অস্বচ্ছতা দূর করতে সুপ্রিম কোর্টের ‘সার্ভিস রুলস’ অস্ত্র


সুপ্রিম কোর্টের একজন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) সম্প্রতি তাঁর একটি অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা করছিলেন। একটি গুরুত্বপূর্ণ মামলার শুনানির তারিখ এগিয়ে আনার জন্য তিনি সরাসরি সংশ্লিষ্ট বেঞ্চে আবেদন করেন এবং আদালত তা মঞ্জুর করেন। কিন্তু সেই আদেশটি সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসনের এক শাখা থেকে আরেক শাখায় যেতে এবং অবশেষে দৈনিক কার্যতালিকা (কজলিস্ট) শাখায় প্রতিফলিত হতে তিন দিন সময় লেগে যায়। এই প্রতিবেদকের সাথে কথা বলার সময় তিনি আক্ষেপ করে বলেন, “বিচারকাজ এখন অনেক দ্রুত, মাননীয় বিচারপতিরা অত্যন্ত আন্তরিক। কিন্তু ফাইলটি একবার প্রশাসনের ‘সিস্টেমে’ ঢুকে গেলে, সেটি কোথায় আছে, কেন দেরি হচ্ছে—তা বের করতে আমাদের মতো সিনিয়রদেরও ঘাম ছুটে যায়। এটি একটি অস্বচ্ছ ‘ব্ল্যাক বক্স’-এর মতো।”

এই আইনজীবীর অভিজ্ঞতা বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়। ২০২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থানের পর যখন বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিয়ে দেশব্যাপী এক ঐতিহাসিক ঐকমত্য তৈরি হয়েছে, তখন খোদ আইনজীবী ও সংস্কারকদের মধ্য থেকেই একটি নতুন প্রশ্ন জোরালো হচ্ছে। প্রশ্নটি হলো: নির্বাহী বিভাগ থেকে স্বাধীনতা অর্জনই কি যথেষ্ট? বিচার বিভাগের নিজস্ব প্রশাসনিক কাঠামো, বিশেষত সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন কি সেই স্বাধীনতার সাথে তাল মিলিয়ে স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক হতে পেরেছে?

সংস্কার প্রক্রিয়ার গভীরে প্রবেশ করলে দেখা যায়, লড়াইটি এখন আর কেবল ‘নির্বাহী বিভাগ বনাম বিচার বিভাগ’ নয়; বরং লড়াইটি একটি অস্বচ্ছ ‘অ্যানালগ মানসিকতা’ বনাম একটি স্বচ্ছ ‘প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা’ প্রবর্তনের। এই অনুসন্ধানটি সেইসব সংবেদনশীল কিন্তু জরুরি প্রশ্নগুলোরই উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছে, যার জন্য এই প্রতিবেদককে মাসখানেক ধরে সুপ্রিম কোর্ট অঙ্গন, আইনজীবী সমিতি এবং সংস্কার প্রক্রিয়ার সাথে যুক্ত একাধিক ব্যক্তির দ্বারস্থ হতে হয়েছে।

ভেতর থেকেই ওঠা স্বচ্ছতার প্রশ্ন

স্বাধীনতার ‘গোল্ডেন আওয়ার’-এ দাঁড়িয়েও বিচার বিভাগের অভ্যন্তরীণ প্রশাসন নিয়ে যে প্রশ্নগুলো উঠছে, তা কোনো বিচ্ছিন্ন সমালোচনা নয়। বরং এই প্রশ্নগুলো তুলছেন সেইসব ব্যক্তিরাই, যাঁরা বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের সদস্য বা সংস্কার প্রক্রিয়ার ঘনিষ্ঠ অংশীজন।

ব্লাস্টের সেমিনারে আইনজীবীদের উদ্বেগ: গত ২৮ এপ্রিল, ২০২৫-এ বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট) আয়োজিত ‘বিচারব্যবস্থা সংস্কার ও জরুরি করণীয়’ শীর্ষক এক মতবিনিময় সভার (যার কার্যবিবরণী এই প্রতিবেদকের হাতে এসেছে) আলোচনাগুলো ছিল খুবই স্পষ্ট। সেই সভায় খোদ বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের অন্যতম সদস্য, আইনজীবী তানিম হোসেইন শাওন, যে বক্তব্য দিয়েছিলেন তা ছিল বিস্ফোরক।

