দুদকের ‘হাত’ শক্তিশালী হচ্ছে, তদন্ত ছাড়াই মামলার ক্ষমতা


দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) কিছু পরিস্থিতিতে প্রাথমিক তদন্ত ছাড়াই মামলা দায়ের এবং সরকারি কর্মকর্তাদের পূর্বানুমতি ছাড়াই গ্রেপ্তারের ক্ষমতা দেওয়া হচ্ছে। একইসঙ্গে বাংলাদেশে বসবাসরত বিদেশি নাগরিকদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তদন্তের কর্তৃত্বও পেতে যাচ্ছে সংস্থাটি। “দুর্নীতি দমন কমিশন (সংশোধন) অধ্যাদেশ ২০২৫”-এর খসড়াটি গত ২৩ অক্টোবর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে নীতিগতভাবে অনুমোদিত হয়েছে। দুদক কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এই সংশোধনের লক্ষ্য হলো দুর্নীতিবিরোধী সংস্থাটির কর্তৃত্ব ও অপারেশনাল পরিধি শক্তিশালী করা।

খসড়ায় ২০০৪ সালের দুর্নীতি দমন আইনের ২০ ধারা সংশোধনের প্রস্তাব করা হয়েছে। এর ফলে দুদক সদরদপ্তরের অনুমোদন সাপেক্ষে, সনাক্তযোগ্য ব্যক্তির কাছ থেকে প্রাপ্ত সুনির্দিষ্ট লিখিত তথ্যের ভিত্তিতে কমিশন মামলা দায়ের করতে পারবে। সংশোধনীতে আরও বলা হয়েছে, কোনো বিচারিক আদেশ, প্রশাসনিক যোগাযোগ বা সরকারি কিংবা সংবিধিবদ্ধ সংস্থার তদন্তে অপরাধের প্রমাণ প্রতিষ্ঠিত হলে, সেক্ষেত্রে কমিশনের পক্ষ থেকে যাচাই বা প্রাথমিক তদন্তের প্রয়োজন হবে না।

এই খসড়ায় ২০০৪ সালের আইনের ৩২ (ক) ধারা বিলুপ্ত করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এর ফলে বিচারক, ম্যাজিস্ট্রেট এবং সরকারি কর্মচারীদের দুর্নীতির অভিযোগে মামলা বা গ্রেপ্তারের জন্য সরকারের পূর্বানুমতির বাধ্যবাধকতা দূর হবে।

আইনের ২ ধারা সংশোধন করে ‘জ্ঞাত আয়’-কে ‘বৈধ আয়’ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। ধারা ৪-এ একটি নতুন বিধান যুক্ত করে দুর্নীতির বিচার ত্বরান্বিত করতে প্রতিটি জেলায়, যেখানে দুদকের কার্যক্রম রয়েছে, একাধিক বিশেষ জজ আদালত প্রতিষ্ঠার ক্ষমতা সরকারকে দেওয়া হচ্ছে। খসড়াটি বাংলাদেশে বসবাসরত বিদেশি নাগরিকদেরও দুদকের এখতিয়ারের আওতায় আনছে।

প্রস্তাবিত ৫ ধারা অনুযায়ী, কমিশন তিনজন কমিশনার নিয়েই গঠিত হবে, তবে তাদের মধ্যে অন্তত একজন নারী কমিশনার থাকা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। কমিশনারদের মেয়াদ পাঁচ বছর থেকে কমিয়ে চার বছর করার প্রস্তাব করা হয়েছে।

আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠতম বিচারপতির নেতৃত্বে সাত সদস্যের একটি বাছাই কমিটি কমিশনার নিয়োগের জন্য নাম সুপারিশ করবে। এই কমিটিতে প্রধান বিচারপতি মনোনীত একজন নারী বিচারপতি, মহা হিসাব-নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক, সরকারি কর্ম কমিশন বা জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যান, স্পিকার মনোনীত শাসক ও বিরোধী দলের দুজন সংসদ সদস্য এবং রাষ্ট্রপতি মনোনীত কমপক্ষে ১৫ বছরের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন একজন দুর্নীতি দমন বা সুশাসন বিশেষজ্ঞ থাকবেন। কমিটি প্রকাশ্য বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে প্রার্থীদের নির্বাচন করবে, সাক্ষাৎকার নেবে এবং সংক্ষিপ্ত তালিকাভুক্ত ছয়টি নাম রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠাবে, যেখান থেকে রাষ্ট্রপতি চেয়ারম্যান ও দুই কমিশনারকে নিয়োগ দেবেন।

