
হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে শনিবারের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডকে নিছক দুর্ঘটনা হিসেবে মানতে নারাজ সংশ্লিষ্টরা। বিমানবন্দরের অভ্যন্তরে আমদানিকৃত পণ্য মজুতের গোডাউন ‘কার্গো ভিলেজ’ সম্পূর্ণ পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়ার এই ঘটনাকে ঘিরে তীব্র হচ্ছে নাশকতার সন্দেহ। গত পাঁচ দিনের ব্যবধানে রাজধানীতে পরপর তিনটি ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের রহস্য এখনো উন্মোচিত না হওয়ায় কেপিআইভুক্ত এমন স্পর্শকাতর এলাকায় আগুনের ঘটনা জনমনে নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। এর পেছনে কোনো চক্রান্ত আছে কি না, তা নিয়ে চলছে ব্যাপক আলোচনা।
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এরই মধ্যে মন্তব্য করেছেন, জনগণ বিশ্বাস করে এসব অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা পূর্বপরিকল্পিত। অন্যদিকে, প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে জানানো হয়েছে, নাশকতা বা অগ্নিসংযোগের প্রমাণ পাওয়া গেলে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
ভয়াবহতার সাত ঘণ্টা
সূত্রমতে, শনিবার বেলা সোয়া ২টার দিকে বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজের কুরিয়ার গোডাউনে আগুনের সূত্রপাত হয়। মুহূর্তের মধ্যে সেই আগুন ইলেকট্রনিক্স গোডাউনে পৌঁছায় এবং কেমিক্যাল গোডাউনে ছড়িয়ে পড়লে তা প্রলয়ংকরী রূপ ধারণ করে। পুরো আমদানি কার্গো ভিলেজ কালো ধোঁয়ার কুণ্ডলীতে ছেয়ে যায়।
আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে ফায়ার সার্ভিস, সেনাবাহিনী, বিজিবি, পুলিশ ও আনসার বাহিনীর সদস্যরা সম্মিলিতভাবে কাজ করেন। ফায়ার সার্ভিস জানায়, বিমানবন্দরের ফায়ার সেকশন ও বিমানবাহিনী প্রথমে কাজ শুরু করে। পরে আশপাশের ১৩টি ফায়ার স্টেশনের ৩৭টি ইউনিট যোগ দেয়। আগুন নেভাতে উন্নত প্রযুক্তির রিমোট কন্ট্রোল ফায়ার ফাইটিং রোবটও ব্যবহার করা হয়, যা ফায়ার সার্ভিসের আধুনিক সংযোজন বলে জানান মিডিয়া সেল কর্মকর্তা তাহলা বিন জসিম।
এই অগ্নিকাণ্ডের ফলে বিমানবন্দরের সকল ফ্লাইট ওঠানামা বন্ধ হয়ে যায়। ঢাকাগামী ফ্লাইটগুলোকে কলকাতা, চট্টগ্রাম ও সিলেটে অবতরণ করানো হয়। আগুনে ফায়ার ফাইটার ও আনসার সদস্যসহ অন্তত ২৫ জন আহত হন, যাদের সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) ও কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। আনসার ও ভিডিপির গণসংযোগ কর্মকর্তা মো. আশিকুজ্জামান জানান, তাদের ১৫ জন সদস্য আহত হয়েছেন।
প্রায় সাত ঘণ্টা চেষ্টার পর রাত ৯টা ১৮ মিনিটে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে বলে ফায়ার সার্ভিসের নিয়ন্ত্রণ কক্ষ জানায়। তবে প্রধান উপদেষ্টার ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে রাত ৮টা ৫৩ মিনিটে আগুন সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আনার কথা জানানো হয়। রাত ৯টা ১৮ মিনিট থেকেই বিমানবন্দরে পুনরায় ফ্লাইট ওঠানামা শুরু হয়।
সমন্বয়হীনতা ও গাফিলতির অভিযোগ
প্রত্যক্ষদর্শী এবং সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টদের বর্ণনায় আগুন লাগার প্রাথমিক পর্যায়ে সমন্বয়হীনতা ও গাফিলতির চিত্র ফুটে উঠেছে। সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট লাকি ট্রান্সপোর্টের কর্মী মোহাম্মদ মোফাজ্জল হোসেন রাব্বি জানান, তার ভাই ২টা ৪৫ মিনিটে তাকে আগুনের খবর দেন, যখন আগুন খুবই সামান্য ছিল এবং সেখানে শুধু আনসার সদস্যরা ছিলেন। তিনি আধা ঘণ্টার মধ্যে এসে দেখেন আগুন কেমিক্যালের গোডাউনে ছড়িয়ে পড়েছে।
সিঅ্যান্ডএফ ব্যবসায়ী মনিরুজ্জামান, যার ৭৯ লাখ টাকার আইসক্রিম ফ্লেবার আগুনে পুড়ে গেছে, ধারণা করছেন কুরিয়ার গোডাউনের স্কাইপো ইন্টারন্যাশনালের এসি বিস্ফোরণ থেকে আগুনের সূত্রপাত হতে পারে।
