
অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে সারা দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতির পরিবর্তে ক্রমাগত অবনতি ঘটছে। হত্যা, অপহরণ, চাঁদাবাজিসহ নানা অপরাধের পাশাপাশি অভিযানে গিয়ে পুলিশের ওপর হামলার ঘটনা উদ্বেগ বাড়িয়েছে। জাতীয় নির্বাচনের সময় ঘনিয়ে আসায় পরিস্থিতি আরও তপ্ত হচ্ছে, সক্রিয় হয়ে উঠছে আন্ডারওয়ার্ল্ডের সন্ত্রাসীরা। এই পরিস্থিতিতে সরকারের নীতিনির্ধারকদের পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও জনমনে উদ্বেগ বাড়ছে।
পুলিশ সদর দপ্তরে দফায় দফায় বৈঠক হচ্ছে। সূত্র জানায়, গত সপ্তাহে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলমের নেতৃত্বে ঊর্ধ্বতনদের এক বিশেষ বৈঠকে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি উদ্বেগজনক হওয়ায় বিশদ আলোচনা হয়। কী কারণে পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে, তা নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ করা হয়, বিশেষ করে পুলিশের ওপর হামলার ঘটনা বেশি উত্তাপ ছড়ায়। যারা অবনতি ঘটাচ্ছে তাদের দ্রুত আইনের আওতায় আনার সিদ্ধান্ত হয়েছে। পুলিশের ইউনিট প্রধান, রেঞ্জের ডিআইজি, জেলার পুলিশ সুপার ও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের কাছে গত বৃহস্পতিবার রাতে এই বিশেষ বার্তা পাঠানো হয়েছে। বার্তায় বলা হয়, অপরাধ সংঘটনপ্রবণ এলাকায় প্রাথমিক তদন্তে পুলিশের দায়িত্বে অবহেলা পেলে সংশ্লিষ্ট সদস্য বা ইউনিটের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে এবং তাদের জবাবদিহি করতে হবে।
পুলিশের বিশেষ বার্তায় পরিস্থিতির দ্রুত উন্নতি ঘটাতে মাঠপর্যায়ের কার্যক্রম ঢেলে সাজানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে তল্লাশিচৌকি বাড়ানো, অপরাধপ্রবণ এলাকায় টহল বৃদ্ধি এবং সেনাবাহিনী, পুলিশের বিভিন্ন ইউনিট ও বিজিবি সদস্যদের সমন্বয়ে যৌথ বাহিনী গঠন করে টার্গেটকৃত এলাকায় জোরালো অপারেশন চালানোর কথা বলা হয়েছে। এছাড়া গুরুত্বপূর্ণ সড়কে অতিরিক্ত প্যাট্রল ডিউটি, বিভিন্ন ইউনিটপ্রধানদের সমন্বিত তৎপরতা, অলিগলিতে তাৎক্ষণিক টহলের জন্য মোটরসাইকেল কেনা, ছিনতাইকারী-ডাকাতদের সম্ভাব্য অবস্থানে সমন্বিত অভিযান, থানাভিত্তিক সন্ত্রাসীদের তালিকা হালনাগাদ করে ত্বরিত ব্যবস্থা নেওয়া এবং মিথ্যা গুজবের বিপরীতে সত্য তথ্য প্রচারে কার্যকরী ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়।
ভীতি ছড়াচ্ছে বেহাত আগ্নেয়াস্ত্র। গণঅভ্যুত্থান চলাকালে পুলিশের থানা ও ফাঁড়ি থেকে লুট হওয়া বিপুল পরিমাণ অস্ত্র-গোলাবারুদ এখনো উদ্ধার হয়নি, যার মধ্যে ১ হাজার ৩৫০টি আগ্নেয়াস্ত্র এবং ২ লাখ ৫৭ হাজার ৫৭৪টি গোলাবারুদ রয়েছে। সরকার পুরস্কার ঘোষণা করেও উদ্ধারে হিমশিম খাচ্ছে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলো। পুলিশ সদর দপ্তরের অতিরিক্ত ডিআইজি পদমর্যাদার এক কর্মকর্তা বলেছেন, ‘বেহাত অস্ত্র-গোলাবারুদ নিয়ে আমরা ভয়ের মধ্যে আছি। সংসদ নির্বাচনও হুমকি বলে মনে হচ্ছে।’ এসব আগ্নেয়াস্ত্র খুন, চাঁদাবাজি, দখলবাজি, মাদক কারবার, ডাকাতি, ছিনতাই এবং রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগত দ্বন্দ্বে ব্যবহৃত হচ্ছে। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সাবেক মন্ত্রী, এমপি ও প্রভাবশালী নেতাদের বাসা থেকেও লাইসেন্স করা অস্ত্র লুট হয়েছে, যা এখন পেশাদার অপরাধীদের হাতে।
