
মিয়ানমারের গৃহযুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ এবং তহবিলের সংকটকে অগ্রাধিকার দিতে হবে উল্লেখ করে আরাকান আর্মির (এএ) প্রধান মেজর জেনারেল তুন মিয়াত নাইং বলেছেন, এই মুহূর্তে বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের রাখাইনে ফিরিয়ে আনার পরিস্থিতি নেই। তার মতে, মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ অস্থিতিশীল পরিস্থিতি বিবেচনায় না নিয়ে প্রত্যাবাসনের কথা বলাটা বাস্তবসম্মত নয়।
মিয়ানমারের সংবাদমাধ্যম ‘দ্য ইরাবতী’-কে দেওয়া এক দীর্ঘ সাক্ষাৎকারে তিনি রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন, বাংলাদেশ পরিস্থিতি, রাখাইনের মুসলিমদের সঙ্গে সম্পর্ক এবং বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠীর তৎপরতা নিয়ে খোলামেলা কথা বলেন। ইরাবতীর এডিটর-ইন-চিফ অং জ-এর নেওয়া সাক্ষাৎকারটি তিন পর্বে প্রকাশিত হয়।
আরাকান আর্মি সম্প্রতি মিয়ানমারের সামরিক জান্তাকে হটিয়ে বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী মংডুসহ রাখাইন রাজ্যের অধিকাংশ এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে। ২০০৯ সালে বাহিনীটি প্রতিষ্ঠার পর এই প্রথম রাখাইনে ফিরেছেন এর সর্বোচ্চ নেতা তুন মিয়াত নাইং।
প্রত্যাবাসনের আগে সংকট মোকাবেলা
বিশ্বজুড়ে যখন রোহিঙ্গাদের শান্তিপূর্ণ প্রত্যাবাসনের দাবি উঠছে, তখন এ বিষয়ে নিজেদের প্রস্তুতির কথা জানাতে গিয়ে তুন মিয়াত নাইং বলেন, বিষয়টি শুধু রাখাইন রাজ্যের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে হবে না, পুরো মিয়ানমারের প্রেক্ষাপটে বিবেচনা করতে হবে।
তিনি বলেন, “বাংলাদেশের অগ্রাধিকার হলো সেখানে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের তাদের মাতৃভূমিতে ফেরানো। কিন্তু মিয়ানমারে গৃহযুদ্ধ চলছে। এখানে দুর্ভিক্ষ ও পরবর্তী সংকটও স্পষ্ট। সুতরাং এ সমস্যাগুলোকে আমাদের অগ্রাধিকার দিতে হবে। এ অবস্থায় এসব শরণার্থীকে মিয়ানমারে পাঠালে, যেখানে যুদ্ধ চলছে, কোনো তহবিল না থাকায় তাদের ‘মানবিক’ সহায়তার প্রশ্ন উঠবে।”
নিরাপত্তার ঝুঁকিকে দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ কারণ হিসেবে উল্লেখ করে আরাকান আর্মি প্রধান বলেন, “মিয়ানমারে আগের চেয়ে অনেক রোহিঙ্গা সশস্ত্র গোষ্ঠী সক্রিয়। তাদের বিষয়টি সামনে রেখে সংকট আরও ঘনীভূত হতে পারে। আমাদের সম্পদের সীমাবদ্ধতা আছে। সীমান্তে যা হচ্ছে, সে বিষয়গুলো আমাদের খুবই সতর্কতার সঙ্গে মোকাবিলা করতে হবে।”
‘ভুল বোঝাবুঝির’ অবসান ও মুসলিমদের সঙ্গে আলোচনা
রাখাইনে ফেরার পর স্থানীয় মুসলিম নেতা ও সম্প্রদায় প্রধানদের সঙ্গে বৈঠকের কথা উল্লেখ করে তুন মিয়াত নাইং জানান, সেখানে নাগরিকত্ব, অধিকার ও দায়িত্ব নিয়ে খোলামেলা আলোচনা হয়েছে।
তার ভাষায়, “আমরা বলেছি, যদি তারা অধিকার দাবি করার পরিবর্তে দায়িত্ববান হতো এবং তাদের কর্তব্য পালন করত, তাহলে এসব অধিকার দাবি করতে হতো না; এমনিতেই পেত। আমরা বিগত ৭০ বছরে রোহিঙ্গা মুসলিম ও রাখাইন জনগণের মধ্যে সংঘাত নিয়ে কথা বলেছি, যা আমাদের একে অপরের প্রতি সন্দেহ ও ঘৃণায় পরিণত করেছে।”