আব্দুর রহমান নামের এক প্রত্যক্ষদর্শী এবং ঢাকা কাস্টমস এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সহসভাপতি খায়রুল আলম মিঠু গুরুতর অভিযোগ তুলে বলেন, আগুন লাগার এক ঘণ্টা পর সিভিল এভিয়েশন ও ফায়ার সার্ভিসের লোকজন ঘটনাস্থলে আসে। তাদের অভিযোগ, শুরুতে আগুন কম থাকলেও বিমানবন্দরের নিজস্ব ফায়ার স্টেশনের সদস্যদের কাজ করতে দেখা যায়নি।
উপেক্ষিত ছিল পূর্ব সতর্কতা
অগ্নিকাণ্ডের এই ঘটনাকে নিছক দুর্ঘটনা মানতে নারাজ কাস্টমসের কর্মকর্তারাও। নাম প্রকাশ না করার শর্তে কাস্টমসের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, ২০২০ সালে লেবাননের বৈরুত বন্দরে রাসায়নিক বিস্ফোরণের পর ঢাকা কাস্টমস থেকে কার্গো ভিলেজের নিরাপত্তা নিয়ে এনবিআর ও বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষকে একাধিকবার চিঠি দেওয়া হয়েছিল। গত বছরের ডিসেম্বরেও অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকির কথা জানিয়ে চিঠি দেওয়া হয়, কিন্তু কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। তিনি আরও জানান, কার্গো ভিলেজের অবকাঠামো অনেক পুরোনো এবং আগুন মোকাবিলার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা সেখানে ছিল না।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের মহাপরিচালক (ডিজি) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মুহাম্মদ জাহেদ কামালও সমন্বিত ব্যবস্থাপনার ঘাটতির দিকে ইঙ্গিত করেছেন। রাত ১০টার সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, খোলা জায়গা এবং বাতাসের প্রবল গতির কারণে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে বেগ পেতে হয়েছে। ভেতরে খোপ খোপ ভাগ করা এবং বেশিরভাগ পণ্য দাহ্য থাকায় আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। তিনি বলেন, “আমরা একদিকে আগুন নেভালেও অন্যদিকে বাতাসের কারণে আবার জ্বলে উঠছিল।” সাম্প্রতিক ঘনঘন অগ্নিকাণ্ডের বিষয়ে তিনি বলেন, “সমন্বিত উদ্যোগ না হলে এমন দুর্ঘটনা রোধ কঠিন। ফায়ার সার্ভিস একা পারে না, সব সংস্থার যৌথ উদ্যোগ প্রয়োজন।”
অপূরণীয় ক্ষতি, তদন্ত কমিটি গঠন
অগ্নিকাণ্ডের ফলে কী পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে তা তাৎক্ষণিকভাবে নিরূপণ করা যায়নি। তবে সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট খায়রুল আলম মিঠুর মতে, ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কয়েক হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে, কারণ বিমানে জরুরি ও বিলাসবহুল পণ্য আমদানি করা হয়।
নিটপণ্য প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিকেএমইএ) সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, এই আগুন রপ্তানিমুখী শিল্পের জন্য এক অপূরণীয় ক্ষতি। শুধু কাঁচামালই পোড়েনি, অনেক এয়ার শিপমেন্ট শিডিউলে বিপর্যয় ঘটেছে।
শনিবার সন্ধ্যায় বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে জানান, রপ্তানি কার্গো নিরাপদ রয়েছে এবং সরকারের প্রধান লক্ষ্য ফ্লাইট ও কার্গো কার্যক্রম স্বাভাবিক করা।
এদিকে, অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা তদন্তে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স ৭ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেছে। বিমানের ফ্লাইট সেফটি চিফকে প্রধান করে গঠিত এই কমিটিতে মন্ত্রণালয়, বিমান এবং নিরাপত্তারক্ষাকারী বাহিনীর প্রতিনিধিরা রয়েছেন। কমিটিকে পাঁচ কার্যদিবসের মধ্যে অগ্নিকাণ্ডের কারণ, ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ, দায়ীদের চিহ্নিতকরণ এবং প্রতিরোধে সুপারিশমালা জমা দিতে বলা হয়েছে। দেশবাসী এখন এই তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের দিকেই তাকিয়ে আছে—এটি কি স্রেফ অবহেলাজনিত দুর্ঘটনা, নাকি এর পেছনে লুকিয়ে আছে গভীর কোনো ষড়যন্ত্র।
