একটি ‘২’ মুছে ফেলার স্পর্ধা আসে কোথা থেকে?


আসুন আজ এক অভাবনীয় প্রতিভার গল্প শোনা যাক। এই ডিজিটাল যুগে আমরা কত কী নিয়ে ভাবি! ভাবি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, ব্লকচেইন, ফিনটেক আর কত শত জটিল প্রযুক্তি নিয়ে। কিন্তু চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (চসিক) রাজস্ব বিভাগের কিছু কর্মকর্তা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন, ওসব জটিলতায় যাওয়ার কোনো দরকারই নেই। দুর্নীতি ও জালিয়াতির শিখরে পৌঁছাতে আপনার শুধু একটি জিনিস দরকার: একটি সাদা ফ্লুইড বা ‘হোয়াইটনার’। হ্যাঁ, ওই যে স্কুলজীবনে আমরা খাতার ভুল ঢাকতে ব্যবহার করতাম, সেই বস্তুটিই এখন হয়ে উঠেছে ৪০ কোটি টাকার জালিয়াতির মূল হাতিয়ার। একেই বলে ‘মিনিমালিজম’ বা অল্প উপাদানে অসাধ্য সাধন!

ঘটনাটি বুঝতে, আপনাকে কোনো রকেট সায়েন্স বুঝতে হবে না, শুধু এক থেকে দশ পর্যন্ত গুনতে পারলেই চলবে। বিশেষ করে ‘দুই’ সংখ্যাটির ওপর আপনার বিশেষ দখল থাকতে হবে। কারণ চসিকের রাজস্ব বিভাগের প্রতিভাবান কর্মকর্তারা এই এক ‘২’ সংখ্যাটিকেই তাদের শিল্পকর্মের প্রধান লক্ষ্যবস্তু বানিয়েছিলেন। তাদের শৈল্পিক ছোঁয়ায় দুটি কনটেইনার ডিপোর বার্ষিক কর মূল্যায়নের খাতা থেকে ‘২’ সংখ্যাটি স্রেফ উবে গেছে। যেন ডেভিড কপারফিল্ডের কোনো জাদুর প্রদর্শনী চলছে। আর এই জাদুর ফলে চসিকের কোষাগার থেকে হাওয়া হয়ে গেছে প্রায় ৪০ কোটি টাকা।

এই যুগান্তকারী দুর্নীতির খবর পেয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) আর স্থির থাকতে পারেনি। তারা হয়তো ভেবেছিল, এমন প্রতিভার মূল্যায়ন না করলে জাতি তাদের ক্ষমা করবে না। তাই গত ২৩ অক্টোবর, বৃহস্পতিবার, দুদকের একটি দল চসিকে অভিযান চালায়। বলাই বাহুল্য, সেখানে গিয়ে তারা যা দেখেছেন, তাতে তাদের আক্কেলগুড়ুম। দুদকের সহকারী পরিচালক সায়েদ আলম যা বলেছেন, তা শুনে মনে হচ্ছে তিনি কোনো পরাবাস্তব সিনেমার চিত্রনাট্য পড়ছেন। তিনি নিশ্চিত করেছেন, নথি ‘ঘষামাজা’ করা হয়েছে। একটি নিরীহ ‘২’ সংখ্যাকে কী নির্মমভাবে বিলুপ্ত করা হয়েছে! সায়েদ আলম জানিয়েছেন, এতে দুই প্রতিষ্ঠানেরই ২০ কোটি টাকা করে গৃহকর কমে গেছে। তারা এই ‘শিল্পকর্মের’ প্রমাণ পেয়েছেন এবং মূল্যবান নথিগুলো (সম্ভবত সেই ঐতিহাসিক ফ্লুইড মাখানো কাগজ) জব্দ করেছেন।

