রাজনীতির নামে অস্ত্রবাজি, পুলিশের নিষ্ক্রিয়তায় বাড়ছে নিরাপত্তাহীনতা

গুলি করে হত্যা
চট্টগ্রাম নগরে তুচ্ছ এক ব্যানার ছেঁড়াকে কেন্দ্র করে মো. সাজ্জাদ নামে ২২ বছর বয়সী এক ছাত্রদল কর্মীর হত্যাকাণ্ড নিছক একটি রাজনৈতিক সংঘাতের খতিয়ান নয়, এটি একটি শহরের আইনশৃঙ্খলার কফিনে ঠুকে দেওয়া আরও একটি পেরেক। এই ঘটনা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, রাজনৈতিক সংঘাত এখন আর রাজপথের স্লোগান বা আদর্শিক বিতর্কে সীমাবদ্ধ নেই, তা সরাসরি আগ্নেয়াস্ত্রের ভাষায় কথা বলছে। আরও ভয়াবহ সত্য হলো, এই সংঘাত কোনো প্রতিপক্ষ দলের সঙ্গে নয়, বরং একই ছাতার নিচে থাকা নেতা-কর্মীদের অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও আধিপত্য বিস্তারের লড়াই। আর এই রক্তের হোলি খেলার মঞ্চে সবচেয়ে উদ্বেগজনক ভূমিকাটি পালন করছে খোদ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী—তাদের রহস্যজনক নিষ্ক্রিয়তা এবং ব্যর্থতার মধ্য দিয়ে।

সোমবার দিবাগত রাতে বাকলিয়া এক্সেস রোডের বগার বিল এলাকায় যা ঘটল, তা একযোগে অরাজকতা ও প্রশাসনিক উদাসীনতার চূড়ান্ত নিদর্শন। এই গোলাগুলির ঘটনায় নিহত মো. সাজ্জাদ ছিলেন নগর যুবদলের বিলুপ্ত কমিটির সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক এমদাদুল হক বাদশার অনুসারী। আর অভিযুক্ত পক্ষটি নগর ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি গাজী সিরাজ উল্লাহর অনুসারী হিসেবে পরিচিত বোরহানউদ্দিনের লোকজন। দলীয় সূত্র মতেই, এমদাদুল হক বাদশা এবং গাজী সিরাজ উল্লাহ—উভয়েই সিটি মেয়র ও নগর বিএনপির সাবেক সভাপতি ডা. শাহাদাত হোসেনের অনুসারী। অর্থাৎ, এই আত্মঘাতী সংঘাত একই নেতার অনুসারীদের মধ্যে।

ঘটনার সূত্রপাতটি যতটা তুচ্ছ, ততটাই প্রতীকী। মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন তাঁর ছবি ব্যবহার করে সন্ত্রাসী-চাঁদাবাজদের টাঙানো ব্যানার সরিয়ে ফেলার নির্দেশ দেন। সেই নির্দেশ পালন করতে গিয়ে এমদাদুল হক বাদশার অনুসারী মো. জসিম একটি ব্যানার ছিঁড়ে ফেলেন, যেখানে মেয়র শাহাদাত ও গাজী সিরাজ উল্লাহর পাশাপাশি বোরহানউদ্দিনের ছবিও ছিল। এরপর মো. জসিমকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়, আটকে রেখে মারধর করা হয়। তাকে ছাড়িয়ে আনার জন্যই এমদাদুল হক বাদশার অনুসারীরা যান এবং তখনই বোরহানউদ্দিনের কার্যালয় থেকে গুলি ছোড়া হয়। একটি গুলি সাজ্জাদের বুক ভেদ করে চলে যায়।

