
বাংলাদেশে বহুল ব্যবহৃত বেশ কয়েকটি অ্যান্টিবায়োটিকের কার্যকারিতা ৯৭ শতাংশ পর্যন্ত হ্রাস পেয়েছে বলে জানিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO)। প্রেসক্রিপশন ছাড়া অবাধ বিক্রি, অপ্রয়োজনীয় ও ভুল প্রয়োগ, ওষুধের কোর্স সম্পূর্ণ না করা এবং খামারে যথেচ্ছ ব্যবহারের কারণে এই জীবন রক্ষাকারী ওষুধগুলো কার্যকারিতা হারাচ্ছে আশঙ্কাজনক হারে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আইন ও হাইকোর্টের নির্দেশনা থাকার পরও অ্যান্টিবায়োটিকের অপব্যবহার রোধ করা যাচ্ছে না। এখনই লাগাম টানা না গেলে সাধারণ সংক্রমণও অচিকিৎসাযোগ্য হয়ে পড়বে এবং দেশ একটি ভয়াবহ স্বাস্থ্য ঝুঁকির মুখে পড়বে।
সোমবার প্রকাশিত WHO-এর ‘গ্লোবাল অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স সার্ভিলেন্স রিপোর্ট ২০২৫’-এ বলা হয়েছে, মারাত্মক সংক্রমণের চিকিৎসায় ব্যবহৃত শক্তিশালী অ্যান্টিবায়োটিক ইমিপেনেমের বিরুদ্ধে ‘অ্যাসিনেটোব্যাকটার এসপিপি’ নামক ব্যাকটেরিয়ার ৯৭ শতাংশ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হয়েছে।
এছাড়া, রক্তপ্রবাহ ও মূত্রনালীর সংক্রমণের জন্য দায়ী ‘ই. কোলাই’ ও ‘ক্লেবসিয়েলা নিউমোনিয়া’ ব্যাকটেরিয়ার ক্ষেত্রে থার্ড জেনারেশন সেফালোস্পোরিন ও ফ্লুরোকুইনলোনসের মতো অ্যান্টিবায়োটিকের প্রতিরোধ ক্ষমতা ৪০ থেকে ৬০ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। প্রতিবেদনে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলে সর্বোচ্চ রেজিস্ট্যান্স হারের দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশকে উল্লেখ করা হয়েছে।
তবে রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা জাকির হোসেন হাবিব ব্যাখা দিয়েছেন যে, বাংলাদেশের নমুনাগুলো টারশিয়ারি হাসপাতাল থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে, যেখানে রেজিস্ট্যান্সের হার সাধারণত বেশি থাকে।
আইন আছে, প্রয়োগ নেই
‘ড্রাগস অ্যান্ড কসমেটিকস অ্যাক্ট, ২০২৩’ অনুযায়ী প্রেসক্রিপশন ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রি নিষিদ্ধ এবং এর ব্যত্যয়ে ২০ হাজার টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে। ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর (ডিজিডিএ) গত দুই বছরে আইন লঙ্ঘনকারীদের কাছ থেকে প্রায় ৮ কোটি টাকা জরিমানা আদায় করেছে বলে জানিয়েছেন অধিদপ্তরের পরিচালক আকতার হোসেন। এছাড়া ২০১৯ সালে হাইকোর্ট অ্যান্টিবায়োটিকের অপব্যবহার বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে সরকারকে নির্দেশ দিয়েছিল। ২০২২ সালে ঔষধ প্রশাসন সব অ্যান্টিবায়োটিক প্যাকেটে লাল চিহ্ন এবং ‘রেজিস্টার্ড চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশন ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না’ সতর্কতা যুক্ত করার নির্দেশ দেয়। কিন্তু বাস্তবে প্রেসক্রিপশন ছাড়াই বিক্রি চলছে এবং অনেক ওষুধের প্যাকেটে এখনও লাল চিহ্ন বা সতর্কতা দেখা যায় না।
বাংলাদেশ কেমিস্ট অ্যান্ড ড্রাগিস্ট সমিতির সাবেক পরিচালক কাজী রফিকুল ইসলাম বলেন, অনেক সময় ক্রেতারাই দোকানদারদের প্রেসক্রিপশন ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রি করতে বাধ্য করেন। এটিকে তিনি ‘সাংস্কৃতিক সমস্যা’ হিসেবেও দেখছেন।
ডিজিডিএ-এর ২০২২ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে, ৬৭.৩ শতাংশ ফার্মেসি বিক্রেতাই অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রির নিষেধাজ্ঞা সম্পর্কে অবগত নন। বাংলাদেশ কেমিস্ট অ্যান্ড ড্রাগিস্ট সমিতির মতে, দেশে লাইসেন্সপ্রাপ্ত ফার্মেসির সংখ্যা প্রায় দেড় লাখ হলেও এর দ্বিগুণ সংখ্যক ফার্মেসি লাইসেন্স ছাড়াই চলছে।
চিকিৎসক ও খামারেও অপব্যবহার
অনেক হাতুড়ে ডাক্তার ও লাইসেন্সবিহীন ফার্মেসি কর্মী কোনো রোগ নির্ণয় ছাড়াই অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের পরামর্শ দেন। এমনকি রেজিস্টার্ড চিকিৎসকরাও প্রায়শই সংবেদনশীলতা পরীক্ষা ছাড়াই অ্যান্টিবায়োটিক লিখে থাকেন বলে অভিযোগ করেন ওয়ান হেলথ বাংলাদেশের ডা. নীতিশ চন্দ্র দেবনাথ। বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি রশিদ-ই-মাহবুব বলেন, “প্রেসক্রিপশনে অ্যান্টিবায়োটিকের অপব্যবহার বন্ধ না করলে, প্রেসক্রিপশন ছাড়া অপব্যবহার বন্ধ করা যাবে না।”
শুধু মানুষ নয়, হাঁস-মুরগির খামারেও অপ্রয়োজনে অ্যান্টিবায়োটিক মেশানো হচ্ছে। শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মো. আনোয়ারুল হক বেগ জানান, মুরগির বৃদ্ধি ত্বরান্বিত করতে সুস্থ মুরগাকেও অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়ানো হচ্ছে, যা প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়ার উত্থানকে উৎসাহিত করছে। বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের ২০২১ সালের এক গবেষণায় ঢাকার বাজার থেকে সংগৃহীত মুরগির নমুনায় ১৭টি অ্যান্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে প্রতিরোধী সালমোনেলা স্ট্রেইন পাওয়া গেছে।
ভবিষ্যৎ শঙ্কা
ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ল্যাবরেটরি মেডিসিন অ্যান্ড রেফারেল সেন্টারের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের প্রধান মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স (এএমআর) তৈরি হলে ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাসের মতো জীবাণুর বিরুদ্ধে ওষুধ কাজ করে না। এর ফলে সাধারণ রোগেও মানুষের মৃত্যু হতে পারে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিদ্যমান আইন শক্তিশালী করার পাশাপাশি এর যথাযথ প্রয়োগ, উন্নত রোগ নির্ণয় ব্যবস্থা, জনসচেতনতা বৃদ্ধি এবং অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার নিরীক্ষার জন্য একটি ক্ষমতাপ্রাপ্ত নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ গঠন জরুরি। দ্রুত পদক্ষেপ না নিলে বাংলাদেশ অ্যান্টিবায়োটিক-পরবর্তী যুগে প্রবেশ করার ঝুঁকিতে রয়েছে, যেখানে সাধারণ সংক্রমণও প্রাণঘাতী হয়ে উঠবে।
