‘রাজনৈতিক হস্তক্ষেপে’ গড়া কলেজে শিক্ষার্থীই নেই, ফাঁকা লাখ লাখ আসন


দেশের উচ্চশিক্ষার ৭১ শতাংশের বেশি শিক্ষার্থী জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে হলেও প্রতি বছর বিশ্ববিদ্যালয়টিতে কয়েক লাখ আসন ফাঁকা থাকছে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের (ইউজিসি) তথ্য বলছে, ২০২৩ সালেই ৩ লাখ ১৩ হাজার ২৪২টি আসন ফাঁকা ছিল। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শিক্ষার মানের ঘাটতি, চাহিদার সাথে আসনের অসামঞ্জস্য, রাজনৈতিক বিবেচনায় যত্রতত্র কলেজ অনুমোদন এবং স্নাতকদের শ্রমবাজারে পিছিয়ে পড়াই এর প্রধান কারণ।

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে এর অধিভুক্ত ২ হাজার ২৫৭টি কলেজের মধ্যে ৮৮১টি কলেজে স্নাতক (সম্মান) কোর্স চালু আছে। ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষে এসব কলেজে ভর্তিযোগ্য আসন ছিল ৪ লাখ ৩৬ হাজার ২৮৫টি। এছাড়া ডিগ্রি (পাস কোর্স) পর্যায়ে ৪ লাখ ২১ হাজার ৯৯০টি আসন রয়েছে।

ইউজিসির বার্ষিক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৪ সাল থেকেই আসন শূন্য থাকার প্রবণতা শুরু হয়। ২০১৮ সালে শূন্য আসনের সংখ্যা ছিল ৩ লাখ ৪৫ হাজার ৮১৭টি, যা ২০২১ সালে বেড়ে ৩ লাখ ৯৬ হাজার ৬৫৮টিতে দাঁড়ায়। ২০২২ সালে ১ লাখ ৯৭ হাজার ৩৪৯টি আসন ফাঁকা থাকলেও ২০২৩ সালে তা আবার ৩ লাখ ছাড়িয়ে যায়।

জেলা পর্যায়ের কলেজগুলোতেও একই চিত্র দেখা গেছে। সাতক্ষীরার কালিগঞ্জ সরকারি কলেজে ২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষে অনার্সের ১৮৫টি আসনের মধ্যে ৭৮টিই খালি। কলেজটির অধ্যক্ষ আজিজুর রহমান জানান, “চারদিকে মানহীন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠার পাশাপা‌শি রাজনৈ‌তিক হস্তক্ষেপের কারণে যত্রতত্র শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তৈরি হচ্ছে। গ্রামের ছাত্র-ছাত্রীরা তাদের বা‌ড়ির পাশের ওইসব মানহীন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষা গ্রহণ করায় উচ্চ‌শিক্ষায় পি‌ছিয়ে যাচ্ছে।”

একইভাবে, সাতক্ষীরা সদর উপজেলার বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ভালুকা চাঁদপুর আদর্শ কলেজে ৪০০ আসনের বিপরীতে ৯৫টি আসন ফাঁকা রয়েছে। কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরী সরকারি কলেজেও ৫৩০টি আসনের মধ্যে ২৭৪ জন ভর্তি হয়েছেন, প্রায় অর্ধেক আসনই ফাঁকা।

শিক্ষাসংশ্লিষ্টরা বলছেন, চাহিদা বিবেচনা না করে আসন বৃদ্ধি এবং রাজনৈতিক বিবেচনায় অপ্রস্তুত কলেজকে অধিভুক্ত করাই এই সংকটের মূল কারণ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. মো. আলী জিন্নাহ বলেন, “অধিভুক্তির প্রক্রিয়াটি যথাযথভাবে হয়নি। নিড অ্যাসেসমেন্ট ঠিকঠাক ছিল না। কিছু বিষয় আছে যেগুলোর চাহিদা কম, সেগুলোতে কেউ ভর্তিই হয় না। এছাড়া বেকারত্বও একটি কারণ।”

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) ২০২৪ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকধারীদের ২৮ দশমিক ২৪ শতাংশই বেকার। বাকিদের অধিকাংশই স্বল্প আয়ের চাকরিতে নিযুক্ত। গবেষণায় কলেজগুলোর মানের ঘাটতি, শিক্ষার্থীদের কম উপস্থিতি, শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের অভাব এবং চাকরির বাজারমুখী শিক্ষার অভাবকে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।

এ বিষয়ে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. এএসএম আমানুল্লাহ বলেন, “জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের যখন আসন বৃদ্ধি করা হয়েছিল তখন চাহিদার বিষয়টি সঠিকভাবে চিন্তা না করেই বাড়ানো হয়েছিল এবং পরিকল্পনার ঘাটতি ছিল। দায়িত্ব গ্রহণের পর আমরা শিক্ষার মান বৃদ্ধি এবং শিক্ষার্থীদের শ্রমবাজারের উপযোগী করে গড়ে তোলার জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছি।”

তিনি বলেন, “মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিতে আমরা মনিটরিং জোরদার করেছি। যেসব প্রতিষ্ঠান শিক্ষার্থী পাচ্ছে না, তাদের চিহ্নিত করে চিঠি দেওয়া হয়েছে। সমস্যা কাটিয়ে উঠতে না পারলে তাদের অধিভুক্তিও বাতিল হতে পারে।”

উপাচার্য আরও বলেন, “আসন শূন্য থাকায় আমাদেরও সমস্যার মুখোমুখি হতে হচ্ছে। আমাদের প্রতি বছরই বাজেট ঘাটতি বাড়ছে। শিক্ষার্থীদের দক্ষ করে তুলতে আমাদের কারিকুলামের উন্নয়ন, আউটকাম বেজড এডুকেশন নিশ্চিত করা ও ইন্ডাস্ট্রি-একাডেমিয়া সংযোগ স্থাপনসহ বিভিন্ন পরিকল্পনা আছে। কিন্তু সেগুলো বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় বাজেট সংকুলানে হিমশিম খেতে হচ্ছে।”