মহেশখালীর ২ কোটি টাকার ‘যাত্রীসেবা’ এখন বিলাসী রেস্তোরাঁ

কক্সবাজারের মহেশখালীতে পর্যটক ও স্থানীয় যাত্রীদের সেবার উদ্দেশ্যে প্রায় ২ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত ‘পান ভাস্কর্য’ ভবনটি এখন একটি বিলাসবহুল রেস্তোরাঁয় পরিণত হয়েছে। কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (কউক) ভবনটি নির্মাণ করলেও, মোহাম্মদ ফয়সাল আমিন নামে এক ব্যবসায়ী চুক্তির শর্ত লঙ্ঘন করে পুরো ভবন দখল করে ‘ফয়সাল’স ডাইন’ নামে এই রেস্তোরাঁটি চালাচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।

যাত্রীদের জন্য নির্ধারিত বিশ্রামাগার, গণশৌচাগার এবং নারীদের ব্রেস্টফিডিং রুমও রেস্তোরাঁর দখলে চলে যাওয়ায় পর্যটক ও স্থানীয়দের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ ও অসন্তোষ দেখা দিয়েছে।

কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (কউক) উদ্যোগে মহেশখালীর ঘোরকঘাটা জেটিঘাট এলাকায় যাত্রীসেবার মানোন্নয়নে নির্মিত এই ভবনটি এখন দ্বীপবাসীর হতাশার প্রতীক হয়ে উঠেছে। কউক দাবি করেছিল, নৌপথে আগত পর্যটক ও স্থানীয়দের জন্য এখানে বিশ্রামাগার, নারীদের ব্রেস্টফিডিং রুম, পাবলিক টয়লেট ও ফুড কর্নার থাকবে। কিন্তু এখন ভবনটির পুরো অংশ ও সব সুবিধা বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে; যাত্রীসেবা কেবল কাগজে-কলমে সীমাবদ্ধ।

কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা যায়, চলতি বছরের ২৫ মে ভবনের ৯৩৩ বর্গফুটের একটি ভোজনালয়, ৪৮৪ বর্গফুটের পাবলিক টয়লেট অংশ, তিনটি দোকান এবং ছাদের ৫৫০ বর্গফুট বর্ধিতাংশ মাসিক চুক্তিতে ফয়সাল’স ডাইন নামের রেস্তোরাঁটির কাছে হস্তান্তর করা হয়।

কিন্তু বাস্তবে দেখা গেছে, চুক্তির বাইরে গিয়ে মোহাম্মদ ফয়সাল আমিন পুরো ভবনটি দখলে নিয়েছেন। স্থানীয়দের অভিযোগ, কউকের কয়েকজন কর্মকর্তার যোগসাজশেই এই দখল কার্যক্রম চালানো হচ্ছে এবং সরকারি সম্পদ ব্যবহারে চরম অনিয়ম হলেও প্রশাসন উদাসীন ভূমিকা পালন করছে।

মহেশখালীতে বেড়াতে আসা ভ্রমণপিপাসু মুহাম্মদ মেহরাজ বলেন, “তিন বছর আগে যেমন দুর্ভোগ দেখেছি, আজও তেমনই আছে। যাত্রীসেবার নামে ভবন করে কউক পুরোদস্তুর বাণিজ্য শুরু করেছে। উন্নয়নের গল্প শুনিয়ে কউক বাণিজ্যিকভাবে ভবনটি ভাড়া দিয়েছে, জনগণ কোনো সেবা পাচ্ছে না।”

পর্যটক সাদিয়া জাহান বলেন, “এখানে নারীদের ব্রেস্টফিডিং রুম থাকার কথা শুনেছিলাম, কিন্তু সবকিছু এখন রেস্টুরেন্টে পরিণত। সরকারি তত্ত্বাবধানে থাকলে আমরা অন্তত নিশ্চিন্তে ব্যবহার করতে পারতাম। এখন শৌচাগারেও প্রবেশে সংকোচ হয়।”

শুধু তাই নয়, ভবনটির সামনের অংশে স্থাপন করা মহেশখালীর ইতিহাস সম্বলিত পান ভাস্কর্যের উপরে ‘ফয়সাল’স ডাইন’-এর বিজ্ঞাপন দেওয়ায় ভোজনালয়টি ব্যবসার শুরুতেই সমালোচনার মুখে পড়েছিল।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (এস্টেট ও ভূমি) উপপরিচালক মাহমুদুল হাসান তথ্য দিতে গড়িমসি করেন। তিনি বলেন, “যাত্রী সেবা নিশ্চিতের কথা ফয়সাল আমিনকে বলে দেওয়া আছে। এছাড়াও পুরো ভবন বাণিজ্যিকভাবে ভাড়া দেওয়ার সরকারী নিয়ম আছে।”

তবে যাত্রীসেবার নামে করা ভবনটি বাণিজ্যিক ভবনে রূপ নেওয়ার কারণে যাত্রীসেবা নিশ্চিত না হওয়া নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি সদুত্তর দিতে পারেননি এবং পুরো ভবন ভাড়ার কোনো সরকারি নথিও দেখাতে পারেননি।

অভিযোগের বিষয়ে বক্তব্য নিতে মহেশখালীর অস্ট্রেলিয়ান প্রবাসী মোহাম্মদ ফয়সাল আমিনের ব্যবহৃত হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে একাধিকবার কল করলেও তিনি ফোন ধরেননি। ক্ষুদে বার্তা পাঠিয়েও সাড়া মেলেনি। তবে ফয়সাল’স ডাইনে কর্মরত এক কর্মকর্তা জানান, “নিয়ম মেনে রেস্তোরাঁ ব্যবসা করছি আমরা।”

চুক্তির বাইরে গিয়ে ভবন দখল ও নারীদের ব্রেস্টফিডিং রুম ব্যবহারের বিষয়ে তিনি কোনো উত্তর দিতে পারেননি।

পর্যটন বিশ্লেষক আহসানুল কবির বলেন, “মহেশখালীর পান ভাস্কর্য ভবনটি যাত্রীসেবা কেন্দ্র হিসেবে না চালিয়ে রেস্টুরেন্টে রূপ দেওয়া দুঃখজনক। সরকারি উন্নয়ন প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য জনগণের সুবিধা নিশ্চিত করা, বাণিজ্য নয়। এখানে কউকের প্রশাসনিক ত্রুটি স্পষ্ট। এখনই নজরদারি না হলে ভবিষ্যতে এ ধরনের প্রকল্প বিনিয়োগকারীদের স্বার্থে ব্যবহার হবে, জনগণের নয়।”