তাঁর মতে, “সুপ্রিম কোর্টের প্রশাসন সবচেয়ে বেশি অস্বচ্ছ এবং জবাবদিহিহীন একটা জায়গা।” তিনি অভিযোগ করেন, কীভাবে বেঞ্চ পুনর্গঠন হয়, তা জানা যায় না এবং এমন ছোটখাটো সংস্কার, যার জন্য সংবিধান বা আইন সংশোধনেরও প্রয়োজন নেই, সেগুলোও শুধু প্রশাসনিক সদিচ্ছার অভাবে আটকে আছে।

আইনজীবী রেহানা বেগম এই প্রশাসনিক অস্বচ্ছতাকে নারী আইনজীবী ও বিচারপ্রার্থীদের জন্য একটি বড় বাধা হিসেবে দেখেন। তিনি মনে করেন, যখন বেঞ্চ গঠন, মামলার কার্যতালিকা চূড়ান্তকরণ বা ফাইল মুভমেন্টের প্রক্রিয়াটি একটি ‘ব্ল্যাক বক্স’-এর মতো অস্বচ্ছ থাকে, তখন নারী আইনজীবীদের জন্য পেশাগতভাবে সমান সুযোগ পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। রেহানা বেগম বলেন, “এই অস্বচ্ছ ব্যবস্থাটি অনেক সময়ই একটি ‘ওল্ড বয়েজ নেটওয়ার্ক’-এর মতো কাজ করে। নারী আইনজীবীদের, বিশেষত যারা নতুন, তাদের ফাইল সঠিক বেঞ্চে বা সঠিক সময়ে শুনানির জন্য তোলা প্রায়শই কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। এটি নারী বিচারপ্রার্থীদেরও ক্ষতিগ্রস্ত করে, কারণ প্রশাসনিক অস্বচ্ছতার সুযোগে প্রতিপক্ষ মামলার প্রক্রিয়াগত বিলম্ব ঘটাতে পারে।”

মাসদার হোসেনের ‘মানসিকতা’র প্রশ্ন: এই সমালোচনার সুর আরও গভীরে পাওয়া যায় খোদ ‘মাসদার হোসেন মামলা’র কিংবদন্তি বাদী এবং বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের আরেক সদস্য, মো. মাসদার হোসেনের পর্যবেক্ষণে। তিনি দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বলেন, “বিচার বিভাগ পৃথক্‌করণের আসল কাজটাই হয়নি… বাধা মানসিকতা।” তাঁর মূল্যায়নে, নিয়ন্ত্রণ শুধু এক হাত থেকে আরেক হাতে যাচ্ছে। তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন, নিয়ন্ত্রণ আইন মন্ত্রণালয় থেকে সুপ্রিম কোর্টের নিজস্ব প্রশাসনের (রেজিস্ট্রি) হাতে এলেও, সেই প্রশাসন যদি নিজেই অস্বচ্ছ ও জবাবদিহিহীন থাকে, তবে সাধারণ বিচারকের জন্য পরিস্থিতি বদলাবে না। এটি নিছক “নিয়ন্ত্রণের রূপবদল” হতে পারে।

সংস্কার কমিশনের একাধিক সদস্য এবং জ্যেষ্ঠ আইনজীবীদের সাথে এই প্রতিবেদকের ধারাবাহিক আলোচনায় এটি স্পষ্ট যে, বিচারকদের বদলি, পদোন্নতি এবং কোর্ট প্রশাসনের ফাইল ব্যবস্থাপনায় একটি উল্লেখযোগ্য অংশের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে অস্বচ্ছতা ও ‘অ্যানালগ সিস্টেম’-এর প্রতি এক ধরনের নির্ভরতা তৈরি হয়েছে।

