
স্লোগানমুখর সন্ধ্যা। চট্টগ্রামের বায়েজিদ বোস্তামি এলাকার চালিতাতলীর খন্দকারপাড়ায় বুধবার চলছিল বিএনপি মনোনীত প্রার্থী এরশাদ উল্লাহর নির্বাচনী জনসংযোগ। নেতা-কর্মীদের ভিড় ঠেলে এগোচ্ছিল মিছিল। হঠাৎই সব ছাপিয়ে গুলির শব্দ। মুহূর্তেই ছত্রভঙ্গ সবাই।
এই আকস্মিক হামলার লক্ষ্য রাজনৈতিক কেউ ছিলেন না, ছিলেন কথিত ‘সন্ত্রাসী’ সরোয়ার হোসেন। পুলিশের ভাষ্য আর প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনায় উঠে এসেছে, এটি ছিল এলাকায় আধিপত্য বিস্তারের পুরোনো কোনো দ্বন্দ্বের জেরে একটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড।
যেভাবে ঘটল হত্যাকাণ্ড
ঘটনার পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া একটি ভিডিওতে দেখা যায়, চট্টগ্রাম-৮ আসনের প্রার্থী এরশাদ উল্লাহ নেতা-কর্মীদের নিয়ে প্রচারপত্র বিলি করছেন। তার সঙ্গেই হাঁটছিলেন সরোয়ার হোসেন।
এ সময় কর্মীদের ভিড়ের মধ্যেই মিশে থাকা এক যুবক হঠাৎ এগিয়ে এসে খুব কাছ থেকে সরোয়ারের ঘাড়ে পিস্তল ঠেকিয়ে গুলি করে। পরপর সাত থেকে আটটি গুলির শব্দ শোনা যায়।
গুলিতে আহত ইরফানুল হক ওরফে শান্তর খালাতো ভাই ও স্থানীয় ৩ নম্বর পাঁচলাইশ ওয়ার্ড বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক আবদুর রশিদ ঘটনাস্থলে ছিলেন। তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, “মাগরিবের নামাজের পর মসজিদের পাশে দোকানে জনসংযোগের জন্য এরশাদ উল্লাহসহ আমরা যাই। হঠাৎ মাস্ক পরা কয়েকজন যুবক পেছন থেকে এসে আমাদের সরিয়ে দিয়ে সরোয়ারের ঘাড়ে-গলায় গুলি করে। গুলির শব্দ পেয়ে নেতা-কর্মীরা সবাই এদিক-ওদিক ছোটাছুটি শুরু করেন।”
হামলায় প্রার্থী এরশাদ উল্লাহসহ পাঁচজন গুলিবিদ্ধ হন। তাদের মধ্যে সরোয়ার হোসেন মারা যান। আহত বাকিরা হলেন পাঁচলাইশ তিন নম্বর ওয়ার্ড স্বেচ্ছাসেবক দলের যুগ্ম আহ্বায়ক ইরফানুল হক ওরফে শান্ত, বিএনপি কর্মী আমিনুল হক ও মুর্তজা হক। নগর যুবদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ শাহেদ জানান, এরশাদ উল্লাহর পেটে ছররা গুলি লাগলেও তিনি শঙ্কামুক্ত। তবে চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, ইরফানুলের অবস্থা আশঙ্কাজনক।
পুরোনো শত্রুতার জের
পুলিশ জানায়, নিহত সরোয়ার হোসেনের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, অস্ত্র, হত্যাসহ ১৫টি মামলা রয়েছে। এক মাস আগে বিয়ে করা সরোয়ার গত বছরের ৫ আগস্টের পর কারাগার থেকে জামিনে বেরিয়ে বিএনপির বিভিন্ন সমাবেশে যোগ দিচ্ছিলেন।
এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে এলাকায় আধিপত্য বিস্তারের পুরোনো বিরোধকেই দেখছে পুলিশ ও নিহতের পরিবার। পুলিশ জানায়, বিদেশে পলাতক সন্ত্রাসী সাজ্জাদ আলীর সঙ্গে সরোয়ার হোসেনের বিরোধ ছিল। এর আগে গত ৩০ মার্চ নগরের বাকলিয়া এক্সেস রোড এলাকায় সরোয়ারকে লক্ষ্য করে গুলি করা হলেও সেদিন তিনি বেঁচে যান, যদিও ঘটনাস্থলে দুজন মারা গিয়েছিল।
নিহত সরোয়ারের ভাই আজিজ হোসেন সরাসরি অভিযোগ করেছেন। তিনি বলেন, “দীর্ঘদিন ধরে আমার ভাইকে মেরে ফেলার জন্য হুমকি দিয়ে আসছে সন্ত্রাসী ছোট সাজ্জাদের লোকজন। সপ্তাহ পার না হতে ফোন করে বলা হতো যা খাবার খেয়ে নিতে। এরশাদ উল্লাহর জনসংযোগে নিরাপত্তা থাকবে, সে আশায় আমার ভাইসহ আমরা অংশ নিয়েছিলাম।”
আজিজ হোসেনের দাবি, সন্ত্রাসী ছোট সাজ্জাদের সহযোগী মো. রায়হানসহ কয়েকজন সরাসরি এ হত্যাকাণ্ডে অংশ নিয়েছেন।
হামলাকারীরা যেভাবে আসে ও যায়
খুনিরা কীভাবে এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে পালিয়ে গেল, তা নিয়ে প্রত্যক্ষদর্শী ও পুলিশের বর্ণনায় কিছুটা ভিন্নতা রয়েছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে চারজন প্রত্যক্ষদর্শী জানান, খুনে অংশ নেওয়া সন্ত্রাসীরা একটি মাইক্রোবাসে করে এসে জনসংযোগে আসা বিএনপির লোকজনের সঙ্গে বহরে মিশে যায়।
তবে চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশ কমিশনার হাসিব আজিজ রাতে এভারকেয়ার হাসপাতালে আহতদের দেখার পর সাংবাদিকদের বলেন, অপরাধীদের শীর্ষ একজন স্ত্রীসহ জেলে আছে। তারা ‘রিমোট’ এলাকায় পালিয়ে থাকে। হাসিব আজিজ বলেন, “তারা মোটরসাইকেল নিয়ে এসে ঘটনা ঘটিয়ে পালিয়ে যায়। কিলিং মিশনে যারা ছিল, তাদের শনাক্ত করার মতো কিছু আলামত পাওয়া গেছে।”
‘লক্ষ্য সরোয়ারই ছিল’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেছেন, এ ঘটনার সঙ্গে বিএনপির কোনো সম্পর্ক নেই। তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, “বিএনপির প্রার্থী গণসংযোগ করার সময় সেখানে শত শত লোক অংশ নেন। সরোয়ার সেখানে অংশ নিলে সন্ত্রাসী দুটি দলের মধ্যে পূর্ববিরোধের জেরে তাঁকে গুলি করা হয়।”
পুলিশ কমিশনার হাসিব আজিজও একই কথা বলেছেন। তিনি বলেন, “অপরাধীদের মূল টার্গেট ছিল সরোয়ার, এরশাদ উল্লাহ নয়। নির্বাচনের আগে চট্টগ্রামে এমন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড অ্যালার্মিং (উদ্বেগজনক)।”
তিনি আরও বলেন, “এরশাদ উল্লাহ বিকেলে গণসংযোগের আগে আমার কার্যালয়ে ছিলেন। তিনি আমাকে একবারও বলেননি চালিতাতলীতে গণসংযোগ করবেন। এমনকি বায়েজিদ থানা-পুলিশও কিছু জানে না। আমি বলব, সামনে যেকোনো দল জনসভা কিংবা গণসংযোগ করার ২৪ ঘণ্টা আগে পুলিশকে জানাতে। পুলিশ সর্বোচ্চ নিরাপত্তা দেবে।”