এই হত্যাকাণ্ডের পর চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেনের বক্তব্য পরিস্থিতিকে নতুন মাত্রা দিয়েছে। তিনি এই হত্যাকাণ্ডের জন্য সরাসরি বাকলিয়া থানা পুলিশকে দায়ী করেছেন। তাঁর ক্ষোভ কেবলই রাজনৈতিক বক্তব্য নয়, এটি গুরুতর অভিযোগ। মেয়র শাহাদাত গণমাধ্যমকে স্পষ্ট জানিয়েছেন, এই বোরহান এবং সোহেল নামের ছেলেগুলোকে গ্রেপ্তারের জন্য তিনি সপ্তাহখানেক আগেই বাকলিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ইখতিয়ার উদ্দিন এবং পুলিশ কমিশনারকে ফোন করে জানিয়েছিলেন। তিনি বলেছেন, “আমি বলেছি, যদি আমার দলেরও কেউ তাদের শেল্টার দিয়ে থাকে, দরকার হলে তার বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নাও। তাকেও গ্রেপ্তার করো।” মেয়রের এই আকুতি বা নির্দেশ কোনোটাই পুলিশ আমলে নেয়নি।

এখানেই প্রশ্ন ওঠে পুলিশের ভূমিকা নিয়ে। কেন তারা কঠোর হলো না? সিটি মেয়র যখন সুনির্দিষ্ট নাম উল্লেখ করে অপরাধীদের গ্রেপ্তারের কথা বলেন, তখন পুলিশ কেন নীরব থাকে? মেয়র শাহাদাত হোসেন নিজেই সেই সন্দেহের তীর ছুড়েছেন। তিনি বাকলিয়া থানার ওসির গতিবিধি নিয়ে প্রশ্ন তুলে বলেছেন, তাঁর মনে হচ্ছে, পুলিশ “আওয়ামী লীগের কোনো না কোনো ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার পরামর্শে এ থানা চালাচ্ছে।” তিনি আরও উল্লেখ করেছেন, একসময়কার ছাত্রলীগ নেতা মানিকসহ দক্ষিণ জেলার কিছু ছেলেপেলে এখানে এসে একটি অপরাধী চক্র গড়ে তুলেছে।

এই অভিযোগ যদি সত্যি হয়, তবে পরিস্থিতি ভয়াবহ। এর অর্থ দাঁড়ায়, পুলিশ রাজনৈতিকভাবে এতটাই পঙ্গু বা আপসকামী যে, তারা জেনেশুনে অপরাধীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া থেকে বিরত থাকছে। তারা হয়তো ভাবছে, একদল আরেক দলকে খতম করলে তাদের কী? অথবা তারা পুরোনো ক্ষমতাসীনদের রেখে যাওয়া কাঠামোর কাছে জিম্মি। কারণ যা-ই হোক, এর নির্মম ফল ভোগ করছে সাধারণ মানুষ এবং সাজ্জাদের মতো তরুণেরা। পুলিশের এই কঠোর না হওয়ার নীতিই অপরাধীদের অস্ত্রের লাইসেন্স হিসেবে কাজ করছে।

চট্টগ্রামে অভ্যন্তরীণ কোন্দলে অস্ত্রবাজির এই ঘটনা নতুন নয়। এটি একটি চলমান রক্তক্ষয়ী চিত্রনাট্য। চলতি বছরের মার্চ মাসেই নগরের খুলশী এলাকায় ব্যানার টাঙানো নিয়ে সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রাণ হারান মো. জিহাদ নামের আরেক যুবদল কর্মী। সেই সংঘাত ছিল নগর ছাত্রদলের সদস্যসচিব শরীফুল ইসলামের অনুসারীদের সঙ্গে বিএনপি নেতা শাহ আলমের অনুসারীদের। নগরের বাইরে রাউজানের পরিস্থিতি আরও ভয়ঙ্কর। গত বছরের আগস্টের পর থেকে সেখানে ১২টি রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের মধ্যে ৭টিই ঘটেছে বিএনপির অভ্যন্তরীণ কোন্দলে, যার মধ্যে ৬ জনকেই গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। সর্বশেষ খুন হন যুবদল কর্মী আলমগীর আলম, যিনি উত্তর জেলা বিএনপির সাবেক আহ্বায়ক গোলাম আকবর খন্দকারের অনুসারী ছিলেন। অভিযোগের তীর কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান (পদ স্থগিত) গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরীর অনুসারীদের দিকে।

