটিল প্রতিচ্ছবি। বুধবারের আপাত শান্ত ভোটগ্রহণ পর্ব শেষে যে রাত নেমে এসেছিল, তা ছিল তীব্র উত্তেজনা, পারস্পরিক অবিশ্বাস, প্রশাসনিক অসহায়ত্ব এবং শক্তির মহড়ায় পরিপূর্ণ। এই নির্বাচনের ফলাফল ভবিষ্যতের জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন রেখে গেছে, যার উত্তরই নির্ধারণ করবে ক্যাম্পাসের আগামী দিনের চরিত্র।
ফলাফলের চেয়েও বড় বার্তা হলো, ভোররাতে ঘোষিত এই নির্বাচনে ২৬টি কেন্দ্রীয় পদের মধ্যে ২৪টিতেই শিবির সমর্থিত প্যানেল ‘সম্প্রীতির শিক্ষার্থী জোট’-এর বিজয় এক কথায় অভাবনীয়। সহ-সভাপতি (ভিপি) পদে মো. ইব্রাহিম হোসেন এবং সাধারণ সম্পাদক (জিএস) পদে সাঈদ বিন হাবিব-এর বিশাল ভোটের ব্যবধানে জয়লাভ প্রমাণ করে, এটি কোনো আকস্মিক ঘটনা নয়, বরং সুসংগঠিত এবং দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার ফসল। অন্যদিকে, প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ছাত্রদলের প্যানেল থেকে শুধুমাত্র সহ-সাধারণ সম্পাদক (এজিএস) পদে আইয়ুবুর রহমান-এর জয় সংগঠনটির সাংগঠনিক দুর্বলতা এবং শিক্ষার্থীদের আস্থা অর্জনে ব্যর্থতাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। এই ফলাফল স্পষ্টতই একটি নীরব ব্যালট বিপ্লবের ইঙ্গিত দেয়, যেখানে সাধারণ শিক্ষার্থীরা হয়তো প্রচলিত ছাত্র রাজনীতির ধারা থেকে মুখ ফিরিয়ে একটি বিকল্পকে বেছে নিয়েছে। পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, এই বিজয় শুধুমাত্র শিবিরের সাংগঠনিক শক্তির প্রতিফলন নয়, বরং ক্যাম্পাসে দীর্ঘ সময় ধরে ক্রিয়াশীল অন্যান্য ছাত্র সংগঠনগুলোর প্রতি শিক্ষার্থীদের পুঞ্জীভূত ক্ষোভেরও বহিঃপ্রকাশ।
এই নির্বাচনের সবচেয়ে বিতর্কিত অধ্যায় হলো নির্বাচন কমিশন ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের ভূমিকা। প্রায় প্রতিটি প্যানেল, এমনকি বিজয়ী শিবিরও, প্রশাসনের বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্ব বা চরম অব্যবস্থাপনার অভিযোগ এনেছে। এই সর্বজনীন অভিযোগ প্রমাণ করে, প্রশাসন একটি আস্থার পরিবেশ তৈরি করতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। এর একটি বড় দিক ছিল কারিগরি দুর্বলতা; ভোটারের আঙুলে দেওয়া অমোচনীয় কালির এক ঘষাতেই উঠে যাওয়া, ব্যালট পেপারে প্রিসাইডিং কর্মকর্তার স্বাক্ষর না থাকা এবং ভোট গণনার ধীরগতি—এই বিষয়গুলো নির্বাচন কমিশনের পেশাদারিত্বকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে।
এর পাশাপাশি নিরাপত্তা ও নিয়ন্ত্রণহীনতার গুরুতর অভিযোগও ছিল। ক্যাম্পাসে বহিরাগতদের প্রবেশ আটকাতে প্রশাসনের ব্যর্থতার অভিযোগ তুলেছে স্বয়ং বিজয়ী শিবির, অন্যদিকে ছাত্রদলসহ অন্য প্যানেলগুলোও নির্দিষ্ট একটি গোষ্ঠীকে সুবিধা দেওয়ার অভিযোগ করেছে। এটি প্রমাণ করে, প্রশাসন কোনো পক্ষকেই এই নিশ্চয়তা দিতে পারেনি যে, নির্বাচনী মাঠ সবার জন্য সমান।
সর্বোপরি, সংকট ব্যবস্থাপনায় প্রশাসনের চূড়ান্ত ব্যর্থতা প্রকাশ পায় ফলাফল ঘোষণা কেন্দ্রিক উত্তেজনায়। মধ্যরাতে যখন সহ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক মো. কামাল উদ্দিন-কে প্রায় আড়াই ঘণ্টা অবরুদ্ধ করে রাখা হয় এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকে বিবদমান গোষ্ঠীগুলো মুখোমুখি অবস্থান নেয়, তখন পরিস্থিতি সামাল দিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর নির্ভর করতে হয়েছে, যা বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা রক্ষার ক্ষেত্রে প্রশাসনের নিজস্ব সক্ষমতার অভাবকেই নির্দেশ করে।
