- চট্টগ্রামের ইপিজেড এলাকার সাততলা ভবনের কারখানাটির পুরোটিই আগুনে পুড়েছে।
টানা ১৭ ঘণ্টার লড়াই শেষ হয়েছে। চট্টগ্রাম রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল (সিইপিজেড) এলাকার অ্যাডামস ক্যাপস ও জিহং মেডিক্যাল কোম্পানির ভবনে লাগা সেই ভয়াবহ আগুনের লেলিহান শিখা অবশেষে নিয়ন্ত্রণে এসেছে। শুক্রবার সকাল সাড়ে সাতটায় ফায়ার সার্ভিস আগুন নিয়ন্ত্রণের ঘোষণা দেওয়ার পর বন্দর নগরীর আতঙ্কিত মানুষ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছে। বৃহস্পতিবার দুপুর থেকে যে ধ্বংসযজ্ঞ শুরু হয়েছিল, তা শুক্রবার সকাল পর্যন্ত ফায়ার সার্ভিস, সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী এবং বিজিবির সদস্যদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় থামানো সম্ভব হয়েছে। এই দুঃস্বপ্নের মধ্যে সবচেয়ে বড় এবং একমাত্র স্বস্তির সংবাদটি দিয়েছেন ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক তাজুল ইসলাম; এই ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে কোনো প্রাণহানি ঘটেনি, কেউ হতাহত হননি।
সত্যিই, এটা বড় পাওনা। একটি সাততলা ভবনের গুদাম থেকে লাগা আগুন যখন দাহ্য পদার্থের সংস্পর্শে এসে গোটা ভবনকে গ্রাস করে ফেলে, যখন ভবনের ওপরতলার ছাদ ধসে পড়ে এবং পুরো কাঠামোটিই ‘অতি ঝুঁকিপূর্ণ’ হয়ে ওঠে, তখন শত শত শ্রমিকের প্রাণরক্ষা পাওয়াকে অলৌকিক বললেও কম বলা হয়। আমরা সিইপিজেড কর্তৃপক্ষকে ধন্যবাদ জানাই, বিশেষ করে এর নির্বাহী পরিচালক আবদুস সোবহান যেমনটি বলেছেন, আগুন লাগার পরপরই শ্রমিকদের নিরাপদে বের করে আনা সম্ভব হয়েছে। কিছুদিন আগে করানো ফায়ার ড্রিল বা মহড়া এক্ষেত্রে নিঃসন্দেহে বড় ভূমিকা রেখেছে। আমাদের অসীম সাহসী ফায়ার ফাইটাররা, যাদের প্রথম ইউনিটটি মাত্র দুই মিনিটের মধ্যে ঘটনাস্থলে পৌঁছেছিল, তারা নিজেদের জীবন বাজি রেখে আগুনকে পাশের ভবনগুলোতে ছড়িয়ে পড়া থেকেও রক্ষা করেছেন। তাদের এই সাফল্যকে আমরা স্যালুট জানাই।
কিন্তু এই স্বস্তির নিঃশ্বাসের সাথেই কিছু ভারী এবং অস্বস্তিকর প্রশ্ন ধোঁয়ার মতো কুণ্ডলী পাকাচ্ছে। সিইপিজেডের মতো দেশের অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি যে অঞ্চলে, সেখানে একটি কারখানায় লাগা আগুন নেভাতে কেন ১৭ ঘণ্টা সময় লাগবে? ফায়ার সার্ভিসের চট্টগ্রাম অঞ্চলের কর্মকর্তা মো. জাকির বা উপ-পরিচালক জসিম উদ্দিনের দলবল কেন এত অসহায়ভাবে দীর্ঘ সময় ধরে আগুনজ্বলা দেখবে?
এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে আমরা দুটি সাংঘর্ষিক ও উদ্বেগজনক তথ্য পাচ্ছি। ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক তাজুল ইসলাম সুস্পষ্টভাবে বলেছেন, ভবনটি বিল্ডিং কোড মেনে করা হয়নি। ভবনের দুই দিক খোলা থাকলেও পাশের ভবনগুলো খুব কাছাকাছি হওয়ায় এবং কোড না মানায় ফায়ার ফাইটাররা সঠিকভাবে কাজ করতে বা আগুন লাগার উৎসে পৌঁছাতে বাধার সম্মুখীন হয়েছেন। সহজ কথায়, ভবনটির গাফিলতিপূর্ণ নির্মাণশৈলী আগুন নেভানোর প্রক্রিয়াকে জটিল ও দীর্ঘায়িত করেছে।

এর ঠিক বিপরীত বক্তব্য এসেছে সিইপিজেডের নির্বাহী পরিচালক আবদুস সোবহানের কাছ থেকে। তিনি দাবি করেছেন, এই ভবনটিও কমপ্লায়েন্সের আওতায় ছিল এবং সব প্রতিষ্ঠানকেই উৎপাদনের আগে ফায়ার কমপ্লায়েন্স সনদ নিতে হয়।
এই দুই শীর্ষ কর্মকর্তার পরস্পরবিরোধী বক্তব্য আমাদের স্তম্ভিত করে। এটি একটি নিষ্ঠুর পরিহাস। যদি ফায়ার সার্ভিসের পরিচালকের কথা সত্য হয়, তবে প্রশ্ন ওঠে, দেশের প্রধান রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলে একটি নন-কমপ্লায়েন্ট ভবন কীভাবে উৎপাদনের ছাড়পত্র পায়? আর যদি সিইপিজেডের নির্বাহী পরিচালকের কথা সত্য হয়, অর্থাৎ ভবনটি ‘কমপ্লায়েন্ট’ হয়েই থাকে, তবে সেই কমপ্লায়েন্সের কার্যকারিতা কী? যে কমপ্লায়েন্স ফায়ার সার্ভিসের কাজের সহায়ক হয় না, যে ভবনে আগুন লাগলে তা নেভানোর পথ থাকে না, সেই ‘কাগজি কমপ্লায়েন্স’ কার স্বার্থে?