তিনি দাবি করেন, আরাকান আর্মি রাখাইনের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর থেকে পুরনো জাতিগত ও ধর্মীয় বিরোধ দেখা যায়নি। তিনি বলেন, “এখন আমাদের মধ্যে আর জাতিগত-ধর্মীয় বিরোধ নেই; শুধু নিরাপত্তাজনিত কারণে সীমান্ত এলাকায় কিছু নিষেধাজ্ঞা রয়েছে, যার উদ্দেশ্য সশস্ত্র কর্মকাণ্ড প্রতিরোধ করা।”
সাক্ষাৎকারে তিনি সম্প্রতি একটি বন্ধ মসজিদ খুলে দেওয়ার অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার কথাও উল্লেখ করেন। তবে মসজিদ খোলার সুযোগকে চরমপন্থিরা যাতে ব্যবহার করতে না পারে, সেজন্য ইসলামিক কমিটি এবং মুসলিম ধর্মীয় নেতাদের সতর্ক থাকতে বলেছেন বলেও জানান।
সশস্ত্র গোষ্ঠী ও জান্তার ‘ভয়ংকর জুয়া’
তুন মিয়াত নাইং অভিযোগ করেন, মিয়ানমারের সামরিক জান্তা আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য স্থানীয় রোহিঙ্গাদের সামরিক প্রশিক্ষণ দিয়েছে এবং তাদের মগজ ধোলাই করে বোঝানোর চেষ্টা করেছে যে বুথিডং ও মংডু রাখাইনের অংশ নয়।
তার মতে, “এটা ভয়ংকর জুয়া। জান্তা এর মাধ্যমে স্বল্প সময়ের জন্য কিছু অর্জন করতে পেরেছে, কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে এ অঞ্চলে সংকট তৈরি করেছে।”
তিনি বলেন, জান্তা প্রথমে রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন (আরএসও) এবং পরে আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা)-কে ব্যবহার করার চেষ্টা করে। কিন্তু আরসা মাদক সিন্ডিকেটে জড়িয়ে পড়লে তারাও এই গোষ্ঠীকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেনি।
বাংলাদেশ ও আন্তর্জাতিক চাপ প্রসঙ্গ
সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের একটি বক্তব্যের সমালোচনা করেন আরাকান আর্মি প্রধান। তিনি বলেন, “তিনি (ড. ইউনূস) বলেছিলেন, ‘রোহিঙ্গারা ঈদের আগেই রাখাইনে যাবে।’ তিনি মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি বিবেচনা না করেই এ প্রস্তাব করেছেন।”
নিজের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আদালতে মামলার প্রচেষ্টার বিষয়ে জানতে চাইলে তুন মিয়াত নাইং বলেন, “আমি এতে খুব বিরক্তি বোধ করি না। আমরা যখন এ সমস্যার সমাধান করব, তখন সঠিক অবস্থানে থাকব… ন্যায়ের কথা যদি তারা বলে, তবে তারা আমাদের নিজস্ব আরাকানের জনগণের বিপ্লবী সরকারের আদালতে মামলা করে সত্য বের করুক। এরপর না হয় আন্তর্জাতিক আদালতে যেতে পারে।”
তবে তিনি স্বীকার করেন যে, আরাকান আর্মির কিছু সৈন্য আইন লঙ্ঘন করেছে এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য তাদের শাস্তিও দেওয়া হয়েছে। তার দাবি, “আমরা মানবাধিকার লঙ্ঘন করতে পারি না কিংবা বিষয়টিকে নীতিগতভাবেও সমর্থন দিচ্ছি না।”
তিনি আরও জানান, রাখাইনে বসবাসকারী রোহিঙ্গা এবং বাংলাদেশের শরণার্থী শিবিরে থাকা রোহিঙ্গাদের মানসিকতায় “তাৎপর্যপূর্ণ গ্যাপ” রয়েছে। তার মতে, বাংলাদেশে থাকা অনেক শরণার্থী ফিরতে চাইলেও “রাজনৈতিক কারণে” তাদের কথা বলা হয় না এবং শরণার্থী শিবিরে রাখাইনবিরোধী চিন্তাধারা ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে।
