- মৃত্যু যখন ঠিক পেছনে। ভিড়ের মধ্যে সবার অলক্ষ্যেই সরোয়ার হোসেনকে টার্গেট করে ঘাতক। কিছু বুঝে ওঠার আগেই ঘটে যায় এই হত্যাকাণ্ড।
আমরা আর নিরাপদ নই। ঘরের বাইরে পা রাখলেই মনে হয়, এই বুঝি কোনো বুলেট উড়ে এসে লাগলো গায়ে। কে কখন গুলির মুখে পড়বেন, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। চট্টগ্রাম শহরের মানুষ এখন এক তীব্র আতঙ্ক আর নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে দিন পার করছে। নির্বাচনকে সামনে রেখে যখন একটি উৎসবমুখর পরিবেশের কথা বলা হচ্ছে, তখন বন্দর নগরীর বাস্তবতা ঠিক তার উল্টো। এখানে চলছে রক্তের হোলিখেলা, চলছে প্রকাশ্য হত্যাকাণ্ড।
গত বুধবার (৫ নভেম্বর), প্রকাশ্য দিবালোকে যা ঘটলো, তা শুধু একটি বিচ্ছিন্ন হত্যাকাণ্ড নয়, বরং নগরীর গভীরে বাসা বাঁধা এক অশনি সংকেতের উদগীরণ। চট্টগ্রাম-৮ আসনের বিএনপি মনোনীত প্রার্থী এরশাদ উল্লাহ যখন চান্দগাঁও চালিতাতলী খন্দকারপাড়া এলাকায় নির্বাচনী জনসংযোগে ব্যস্ত, তখন একদল সশস্ত্র আততায়ীর অতর্কিত গুলিবর্ষণ পুরো এলাকাকে স্তব্ধ করে দেয়। এই ঘটনায় প্রার্থী এরশাদ উল্লাহ নিজে গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রাণে বেঁচে গেলেও, নিস্তার পাননি সরোয়ার হোসেন ওরফে বাবলা। হাসপাতালে নেওয়ার পর তার মৃত্যু হয়। এই ঘটনায় শান্ত নামে আরও একজন আহত হয়েছেন।
এই ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই, আক্ষরিক অর্থেই ২৪ ঘণ্টা পার না হতেই, নগরী আবার কেঁপে উঠলো গুলির শব্দে। বৃহস্পতিবার (৬ নভেম্বর) দুপুর পৌনে ২টার দিকে বায়েজিদ থানার কুয়াইশ চালিতাতলী এলাকায়—অর্থাৎ আগের দিনের ঘটনার খুব কাছেই—অজ্ঞাতপরিচয় দুর্বৃত্তরা আবার গুলি চালায়। এবারের শিকার কোনো রাজনৈতিক কর্মী বা সন্ত্রাসী নন, একজন সাধারণ অটোরিকশাচালক, মো. ইদ্রিস আলী (৩৭)। অটোরিকশা চালানোর সময়ই তাকে লক্ষ্য করে ছোড়া গুলিতে তিনি হাঁটুতে বিদ্ধ হন এবং বর্তমানে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। এই ঘটনাটি জনমনে আতঙ্ককে বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে, কারণ এটি প্রমাণ করে যে সংঘাত এখন আর নির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তুতে সীমাবদ্ধ নেই; সাধারণ নাগরিকরাও অনিরাপদ।
ঘটনার ভিডিও ফুটেজ এবং পরবর্তী পুলিশি তদন্তে যে চিত্রটি ফুটে উঠেছে, তা রাজনৈতিক সহিংসতার চেয়েও জটিল এক সমীকরণের ইঙ্গিত দেয়। চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ (সিএমপি) সূত্রমতে, বিএনপি প্রার্থী এরশাদ উল্লাহ সম্ভবত মূল লক্ষ্যবস্তু ছিলেন না; তিনি এক বিপথগামী গুলির শিকার। এই হামলার প্রধান লক্ষ্য ছিল নিহত সরোয়ার হোসেন বাবলা, যার বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগে পনেরোটিরও বেশি মামলা রয়েছে। পুলিশের প্রাথমিক ধারণা, এই হত্যাকাণ্ড নগরীতে আধিপত্য বিস্তারের পুরোনো লড়াইয়ের নতুন মঞ্চায়ন, যার এক প্রান্তে ছিল বাবলা এবং অন্য প্রান্তে রয়েছে আরেক সন্ত্রাসী সাজ্জাদ হোসেন ওরফে ছোট সাজ্জাদ। একটি নির্বাচনী প্রচারণার মতো প্রকাশ্য জনসমাগমে ঢুকে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যকে হত্যা করার এই দুঃসাহস প্রমাণ করে, অপরাধী চক্রগুলো কতটা বেপরোয়া এবং তাদের নেটওয়ার্ক কতটা বিস্তৃত।