এই অগ্নিকাণ্ড আমাদের অবকাঠামোগত দুর্বলতাকেও নগ্নভাবে প্রকাশ করে দিয়েছে। ঘটনাস্থলের এক কিলোমিটারের মধ্যে ফায়ার স্টেশন, দুই মিনিটে প্রথম ইউনিট হাজির, তবু আগুন নিয়ন্ত্রণে ১৭ ঘণ্টা! এর কারণ কী? কারণ, আমাদের সাহসী ফায়ার ফাইটারদের হাতে হয়তো আধুনিক প্রযুক্তি নেই। আগুন নেভানোর জন্য রাস্তায় রাস্তায় ফায়ার হাইড্র্যান্ট (পানি সরবরাহের বিশেষ পয়েন্ট) নেই। উন্নত বিশ্ব যখন রোবটিক ইকুইপমেন্ট (যদিও এবার একটির ব্যবহার হয়েছে) বা ড্রোন প্রযুক্তি ব্যবহার করে আগুন নেভায়, তখন আমাদের বীরদের সেকেলে যন্ত্রপাতি নিয়েই আগুনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হয়। দোষ তাদের নয়; দোষ আমাদের ব্যবস্থার, আমাদের ‘মগজের ঘাটতি’র। আমরা হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ সুরক্ষিত রাখার জন্য প্রয়োজনীয় কয়েক কোটি টাকার অগ্নিনির্বাপণ পরিকাঠামো নির্মাণে উদাসীন।
অ্যাডামস ক্যাপ ও জিহং মেডিক্যালের এই ভবনটি সার্জিক্যাল গাউন, তোয়ালে ও ক্যাপ তৈরি করতো। এসব অতি দাহ্য পদার্থ গুদামে থাকায় আগুন ভয়াবহ রূপ নেয়, যা স্বাভাবিক। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এমন দাহ্য পদার্থের গুদামের জন্য যে মানের নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকা দরকার, তা কি ছিল?
প্রতিটি দুর্ঘটনার পর যা হয়, এবারও তাই হয়েছে। ফায়ার সার্ভিস ও বেপজা (ইপিজেড কর্তৃপক্ষ) পৃথক দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। ফায়ার সার্ভিস পাঁচ সদস্যের কমিটিকে ১৫ কার্যদিবস এবং বেপজা পাঁচ সদস্যের কমিটিকে ৭ কার্যদিবসের সময় দিয়েছে। আমরা এমন অসংখ্য কমিটি দেখেছি। এই কমিটিগুলো যখন প্রতিবেদন দেয়, তখন তা বাস্তবায়নের চিত্র হতাশাজনক। আমরা আশা করবো, এবারের তদন্ত শুধু আগুনের সূত্রপাত নয়, বরং ‘কমপ্লায়েন্স’ নিয়ে দুই সংস্থার দুই রকম বক্তব্যের পেছনের সত্যটাকেও বের করে আনবে।
ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক তাজুল ইসলাম সঠিক পরামর্শই দিয়েছেন। সিইপিজেডের সব ভবনকে দ্রুত সত্যিকারের কমপ্লায়েন্সের আওতায় এনে কার্যকারিতা সনদ নিতে হবে। এই আগুনে যে ক্ষতি হলো, তা শুধু মালিকের নয়, তা দেশের ক্ষতি। আজ ভবনটি ‘অতি ঝুঁকিপূর্ণ’ ঘোষণা করে ব্যানার টাঙিয়ে দিলেই দায়িত্ব শেষ হবে না। এই ঘটনাকে একটি সতর্কবার্তা হিসেবে নিতে হবে। সিইপিজেডসহ চট্টগ্রামের সব শিল্প-কারখানায় অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থার আমূল সংস্কার প্রয়োজন। শুধু ফায়ার ড্রিল নয়, প্রয়োজন আধুনিক অগ্নিনির্বাপণ অবকাঠামো নির্মাণ এবং ফায়ার সার্ভিসকে আরও শক্তিশালী করা।
১৭ ঘণ্টার আগুন নিভেছে, কিন্তু গাফিলতির আগুন যেন না জ্বলে ওঠে। শ্রমিকদের জীবন বেঁচেছে, এটাই পরম সৌভাগ্য। কিন্তু এই সৌভাগ্যের ওপর ভর করে আমরা আর কতদিন চলবো? এই ধ্বংসস্তূপের ছাই থেকে আমাদের শিখতে হবে। তদন্তের নামে সময়ক্ষেপণ নয়, সত্যিকারের দায়বদ্ধতা ও প্রতিকারই এখন সময়ের দাবি।
লেখক: ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, একুশে পত্রিকা।