‘আত্ম-শুদ্ধি’র পথে বিচার বিভাগ

এই কঠোর আত্ম-সমালোচনা এবং অভ্যন্তরীণ পর্যবেক্ষণগুলো এই সংস্কার প্রক্রিয়ার সবচেয়ে শক্তিশালী দিক। কারণ, আমাদের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, বিচার বিভাগ এই সমালোচনাকে অগ্রাহ্য না করে, বরং নীরবে এর সমাধানে অত্যন্ত সুনির্দিষ্ট ও দীর্ঘমেয়াদী প্রাতিষ্ঠানিক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে।

স্বাধীনতার অর্থ যে কেবল ক্ষমতা নয়, বরং সেই ক্ষমতার সাথে আসা গুরুদায়িত্ব ও জবাবদিহিতা—তা নিশ্চিত করতেই বিচার বিভাগ ‘আত্ম-শুদ্ধি’র এক কঠিন পথে নেমেছে। এর প্রধান দুটি অস্ত্র হলো: পুনরুজ্জীবিত সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল এবং নতুন সার্ভিস রুলস।

পদক্ষেপ ১: পুনরুজ্জীবিত সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল (এসজেসি): প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদ তাঁর ২০২৪ সালের ২১ সেপ্টেম্বরের রোডম্যাপেই বিচারকদের জবাবদিহিতার বিষয়টিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেন। ষোড়শ সংশোধনীর রায়ের পর্যালোচনার (রিভিউ) দ্রুত নিষ্পত্তির মাধ্যমে তিনি সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলকে (এসজেসি) বিচার বিভাগের অভ্যন্তরীণ জবাবদিহিতার সর্বোচ্চ ফোরাম হিসেবে পুনরুজ্জীবিত করেছেন।

প্রধান বিচারপতি নিজে ইন্টারন্যাশনাল বার অ্যাসোসিয়েশনের ওয়েবিনারে (১৪ মে, ২০২৫), যার অডিও রেকর্ড এই প্রতিবেদকের কাছে সংরক্ষিত আছে, বলেছেন, “…সুপ্রিম কোর্ট… সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলকে কার্যকর করেছে, [এটি] এমন একটি স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা যা নির্বাহী বিভাগের প্রভাব থেকে সম্পূর্ণরূপে মুক্ত হয়ে… বিচারক অপসারণের একচ্ছত্র ক্ষমতা রাখে।” এটি বিচার বিভাগের ভেতরে একটি স্পষ্ট বার্তা দিয়েছে যে, অদক্ষতা বা অসদাচরণের ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠান নিজেই ব্যবস্থা গ্রহণে সক্ষম।

পদক্ষেপ ২: ‘লিখিত বিধানে’ অবসান হচ্ছে অস্বচ্ছতার: যে অস্বচ্ছ বদলি ও পদোন্নতি নিয়ে মো. মাসদার হোসেন এবং আইনজীবী তানিম হোসেইন শাওন উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন, ঠিক সেই বিষয়গুলোতেই শৃঙ্খলা আনতে দুটি ঐতিহাসিক বিধিমালা গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়েছে।

এই সমালোচনার জবাবে বিচার বিভাগ কী পদক্ষেপ নিয়েছে, তা বুঝতে হলে আমাদের তাকাতে হবে গত ২৮ জুলাই, ২০২৫-এ গেজেট আকারে প্রকাশিত দুটি ঐতিহাসিক বিধিমালার দিকে। এই প্রতিবেদক দুটি বিধিমালাই (যথা: ‘বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিস গঠন বিধিমালা, ২০২৫’ এবং ‘আইন ও বিচার বিভাগে পদায়ন বিধিমালা, ২০২৫’) পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিশ্লেষণ করেছে।

বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিস গঠন বিধিমালা, ২০২৫: এই বিধিমালাটি জুডিশিয়াল সার্ভিসকে একটি স্বতন্ত্র সার্ভিস হিসেবে পূর্ণাঙ্গ সাংবিধানিক রূপ দিয়েছে।