এই ঘটনাকে বিচ্ছিন্ন হিসেবে দেখার কোনো সুযোগ নেই, কারণ চট্টগ্রামের আকাশ-বাতাস গত এক বছর ধরেই বারুদের গন্ধে ভারী। বিশেষ করে রাউজান উপজেলা যেন এক মৃত্যু উপত্যকায় পরিণত হয়েছে। সাম্প্রতিক ঘটনাবলি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, রাউজানে গত ১৪ মাসে অন্তত ১৭টি খুনের ঘটনা ঘটেছে, যার মধ্যে ১৩ জনই রাজনৈতিক কর্মী। গত ৭ অক্টোবর বিএনপি কর্মী ও ব্যবসায়ী আব্দুল হাকিমকে যেভাবে মদুনাঘাটে তার ব্যক্তিগত গাড়িতে গুলি করে হত্যা করা হয়, কিংবা গত মার্চে ব্যবসায়ী জাহাঙ্গীর আলমের হত্যাকাণ্ড—এগুলো সবই এক সুতায় গাঁথা। সর্বশেষ গত ২৫ অক্টোবর, যুবদল নেতা মোহাম্মদ আলমগীরকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এই পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ডগুলো একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক বলয়কে কেন্দ্র করে আবর্তিত হচ্ছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, গত বছরের ৫ আগস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর সৃষ্ট ক্ষমতা-শূন্যতা এই সংঘাতকে বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। বিএনপির মনোনয়ন প্রক্রিয়াকে কেন্দ্র করেও বিভিন্ন স্থানে গোলাগুলি ও মারামারির ঘটনা ঘটছে। একটি অশান্ত পরিবেশে চাঁদাবাজি, দখলদারিত্ব চলছে। অন্যদিকে, পূর্ববর্তী ক্ষমতাসীন দলের ছত্রছায়ায় থাকা স্থানীয় নেতারা বিপুল পরিমাণ অবৈধ অস্ত্রের মালিক হয়েছিলেন; সেই অস্ত্রগুলোই এখন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে এবং নতুন আধিপত্যের লড়াইয়ে ব্যবহৃত হচ্ছে।
এই রাজনৈতিক সংঘাত যে কেবল অন্য দলের বিরুদ্ধেই হচ্ছে তা নয়, তা এখন নিজ দলের মধ্যেও তীব্র আকার ধারণ করেছে। এর সর্বশেষ উদাহরণ মিললো রাউজানেই। বুধবার দিবাগত রাত ১২টার দিকে (৫ নভেম্বর দিবাগত) উপজেলার বাগোয়ান ইউনিয়নের কোয়েপাড়া গ্রামে বিএনপির দুই পক্ষের মধ্যে ভয়াবহ সংঘর্ষ ও গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। এই ঘটনায় পাঁচ নেতা-কর্মী—আবদুল্লাহ (উপজেলা শ্রমিক দল), মোহাম্মদ ইসমাইল (কৃষক দল), খোরশেদ আলম চৌধুরী (শ্রমিক দল), রবিউল হোসেন (যুবদল) ও মোহাম্মদ সোহেল (বিএনপি কর্মী)—গুলিবিদ্ধ হয়ে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রমতে, এই সংঘর্ষটি বিএনপির কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান (পদ স্থগিত) গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরী এবং জেলা বিএনপির সাবেক আহ্বায়ক গোলাম আকবরের অনুসারীদের মধ্যে ঘটেছে।
সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) মোহাম্মদ বেলায়েত হোসেনের মতে, এই গোলাগুলি রাজনৈতিক বিভাজনের পাশাপাশি এলাকার আধিপত্য বিস্তারকেও কেন্দ্র করে হতে পারে। এটিই রাউজানের সহিংসতার মূল চিত্র—যেখানে গত এক বছরে ১৭টি হত্যাকাণ্ড ঘটলেও, যেমনটা ২৫ অক্টোবর যুবদল কর্মী আলমগীর কিংবা ৭ অক্টোবর আব্দুল হাকিম হত্যাকাণ্ডে দেখা গেছে, কোনো মূল আসামি ধরা পড়ছে না বা অস্ত্র উদ্ধার হচ্ছে না।
পুলিশ কি পরিস্থিতি সামলাতে পারছে? কেন এই ব্যর্থতা?