এবার আসুন, সেই ভাগ্যবান প্রতিষ্ঠান দুটির সাথে পরিচিত হই। একটি হলো মধ্যম হালিশহরের এছাক ব্রাদার্স ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড এবং অন্যটি পতেঙ্গার লালদিয়া চরের ইনকনট্রেড লিমিটেড। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে চসিক এই দুই প্রতিষ্ঠানের জন্য বার্ষিক কর নির্ধারণ করেছিল যথাক্রমে ২৬ কোটি ৩৮ লাখ এবং ২৫ কোটি ৬৭ লাখ টাকা। অংকগুলো দেখতে বেশ বড় এবং কর্কশ, তাই না? রাজস্ব বিভাগের শিল্পমনা কর্মকর্তারা হয়তো ভেবেছিলেন, এই অংকগুলো শ্রুতিমধুর নয়। তাই তারা রিভিউ বোর্ডের শুনানির সময় আসরে নামলেন।

ভাবুন সেই ঐতিহাসিক মুহূর্তের কথা। ইনকনট্রেড লিমিটেডের শুনানি হলো ২০২০ সালের ২৪ ডিসেম্বর, আর এছাক ব্রাদার্স ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের পালা আসলো ২০২১ সালের ১৩ জুন। হয়তো কোনো এক কর্মকর্তা ভাবগম্ভীর মুখে বললেন, “স্যার, এই ২৬ কোটি ৩৮ লাখ অংকটার মধ্যে প্রথম ‘২’ সংখ্যাটা কেমন যেন বেমানান লাগছে। এটা বাদ দিলে অংকটা অনেক বেশি সুন্দর দেখায়।” ব্যস! যেমন ভাবা তেমন কাজ। ঘ্যাঁচ করে ‘২’ মুছে দেওয়া হলো। ২৬ কোটি হয়ে গেল ৬ কোটি। ২৫ কোটি হয়ে গেল ৫ কোটি। কী চমৎকার সরলীকরণ! গণিতকে এত সহজ করে ফেলার জন্য এই কর্মকর্তাদের নোবেল পুরস্কার দেওয়া উচিত।

অবশ্য, আপনি ভাবতে পারেন, এত বড় একটা ‘টাইপো’ কেউ ধরতে পারলো না? এখানেই তো সিস্টেমের সৌন্দর্য। একটা ‘২’ মুছতে ২০১৭-১৮ অর্থবছর থেকে ২০২০-২১ সাল পর্যন্ত সময় লেগেছে। এই দীর্ঘ সময়ে হয়তো ফ্লুইড শুকানো, তার ওপর আবার কলম দিয়ে ঘষামাজা করা, ফাইলটাকে একটু পুরোনো দেখানো—কত কাজ! এসব সূক্ষ্ম শিল্পকর্ম তো আর একদিনে হয় না।

তবে চসিকও একেবারে ছেড়ে দেওয়ার পাত্র নয়। তারা বলেছে, এই ঘটনা তাদের ‘অভ্যন্তরীণ তদন্তেও’ ধরা পড়েছে। কী দারুণ! নিজেদের ঘরের মধ্যে এত বড় ‘সাদা হাতি’ ঘুরে বেড়াচ্ছিল, সেটা তারা এতদিনে টের পেয়েছেন। চসিকের সচিব মোহাম্মদ আশরাফুল আমিন জানিয়েছেন, প্রতিবেদন হাতে পেয়েই তারা ব্যবস্থা নিয়েছেন। এখন প্রশ্ন হলো, দুদক অভিযান চালানোর আগে সেই অভ্যন্তরীণ তদন্তের প্রতিবেদনটি কোথায় ছিল? মোহাম্মদ আশরাফুল আমিন অবশ্য স্বীকার করেছেন, দুদক তাদের কাছ থেকে সেই তদন্ত প্রতিবেদনটি নিয়েছে।

ব্যবস্থা যে নেওয়া হয়েছে, সেটাও বেশ চমকপ্রদ। এই ‘সৃজনশীল’ কাজের জন্য রাজস্ব বিভাগের দুই কর্মকর্তাকে—কর কর্মকর্তা নুরুল আলম এবং উপকর কর্মকর্তা জয় প্রকাশ সেনকে—সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। আর তাদের এই শিল্পকর্মে তুলি এগিয়ে দেওয়ার অভিযোগে তিন হিসাব সহকারী—মঞ্জুর মোর্শেদ, রূপসী রাণী দে এবং আহসান উল্লাহকে—দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিয়ে সোজা সচিবালয় বিভাগে সংযুক্ত করা হয়েছে। আহা! কী কঠিন শাস্তি! সচিবালয় বিভাগে সংযুক্ত করা মানে তো প্রায় ‘ডেস্কে বসিয়ে বেতন দেওয়া’। হয়তো তাদের এই অবসরে নতুন নতুন জালিয়াতির কৌশল উদ্ভাবনের জন্য পাঠানো হয়েছে। কে জানে, পরের বার হয়তো তারা ‘২’ না মুছে পুরো অংকটাই অদৃশ্য করে দেওয়ার কালি আবিষ্কার করে ফেলবেন!