খুলশী থেকে বাকলিয়া, কিংবা রাউজান—সর্বত্রই একই চিত্র। আর প্রতিটি ঘটনার পর পুলিশ সেই গৎবাঁধা বুলি আওড়ায়। বাকলিয়ার ওসি ইখতিয়ার উদ্দিন যেমনটি বলেছেন, “ঘটনার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে।” নগর পুলিশের সহকারী কমিশনার আমিনুর রশিদও বলেছেন, “অস্ত্রধারীদের ধরতে পুলিশের অভিযান অব্যাহত আছে।” কিন্তু এই ‘অব্যাহত অভিযান’ কোনো ফল বয়ে আনছে না। অস্ত্রধারীরা ধরা পড়ছে না, অস্ত্রও উদ্ধার হচ্ছে না।

এই নিরাপত্তাহীনতার শেকড় আরও গভীরে। গত বছরের ৫ আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের সময় চট্টগ্রাম নগরের বিভিন্ন থানা ও ফাঁড়ি থেকে ৮১৩টি আগ্নেয়াস্ত্র এবং ৪৪ হাজার ৩২৪টি গুলি লুট হয়েছিল। পুলিশের সূত্রই স্বীকার করছে, সেই বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও গুলির বেশির ভাগই এখনো উদ্ধার হয়নি। সেই হারানো অস্ত্রই আজ দলীয় প্রতিপক্ষ দমনের হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। যে অস্ত্র জনগণের নিরাপত্তা দেওয়ার কথা, তাই আজ জনগণের নিরাপত্তাহীনতার কারণ। পুলিশ প্রথমে অস্ত্র রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছে, এখন তারা সেই অস্ত্র উদ্ধার করতে ব্যর্থ হচ্ছে।

মো. সাজ্জাদের মায়ের আহাজারি তাই শুধু সন্তান হারানোর আর্তনাদ নয়, এটি একটি ব্যর্থ আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থার প্রতি করুণ প্রতিধ্বনি। পুলিশ যদি মেয়রের সতর্কবার্তায় কান দিত, যদি তারা সময়মতো বোরহান ও তার সঙ্গীদের গ্রেপ্তার করত, তাহলে হয়তো সাজ্জাদকে মরতে হতো না। পুলিশের এই নিষ্ক্রিয়তা, এই রহস্যজনক শৈথিল্য সাধারণ মানুষের নিরাপত্তাহীনতাকে তীব্র থেকে তীব্রতর করছে। মানুষ এখন কার কাছে যাবে? যখন রাজনৈতিক কর্মীরাই নিজেদের মধ্যে খুনে লিপ্ত, আর রক্ষক হিসেবে পুলিশ দর্শকের ভূমিকায়, তখন সাধারণ নাগরিকের নিরাপত্তার দায়ভার কার?

মেয়র শাহাদাত হোসেন বলেছেন, তিনি এই শহরকে সন্ত্রাসীদের অভয়ারণ্য হিসেবে দেখতে চান না। কিন্তু পুলিশের বর্তমান কর্মকাণ্ড সেই অভয়ারণ্যকেই সুরক্ষা দিচ্ছে। কথা নয়, এখন কঠোর পদক্ষেপ প্রয়োজন। সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে অপরাধীদের গ্রেপ্তার, রাজনৈতিক পরিচয় নির্বিশেষে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ, এবং সর্বোপরি, লুট হওয়া সেই ৮১৩টি অস্ত্র উদ্ধারে সর্বাত্মক, দৃশ্যমান অভিযান পরিচালনা করা এখন সময়ের দাবি। তা না হলে সাজ্জাদের রক্তের দাগ শুকানোর আগেই হয়তো অন্য কোনো মায়ের বুক খালি হবে, অন্য কোনো এলাকায় ফের বেজে উঠবে অস্ত্রের ঝনঝনানি।

লেখক : ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, একুশে পত্রিকা।