হতদরিদ্রদের নামে ২৫০ কোটি টাকা ঋণ লোপাট, অভিযোগ সাবেক মন্ত্রী সাইফুজ্জামানের পরিবারের বিরুদ্ধে

সাইফুজ্জামান চৌধুরী
বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার দুর্গম এলাকার ২২ জন হতদরিদ্র, দিনমজুর ও ভূমিহীন মানুষের নামে ২৫০ কোটি টাকার বেশি ব্যাংক ঋণ জালিয়াতির তথ্য উদঘাটিত হয়েছে।

ভুক্তভোগীরা ২০২৩ সাল থেকে ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক (ইউসিবি) থেকে ঋণ পরিশোধের নোটিশ পাচ্ছেন, যদিও তারা এই ঋণের বিষয়ে কিছুই জানেন না।

এই জালিয়াতির ঘটনায় ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর পরিবারের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ উঠেছে, যারা তৎকালীন সময়ে ব্যাংকটি নিয়ন্ত্রণে রেখেছিলেন।

প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, করোনাভাইরাস মহামারির সময়ে নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার বাইশারী, ঈদগড় ও গর্জনিয়া ইউনিয়নের ভুক্তভোগী বাসিন্দাদের কাছে আর্থিক সহায়তা বা চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) সংগ্রহ করা হয়। ভুক্তভোগীদের মধ্যে নুরুল ইসলাম, মোহাম্মদ আইয়ুব এবং ফরিদুল আলমও ছিলেন।

পরে তাদের চট্টগ্রামের পটিয়ায় নিয়ে কিছু নথিপত্রে স্বাক্ষর ও টিপসই নেওয়া হয়, বিনিময়ে ২০-৩০ হাজার টাকা দেওয়া হয়।

ভুক্তভোগী দিনমজুর মোহাম্মদ আইয়ুব, যিনি হলদ্যাশিয়া গ্রামের একটি ঝুপড়ি ঘরে বসবাস করেন, তার নামে ৬ কোটি ১২ লাখ টাকার ঋণের নোটিশ এসেছে। মোহাম্মদ আইয়ুব জানান, তিনি কখনো চট্টগ্রাম শহরেই যাননি।

আরেক ভুক্তভোগী ফরিদুল আলম, যিনি বাঁশের বেড়া তৈরি করে জীবিকা নির্বাহ করেন, তার নামে ১০ কোটি ৮২ লাখ টাকার নোটিশ আসে। তাকে ‘ইউনিক এন্টারপ্রাইজ’ নামে একটি প্রতিষ্ঠানের মালিক দেখানো হয়েছে, যেটির ব্যবস্থাপক হিসেবে মো. আরিফ হোসেনের স্বাক্ষর রয়েছে। ফরিদুল আলম এই প্রতিষ্ঠানের নামও শোনেননি।

রামুর ঈদগড় ইউনিয়নের নুরুল ইসলাম ও তার স্ত্রী মায়মুনা আক্তারের নামে মোট ১৩ কোটি টাকার (সুদসহ ১৭ কোটি ১০ লাখ) নোটিশ এসেছে। নুরুল ইসলামকে ‘ইসলাম ট্রেডার্স’ এর মালিক দেখানো হয়। তাদের প্রতিবেশী মো. জহির উদ্দিন ও তার স্ত্রী উম্মে সালমার নামে ৭ কোটি ৫০ লাখ টাকার নোটিশ পাঠানো হয়, যেখানে জহির উদ্দিনকে ‘জহির ইন্টারন্যাশনাল’ নামক প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী উল্লেখ করা হয়েছে।

এই প্রক্রিয়ায় এনআইডি সংগ্রহের দায়িত্বে ছিলেন কক্সবাজারের রামুর ঈদগড়ের মিজানুর রহমান ও নাইক্ষ্যংছড়ির নুরুল বশর। তারাও এখন ভুক্তভোগী; মিজানুর রহমান ৯ কোটি এবং নুরুল বশর ১৩ কোটি টাকার ঋণ নোটিশ পেয়েছেন।

তাদের ভাষ্যমতে, নুরুল বশরের ভগ্নিপতি ঈদগড়ের আবুল কালামের নির্দেশনায় তারা এই কাজ করেন। আবুল কালাম তাদের পটিয়ার বাসিন্দা মোস্তাফিজুর রহমান, মো. শাহজাহান ও নুরুল আনোয়া‌রের কাছে নিয়ে যান। এই তিনজন সাইফুজ্জামান চৌধুরীর পরিবারের হয়ে কাজ করতেন বলে অভিযোগ রয়েছে। অভিযুক্ত আবুল কালাম, মোস্তাফিজুর রহমান, শাহজাহান ও নুরুল আনোয়া‌র বর্তমানে আত্মগোপনে রয়েছেন।

বাইশারী ইউপি চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আলম নিশ্চিত করেছেন যে ভুক্তভোগীরা সবাই ভূমিহীন ও দিনমজুর এবং তারা প্রতিকার চেয়েছেন।

অভিযোগ রয়েছে, সাবেক মন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর স্ত্রী রুখমিলা জামান ইউসিবির চেয়ারম্যান এবং ভাই আনিসুজ্জামান চৌধুরী রনি নির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যান থাকাকালীন ব্যাংকটির চট্টগ্রাম নগরের পাহাড়তলী, চকবাজার ও বন্দর শাখা থেকে এই বিপুল পরিমাণ অর্থ নামে-বেনামে বের করে নেওয়া হয়।

এই জালিয়াতি প্রসঙ্গে ইউসিবি ব্যাংকের প্রধান যোগাযোগ কর্মকর্তা জীশান কিংশুক হক জানান, এসব অনিয়ম পূর্ববর্তী পরিচালনা পর্ষদের সময়ে ঘটেছে এবং ব্যাংক আইনি পদক্ষেপ নিয়েছে। তিনি আরও উল্লেখ করেন, হতদরিদ্ররা যদি সামান্য অর্থও পেয়ে থাকেন, তবে তারাও এই দুর্নীতির অংশীদার হিসেবে বিবেচিত হতে পারেন।