দেশীয় গ্যাস অনুসন্ধানে অবহেলা কেন?


কারখানার চাকাটা আজ ঘুরতে গিয়েও থমকে যাচ্ছে। সন্ধ্যা নামার আগেই নিভে যাচ্ছে পাওয়ার প্ল্যান্টের বাতি। আবাসিকের রান্নাঘরে চুলার নীল শিখাটা মিটমিট করছে। এটা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়; এটা দেশের বর্তমান জ্বালানি সংকটের এক রূঢ় বাস্তবতা। শিল্প, বিদ্যুৎ, পরিবহণ থেকে শুরু করে জনজীবন—গ্যাসের এই তীব্র সংকট আজ আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলেছে দেশের অর্থনীতিকে। শিল্পমালিকদের কপালে চিন্তার ভাঁজ। সময়মতো পণ্য উৎপাদন না হওয়ায় বাতিল হয়ে যাচ্ছে একের পর এক ক্রয়াদেশ। পরিস্থিতি এতটাই নাজুক যে, শত শত কোটি ডলার খরচ করে আমদানি করা ব্যয়বহুল এলএনজি দিয়েও সেই ঘাটতি পূরণ করা যাচ্ছে না।

কিন্তু এই সংকট কি এক দিনে তৈরি হয়েছে? মোটেই না। এই বিপর্যয়ের শেকড় অনেক গভীরে, যা আমাদের দীর্ঘদিনের এক নীতিগত অবহেলার সঙ্গে জড়িয়ে আছে।

একসময় আমাদের শোনানো হয়েছিল এক আশার বাণী: “বাংলাদেশ গ্যাসের উপর ভাসছে।” সেই আশা থেকে আমরা আত্মতুষ্টিতে ভুগেছি। তারপর হঠাৎ একদিন শুনলাম উল্টো কথা: “গ্যাস ফুরিয়ে আসছে।” এই দুই চরমপন্থী বক্তব্যের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আসল সত্যটা হলো, আমাদের দেশের প্রকৃত গ্যাসের মজুত কত, সেই তথ্যটাই আমাদের কাছে নেই। আমরা শুধু জানি, যেটুকু আবিষ্কৃত হয়েছিল, তা ফুরিয়ে আসছে। পুরোনো কূপগুলোর প্রাণশক্তি ফুরিয়ে গেছে। অথচ নতুন করে ‘গ্যাস খোঁজার’ যে কর্মযজ্ঞ দরকার ছিল, তাতে আমরা আশ্চর্য রকম উদাসীন থেকেছি।

ভূতত্ত্ববিদরা যখন বারবার বলছেন যে সিলেট, হাতিয়া কিংবা ভোলার মতো সম্ভাবনাময় এলাকায় এখনো মাটির নিচে গ্যাস অপেক্ষা করছে, যখন সমুদ্রবক্ষে আমাদের বিপুল জলসীমায় গ্যাসের বিশাল ভাণ্ডার থাকার উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে, তখন আমরা সেই সম্পদ আহরণে কার্যকর কোনো উদ্যোগই নিচ্ছি না। শুধু সম্ভাবনা বুকে নিয়ে বসে থাকলে তো চলবে না। যদি আহরণই করা না যায়, তবে সেই মজুতের পরিসংখ্যান দিয়ে লাভ কী? এটা তো সেই সিন্দুকে ভরা গুপ্তধনের মতো, যার চাবি আমরা নিজেরাই হারিয়ে ফেলেছি।

বিশেষজ্ঞরা কিন্তু কম সতর্ক করেননি। তারা এক দশক ধরেই চিৎকার করে বলছিলেন, পুরোনো গ্যাসক্ষেত্রগুলোর মজুত ফুরিয়ে আসছে। অবিলম্বে নতুন করে অনুসন্ধান ও কূপ খননে জোর দেওয়া না হলে দেশ ভয়াবহ জ্বালানি বিপর্যয়ে পড়বে। কিন্তু সেই সতর্কবার্তায় কেউ কর্ণপাত করেনি। বর্তমান সরকার কিছু কূপ খনন ও ‘ওয়ার্কওভার’ (পুরোনো কূপ সংস্কার)-এর উদ্যোগ নিলেও, তা ছিল প্রয়োজনের তুলনায় একেবারেই নগণ্য ও ধীরগতির। এটা অনেকটা দাবানল নেভানোর জন্য এক বালতি পানি ঢালার মতো হাস্যকর প্রচেষ্টা।