সম্প্রতি দেশজুড়ে আলোচিত বেশ কয়েকটি অপরাধের ঘটনা ঘটেছে। ৭ অক্টোবর খুলনায় ব্যবসায়ী ইমরান মুন্সিকে গুলি করে হত্যা করা হয়। ৫ অক্টোবর কক্সবাজারে ঝিলংজা ইউনিয়ন বিএনপির সাধারণ সম্পাদক লিয়াকত আলী দুর্বৃত্তের গুলিতে আহত হন। ৩০ সেপ্টেম্বর খুলনায় তানভীর হাসান শুভ নামে এক তরুণ গুলিবিদ্ধ হয়ে পরে মারা যান। ১৮ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামে ১০ লাখ টাকা চাঁদা না পেয়ে ঠিকাদার রাজীব চৌধুরীকে গুলি করা হয়। ১৬ সেপ্টেম্বর খুলনা জেলা বিএনপি সদস্য সচিব শেখ আবু হোসেন বাবুর বাড়িতে গুলি ও ককটেল বিস্ফোরণ ঘটে। এর আগে ১৩ আগস্ট চরমপন্থি নেতা শাহাদাত হোসেন এবং ১১ জুলাই বহিষ্কৃত যুবদল নেতা মাহবুবুর রহমান মোল্লাকে খুলনায় হত্যা করা হয়। গত ১৪ মাসে খুলনায় ৩৮টি লাশ পড়েছে। অন্যদিকে, ৪ অক্টোবর নরসিংদীতে চাঁদাবাজির বিরোধিতায় অতিরিক্ত সহকারী এসপি শামিম আনোয়ার সন্ত্রাসীদের হামলায় আহত হন। একই দিনে বগুড়ায় পুলিশের ওপর হামলা চালিয়ে আওয়ামী লীগ নেতা রেজ্জাকুল ইসলামকে ছিনিয়ে নেওয়া হয়। ৭ অক্টোবর ফেনীতে আসামি ধরতে গিয়ে পুলিশের ওপর হামলায় ছয় সদস্য আহত হন এবং অস্ত্র লুট হয়। নরসিংদীতে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে সংঘর্ষে ২৯ সেপ্টেম্বর যুবদল নেতা সাদেক মিয়া, ১৭ সেপ্টেম্বর বিএনপি কর্মী ইদন মিয়া এবং পরদিন ফেরদৌসী বেগম নামে এক নারী নিহত হন। ৭ অক্টোবর চট্টগ্রামে গুলি করে হত্যা করা হয় বিএনপি কর্মী আবদুল হাকিমকে।
অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর পুলিশ পুরো ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। ‘ডেভিল হান্ট’সহ বিভিন্ন অভিযান চললেও ডাকাতি, ছিনতাই, খুন, চাঁদাবাজি, মাদক কেনাবেচা ও পুলিশের ওপর আক্রমণের মতো অপরাধ বেড়েছে। যদিও এসব ঘটনায় আসামি গ্রেপ্তার হচ্ছে এবং আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মী ও পুলিশ কর্মকর্তাদেরও আইনের আওতায় আনা হচ্ছে। তদন্তকারী সংস্থাগুলো ৩০টির বেশি মামলার চার্জশিট দিয়েছে।
পুলিশ সদর দপ্তরের ডিআইজি পদমর্যাদার এক কর্মকর্তা বলেছেন, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ‘মব’ বা উচ্ছৃঙ্খল জনতার ঘটনা তাদের বেশি ভোগাচ্ছে, যদিও তা কিছুটা কমেছে। বৈষম্যবিরোধী অন্দোলনের ঘটনায় দায়েরকৃত মামলাগুলোর তদন্তকাজ অনেকদূর এগিয়েছে এবং পুলিশের মনোবল বাড়াতে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক মন্তব্য করেন, ‘যতক্ষণ লুট হওয়া আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধারের বাইরে থাকবে, ততক্ষণ আইনশৃঙ্খলার জন্য চ্যালেঞ্জও থাকবে। রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর পুলিশের ওপর ও থানায় হামলা, পুলিশকে হেনস্তা করার ঘটনাগুলোর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয়নি। মানুষ দেখছে, পুলিশকে মারধর করলে তেমন কোনো শাস্তি হয় না।’
আইজিপি বাহারুল আলম বলেছেন, ‘আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে আমরা কঠোর পরিশ্রম করছি। যারা পরিস্থিতি ঘোলাটে করার চেষ্টা করছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বিশেষ নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে; সংশ্লিষ্টদের বার্তা দেওয়া হয়েছে।’