খসড়ায় ২০(১) ধারা সংশোধন করে যৌক্তিক কারণে তদন্তের সময়সীমা বিদ্যমান ১২০ দিনের বাইরে আরও ৬০ দিন বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। এতে ‘আন্ডারকাভার ইনকোয়ারি’ (গোপন অনুসন্ধান) নামে একটি বিধান যুক্ত করা হয়েছে, যা দুদকের কর্মীদের পরিচয় গোপন রেখে প্রমাণ সংগ্রহ ও দুর্নীতি উদঘাটনের সুযোগ দেবে। তবে, খসড়াটিতে বিদ্যমান আইনের ২১ ধারা বাতিলের প্রস্তাব করা হয়েছে, যা কমিশনকে আদালতের আদেশে স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির তথ্যের ভিত্তিতে যে কাউকে গ্রেপ্তারের ক্ষমতা দিয়েছিল।

দুদক সংস্কার কমিশনের প্রধান এবং ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, খসড়া অধ্যাদেশটি বিদ্যমান আইনের চেয়ে উন্নততর সংস্করণ। “তবে, দুদক সংস্কার কমিশনের করা কিছু কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ সতর্কতার সাথে উপেক্ষা করা হয়েছে।” তিনি বলেন, “বিশেষ করে, কমিশনে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা এবং এর জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে ‘বাছাই ও পর্যালোচনা কমিটি’ গঠনের সুপারিশটি বাদ দেওয়া হয়েছে।”

ইফতেখারুজ্জামান বলেন, কমিশনারদের সংক্ষিপ্ত তালিকা জনসমক্ষে প্রকাশের বিধান সরকার বাদ দিয়েছে এবং দুদকের ষান্মাসিক কর্মক্ষমতা পর্যালোচনার বিধানটিও সম্পূর্ণ বাদ দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, কমিশনারের সংখ্যা তিন থেকে বাড়িয়ে পাঁচ করার সুপারিশও উপেক্ষা করা হয়েছে। “এগুলো এমন সুপারিশ ছিল যাতে প্রায় শতভাগ রাজনৈতিক দলের সম্মতি মিলেছিল। সরকার একতরফাভাবে সেগুলো প্রত্যাখ্যান করেছে, কারণ দৃশ্যত সরকারের কিছু মহলের ভিন্ন মত রয়েছে।”

তিনি আরও যোগ করেন, “জুলাই অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা পূরণে সংস্কার কমিশন গঠন এবং সংস্কার প্রস্তাবের ওপর জাতীয় ঐকমত্য চাওয়া একটি সরকারের কাছ থেকে এটি হতাশাজনক এবং সংস্কারবিরোধী উদাহরণ।”

খসড়া অধ্যাদেশটি নীতিগত অনুমোদনের পর আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল এক প্রেস ব্রিফিংয়ে বলেন, খসড়া অধ্যাদেশটি দুদকের সক্ষমতা জোরদার করতে বেশ কিছু নতুন সংজ্ঞা ও প্রক্রিয়া যুক্ত করেছে। তিনি আশা প্রকাশ করেন যে এই সংশোধনী কমিশনের কার্যক্রমে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও দক্ষতা বৃদ্ধি করবে, তবে অধ্যাদেশ চূড়ান্ত করার আগে অভ্যন্তরীণ জবাবদিহিতা জোরদার করার ওপর গুরুত্বারোপ করেন।

এর আগে, ২০২৪ সালের অক্টোবরে অন্তর্বর্তী সরকার দুদক সংস্কার কমিশন গঠন করেছিল, যা গত ১৫ জানুয়ারি প্রধান উপদেষ্টার কাছে সুপারিশ জমা দেয়।