এই অবহেলার চড়া মূল্য এখন আমাদের দিতে হচ্ছে। দেশের জ্বালানি খাতকে সচল রাখতে আমরা পুরোপুরি এলএনজি-নির্ভর হয়ে পড়ছি। গ্যাসের অভাবে যখন শিল্পমালিককে বিকল্প জ্বালানি (যেমন ডিজেল বা ফার্নেস অয়েল) ব্যবহার করতে হচ্ছে, তখন স্বাভাবিকভাবেই তার উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে। আর সেই বর্ধিত খরচের বোঝা শেষ পর্যন্ত চাপছে সাধারণ মানুষের কাঁধেই। পণ্যের দাম বাড়ছে, মুদ্রাস্ফীতি লাগামহীন হয়ে পড়ছে।

অথচ এই পরিস্থিতি এড়ানো যেত। আমাদের এখন দুটি পথ খোলা আছে। প্রথমত, আমরা এই এলএনজি-নির্ভরতাকে মেনে নিতে পারি, যার অর্থ হলো—আন্তর্জাতিক বাজারের খামখেয়ালিপনার কাছে জিম্মি হয়ে থাকা। আজ যে দামে এলএনজি কিনছি, কাল কোনো বৈশ্বিক সংকটে তার দাম দ্বিগুণ বা তিনগুণ হয়ে যেতে পারে। আমাদের কষ্টার্জিত বৈদেশিক মুদ্রার ভাণ্ডার শেষ হয়ে যাবে শুধু এই জ্বালানি কিনতেই।

দ্বিতীয় পথটি হলো জ্বালানি খাতে আত্মনির্ভরশীল হওয়ার পথ। এই পথটি কঠিন, সময়সাপেক্ষ, কিন্তু টেকসই। এই পথটি হলো দেশজুড়ে—স্থলভাগে ও সমুদ্রবক্ষে—ব্যাপক পরিসরে গ্যাস অনুসন্ধানের এক মহাযজ্ঞ শুরু করা।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সিলেট ও ভোলার মতো এলাকায় এখনই ত্রিমাত্রিক সার্ভে সম্পন্ন করে দ্রুত কূপ খনন শুরু করা উচিত। একইসঙ্গে গভীর সমুদ্রে আমাদের যে ব্লকগুলো রয়েছে, সেখানে অনুসন্ধান চালাতে হবে। এটা সত্যি যে, গ্যাস অনুসন্ধানে প্রথম কয়েকটি কূপ খনন করেই সফলতা নাও আসতে পারে। হয়তো কয়েকটি কূপ থেকে গ্যাস পুরোপুরি বেরোবে না। কিন্তু সেই ভয়ে যদি আমরা চেষ্টাই থামিয়ে দিই, তবে আমরা কোনোদিনই আমাদের প্রকৃত সম্পদ খুঁজে পাব না।

এখানেই রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বাপেক্সকে শক্তিশালী করার প্রশ্নটি আসে। বিদেশি বিনিয়োগ অবশ্যই আনতে হবে, বিশেষ করে গভীর সমুদ্রের মতো উচ্চ প্রযুক্তির কাজে। কিন্তু একইসঙ্গে বাপেক্সকে কারিগরি, লজিস্টিক এবং আর্থিকভাবে এতটা সক্ষম করে তুলতে হবে, যাতে তারা দ্রুত ও কার্যকরভাবে এই অনুসন্ধান কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারে।

আমাদের নীতিনির্ধারকদের বুঝতে হবে, আমদানির পেছনে প্রতি বছর শত শত কোটি টাকা খরচ না করে, সেই অর্থের একটি অংশ যদি দেশীয় গ্যাস অনুসন্ধানে দীর্ঘমেয়াদে বিনিয়োগ করা হয়, তবে তা দেশের অর্থনীতি এবং জ্বালানি নিরাপত্তার জন্য এক সুদূরপ্রসারী ইতিবাচক ফল বয়ে আনবে। একটি সফল গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কারের মানে হলো আগামী ২০-৩০ বছরের জন্য জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত হওয়া।

আমরা এখন এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। হয় আমরা আমদানির সহজ কিন্তু ব্যয়বহুল পথে হেঁটে নিজেদের অর্থনীতিকে পঙ্গু করে ফেলব, নয়তো আমরা অনুসন্ধানের চ্যালেঞ্জিং কিন্তু সম্মানজনক পথটি বেছে নেব। দেশের জ্বালানি খাতকে এই আসন্ন বিপর্যয় থেকে রক্ষা করতে হলে দ্বিতীয় পথটি বেছে নেওয়া ছাড়া আর কোনো বিকল্প আমাদের হাতে নেই। সময় এসেছে আত্মতুষ্টির ঘুম ভেঙে জেগে ওঠার এবং নিজেদের সম্পদ নিজেদের কাজে লাগানোর।

লেখক : ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, একুশে পত্রিকা।