আইন ও বিচার বিভাগে পদায়ন বিধিমালা, ২০২৫: এই বিধিমালাটি আরও গুরুত্বপূর্ণ। অতীতে আইন মন্ত্রণালয়ে প্রেষণে (ডেপুটেশন) পদায়ন ছিল অত্যন্ত লাভজনক এবং অস্বচ্ছ একটি প্রক্রিয়া। এই প্রতিবেদকের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, এই বিধিমালাটি প্রেষণে পদায়নের জন্য সুনির্দিষ্ট যোগ্যতা (যেমন: ২১ বছরের অভিজ্ঞতা, মেধা ও দক্ষতা) এবং পদের পদক্রম লিখিতভাবে নির্দিষ্ট করে দিয়েছে।

আইন অঙ্গনের একাধিক বিশেষজ্ঞ এবং সাবেক বিচারকদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, এই দুটি বিধিমালা বিচারকদের সার্ভিস গঠন, নিয়োগ, এবং বিভিন্ন পদে পদায়নের ক্ষেত্রে প্রথমবারের মতো একটি সুস্পষ্ট, লিখিত এবং বস্তুনিষ্ঠ কাঠামো প্রদান করেছে। এর ফলে অতীতে ‘পছন্দ-অপছন্দ’-এর ভিত্তিতে বদলি বা পদোন্নতির যে অভিযোগ ছিল, তা বন্ধ হওয়ার একটি টেকসই প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি তৈরি হলো। এটিই মাসদার হোসেনের চিহ্নিত ‘মানসিকতা’ পরিবর্তনের আইনি হাতিয়ার।

স্বাধীনতার সাথে আসছে জবাবদিহিতা

এই অনুসন্ধান এবং উভয় পক্ষের (সমালোচক ও সংস্কারক) মতামত পর্যালোচনা করে এটি স্পষ্ট যে, স্বাধীনতার প্রকৃত অর্থ হলো ‘স্বচ্ছতা’। নির্বাহী বিভাগ থেকে পৃথক্‌করণ ছিল স্বাধীনতার প্রথম ধাপ, কিন্তু বিচারিক স্বাধীনতার চূড়ান্ত রূপ আসবে নিজস্ব প্রশাসনের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার মাধ্যমে।

তানিম হোসেইন শাওনের মতো আইনজীবীদের তোলা “অস্বচ্ছতার” অভিযোগ এবং মো. মাসদার হোসেনের “মানসিকতা” পরিবর্তনের আহ্বান—এই সংস্কার প্রক্রিয়ার জন্য হুমকি নয়, বরং এটি এই প্রক্রিয়ার ‘অ্যান্টিবডি’ হিসেবে কাজ করছে।

বিচার বিভাগ এই সমালোচনাকে ধারণ করেছে এবং ‘সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল’ ও ‘নতুন সার্ভিস রুলস’ প্রণয়নের মাধ্যমে প্রমাণ করেছে যে, এটি একটি পরিণত প্রতিষ্ঠান, যা ‘আত্ম-শুদ্ধি’-এ সক্ষম।

প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদ যেমনটি তাঁর বরিশালের ভাষণে পুনরায় জোর দিয়ে বলেছেন, “…আমরা এমন একটি বিচার ব্যবস্থা চাই যা স্বচ্ছ, দক্ষ, স্বাধীন এবং জবাবদিহিমূলক।”

এই নতুন বিধিমালা এবং পুনরুজ্জীবিত সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল সেই জবাবদিহিতারই আইনি ভিত্তি। এই ‘গোল্ডেন আওয়ার’-এ দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ দেখছে, বিচার বিভাগ কেবল নির্বাহী বিভাগ থেকে স্বাধীনতা অর্জন করছে না, বরং একটি স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক প্রতিষ্ঠান হিসেবে নিজেকে নতুন করে গড়ে তুলছে—যা তার স্বাধীনতার চেয়েও বড় অর্জন।

মূল প্রতিবেদন: ৪৫ লক্ষ মামলার জট: আইনি সংস্কার কি পারবে ‘তারিখ’ সংস্কৃতি বদলাতে?

পার্শ্ব প্রতিবেদন: ‘অ্যানালগ’ স্বার্থের কাছে জিম্মি ডিজিটাল বিচার?