অবাক কাণ্ড! দুর্নীতিকে এরা কোন উচ্চতায় নিয়ে গেছে! মনে হয় দুর্নীতিবাজরা একেকজন মহা প্রতিভাবান। একটি দেশের সরকারি দপ্তরে বসে, হোল্ডিং ট্যাক্সের ফিল্ডবুকে, সাদা ফ্লুইড দিয়ে ঘষে ঘষে ‘২’ মুছে ফেলা হচ্ছে—এটা কোনো সাধারণ দুর্নীতি নয়, এটা হলো ‘ন্যাক্কারজনক শৈল্পিকতা’।

দুদকের কর্মকর্তারা এখন বলছেন, এটি ফৌজদারি অপরাধ এবং তারা মামলা করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। আমরাও অপেক্ষায় রইলাম সেই মামলার ফলাফল দেখার জন্য। তবে ইতিহাস বলে, এসব ক্ষেত্রে প্রায়ই দেখা যায়, মূল হোতারা পর্দার আড়ালেই থেকে যান, আর এই নুরুল আলম, জয় প্রকাশ সেন, মঞ্জুর মোর্শেদ, রূপসী রাণী দে বা আহসান উল্লাহদের মতো চুনোপুঁটিরা ‘সাময়িক বরখাস্ত’ বা ‘সচিবালয়ে সংযুক্ত’ হয়েই পার পেয়ে যান।

এই ঘটনাটি আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে আরও একটি বিষয় দেখিয়ে দেয়, একটি সমাজে যখন বড় বড় দুর্নীতি, মেগা প্রকল্পে মেগা দুর্নীতি কোনো ধরনের বাধা ছাড়াই চলতে থাকে, তখন ছোট ও মাঝারি পর্যায়ের দুর্নীতিবাজরা অতিমাত্রায় উৎসাহী হয়ে ওঠেন। তারা দুর্নীতির নতুন নতুন ‘স্টার্টআপ’ আইডিয়া নিয়ে কাজ শুরু করেন। গত এক দশকে বা তারও বেশি সময় ধরে দুর্নীতির যে মহোৎসব চলেছে, তাতে দুদককেও আমরা অনেক সময় বিতর্কিত ভূমিকায় দেখেছি। যখন রক্ষক নিজেই ভক্ষকের সাথে আপস করে, তখন এমন ‘ফ্লুইড-দুর্নীতি’ তো ঘটতেই পারে।

একটা দুর্নীতিপ্রবণ সমাজ থেকে রাতারাতি দুর্নীতি দূর করা হয়তো সম্ভব নয়। কিন্তু চসিকের এই ঘটনা একটা ‘টেস্ট কেস’ হতে পারে। সরকারকে সত্যিই যদি দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ দেখাতে হয়, তবে এই ‘২’ মুছে ফেলার কারিগরদের এবং তাদের পেছনের সুবিধাভোগী প্রতিষ্ঠান দুটিকেও কঠোর শাস্তির আওতায় আনতে হবে। শুধু বরখাস্ত বা সংযুক্তিকরণ নয়, এই ৪০ কোটি টাকা তাদের কাছ থেকে আদায় করতে হবে।

তা না হলে, ভবিষ্যতে আমরা হয়তো দেখব, কোনো কর্মকর্তা করের খাতা থেকে শুধু ‘২’ নয়, ‘শূন্য’ (০) মুছে দিচ্ছেন। কারণ শূন্য মুছে দিলে অংকের মূল্য আরও কমে যায়। কে জানে, হয়তো এই প্রতিভাবানরা একদিন পুরো খাতাটাই সাদা ফ্লুইড দিয়ে মুছে দিয়ে বলবেন, “কই, কোনো কর তো বকেয়াই নেই!”

লেখক : ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, একুশে পত্রিকা।