দীর্ঘ ৪৪ বছর পর ছাত্রশিবিরের এই ভূমিধস বিজয়ের পেছনে একাধিক কারণ ক্রিয়াশীল। এর মূলে রয়েছে তাদের ক্যাডারভিত্তিক সুসংগঠিত কার্যক্রম। বছরের পর বছর ধরে ক্যাম্পাসে নিজেদের সাংগঠনিক ভিত্তি মজবুত করার কাজটি তারা নিরলসভাবে করেছে। সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ব্যক্তিগত যোগাযোগ ও বিভিন্ন সংকটে পাশে থাকার চেষ্টার মাধ্যমে তারা একটি নির্দিষ্ট ভোটার শ্রেণি তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে। এই সাংগঠনিক শক্তির পাশাপাশি তাদের রাজনৈতিক কৌশলও ছিল বিচক্ষণ। সরাসরি দলীয় পরিচয়ের পরিবর্তে ‘সম্প্রীতির শিক্ষার্থী জোট’-এর মতো একটি অপেক্ষাকৃত নরম ও অন্তর্ভুক্তিমূলক নামে প্যানেল দিয়ে তারা শিবির সমর্থকের বাইরেও সাধারণ ও রক্ষণশীল ধারার শিক্ষার্থীদের ভোট আকর্ষণ করতে পেরেছে। তাদের এই উত্থানের পেছনে প্রতিদ্বন্দ্বীদের দুর্বলতাও বড় ভূমিকা রেখেছে। ছাত্রদল অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও ধারাবাহিক কর্মসূচির অভাবে শিক্ষার্থীদের সংগঠিত করতে ব্যর্থ হয়েছে এবং বামপন্থী জোটগুলো একাধিক প্যানেলে বিভক্ত হয়ে যাওয়ায় তাদের ভোট ব্যাংক খণ্ডিত হয়েছে। এই রাজনৈতিক শূন্যতার সম্মিলিত ফল হিসেবেই নীরব ভোটারদের একটি বড় অংশ, যারা এবারই প্রথম ভোটকেন্দ্রে এসেছেন, তারা স্থিতিশীলতা এবং পরিবর্তনের আশায় শিবির সমর্থিত প্যানেলকেই বেছে নিয়েছে।
চাকসুতে শিবিরের এই একচ্ছত্র আধিপত্য আগামী দিনে ক্যাম্পাসের রাজনীতিতে নতুন এবং জটিল সমীকরণের জন্ম দেবে। প্রথমত, একটি নির্দিষ্ট আদর্শের অনুসারী ছাত্র সংসদ কীভাবে সব মত ও পথের শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধিত্ব করবে, তা হবে তাদের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। অতীতে ক্যাম্পাসে শিবিরের কার্যক্রম নিয়ে বিভিন্ন অভিযোগ ও বিতর্ক রয়েছে। সেই প্রেক্ষাপটে, তারা কীভাবে একটি সহনশীল ও গণতান্ত্রিক পরিবেশ বজায় রাখবে, তার ওপরই তাদের গ্রহণযোগ্যতা নির্ভর করবে। দ্বিতীয়ত, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সঙ্গে নতুন ছাত্র সংসদের সম্পর্ক কেমন হবে, তা দেখার বিষয়। যে প্রশাসনকে নির্বাচনের সময় প্রায় সব পক্ষই প্রশ্নবিদ্ধ করেছে, সেই প্রশাসনের সঙ্গে মিলে বিজয়ী প্যানেল শিক্ষার্থীদের জন্য কতটা কাজ করতে পারবে, তা একটি বড় প্রশ্ন।
সর্বোপরি, এই নির্বাচন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে দীর্ঘদিনের একটি রাজনৈতিক স্থবিরতার অবসান ঘটালেও এর প্রক্রিয়া এবং ফলাফল ক্যাম্পাসে একটি নতুন অস্থিরতার বীজ বপন করল কিনা, সেই আশঙ্কা থেকেই যায়। চাকসু নির্বাচন শিক্ষার্থীদের গণতান্ত্রিক অধিকার ফিরিয়ে দিয়েছে ঠিকই, কিন্তু এই গণতন্ত্রের চর্চা কতটা মসৃণ হবে, তা নির্ভর করবে বিজয়ী, বিজিত এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সম্মিলিত প্রজ্ঞা ও সহনশীলতার ওপর। এই নির্বাচনের ঢেউ জাতীয় রাজনীতিতে কতটা প্রভাব ফেলবে, তা ভবিষ্যতই বলে দেবে, তবে এটি যে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করল, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
লেখক: ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, একুশে পত্রিকা।