এই যখন পরিস্থিতি, তখন স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকা নিয়ে। এই জটিল পরিস্থিতিতে পুলিশের ভূমিকা সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। সিএমপি কমিশনার হাসিব আজিজ নিজেও এই চ্যালেঞ্জের কথা স্বীকার করেছেন। তিনি উল্লেখ করেছেন, সন্ত্রাসীরা দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চলকে তাদের আস্তানা হিসেবে ব্যবহার করে। তারা শহরে দ্রুত অভিযান চালিয়ে অপরাধ সংঘটিত করে এবং মোটরবাইকে করে দ্রুততার সাথে পালিয়ে যায়, যা তাদের ট্র্যাক করা কঠিন করে তোলে।
স্মরণ করা যেতে পারে, দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই গত আগস্টে সিএমপি কমিশনার হাসিব আজিজ তার বাহিনীকে আত্মরক্ষার্থে গুলি চালানোর কঠোর নির্দেশনা দিয়েছিলেন। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি এবং পুলিশ সদস্যদের ওপর হামলার প্রতিক্রিয়ায় সেই নির্দেশনা এসেছিল। কিন্তু বুধবারের ঘটনা প্রমাণ করে, কেবল কঠোর নির্দেশনা যথেষ্ট নয়; অপরাধীদের নেটওয়ার্ক ভাঙতে এবং অবৈধ অস্ত্রের এই ভয়াবহ বিস্তার রোধ করতে আরও সুনির্দিষ্ট ও সমন্বিত কৌশল প্রয়োজন।
আর এখানেই আমার মূল পর্যবেক্ষণটি তুলে ধরতে চাই। আমার মতে, চট্টগ্রামের বর্তমান আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির অন্যতম প্রধান কারণ হলো স্থানীয় অপরাধ জগত সম্পর্কে অভিজ্ঞ ও দক্ষ পুলিশ কর্মকর্তার অভাব। চট্টগ্রাম একটি ভিন্ন ধরনের শহর। এর ভৌগোলিক অবস্থান—একদিকে পাহাড়, একদিকে সমুদ্র, অন্যদিকে জটিল সব অলিগলি—এবং এখানকার অপরাধ জগতের ধরণ ও নেটওয়ার্ক খুবই স্বতন্ত্র।
যেসব পুলিশ কর্মকর্তা এই চট্টগ্রামকে হাতের তালুর মতো চিনতেন, যারা এখানকার অপরাধ জগতের নাড়িনক্ষত্র জানতেন, কোন সন্ত্রাসী চক্রের সাথে কার দ্বন্দ্ব, কারা অস্ত্র সরবরাহ করে—এইসব বিষয়ে যাদের গভীর জ্ঞান ছিল, তাদের বেশিরভাগকেই গত কয়েক বছরে সিএমপি থেকে পুলিশের অন্যান্য ইউনিটে বদলি করা হয়েছে। ফলে যা হওয়ার তাই হয়েছে। নতুন যে কর্মকর্তারা আসছেন, তারা হয়তো অন্যান্য ক্ষেত্রে খুবই দক্ষ, কিন্তু চট্টগ্রামের এই জটিল অপরাধের সমীকরণ তারা চট করে বুঝে উঠতে পারছেন না। তারা পরিস্থিতি সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছেন। এই সুযোগটাই নিচ্ছে সন্ত্রাসী চক্রগুলো।
তাহলে উপায় কী? এই হত্যাযজ্ঞ বন্ধ হবে কবে?
আমরা আর এই হত্যাযজ্ঞ সইতে পারছি না। সাধারণ মানুষ হিসেবে আমরা বাঁচতে চাই। আমাদের সন্তানদের নিরাপত্তা চাই। পুলিশ প্রশাসনকে অবশ্যই এর একটা বিহিত করতে হবে। যেভাবেই হোক, এই খুনিদের থামাতে হবে।
আমার সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব হলো, পুলিশ সদর দপ্তরের উচিত জরুরিভিত্তিতে এই বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়া। যে সকল অভিজ্ঞ পুলিশ কর্মকর্তার চট্টগ্রামকে এবং চট্টগ্রামের অপরাধ জগতকে ভালো করে বোঝেন, তাদের অবিলম্বে সিএমপিতে ফিরিয়ে আনা হোক। তাদের নেতৃত্বে একটি বিশেষ টাস্কফোর্স গঠন করা হোক, যার একমাত্র কাজ হবে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার এবং এই সশস্ত্র সন্ত্রাসী চক্রগুলোকে সমূলে নির্মূল করা।
যদি প্রশাসনিক জটিলতার কারণে তাদের স্থায়ীভাবে ফিরিয়ে আনা সম্ভব না-ও হয়, অন্তত পুলিশ সদর দপ্তরের বিশেষ আদেশে ওই অফিসাররা সীমিত সময়ের জন্য হলেও সিএমপিতে এসে এই চক্রটিকে আইনের আওতায় আনতে কাজ করতে পারেন। আমাদের এখন প্রয়োজন প্রচলিত টহলের বাইরে গিয়ে সুনির্দিষ্ট গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে চালানো ‘ব্লক রেইড’ এবং টার্গেটেড অভিযান।
এই সহিংসতা যখন ঘটছে, তখন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও উৎসবমুখর নির্বাচনের পরিবেশ নিশ্চিত করতে জাতিকে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ করেছেন। চট্টগ্রামের এই ঘটনায় তিনি নিন্দা জানিয়েছেন এবং দ্রুত তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু বাস্তবতা হলো, সদিচ্ছা এবং প্রশাসনিক নির্দেশনার বাইরেও মাঠপর্যায়ের চিত্র ভিন্ন। গত এক বছরে চট্টগ্রামে ৪৯টি হত্যাকাণ্ড, রহস্যজনক মৃত্যু বা ক্ষতবিক্ষত মরদেহ উদ্ধারের ঘটনা নিছক কোনো পরিসংখ্যান নয়। এটি একটি অঞ্চলের সামাজিক ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার ভেঙে পড়ার লক্ষণ।
একটি গণতান্ত্রিক উত্তরণের সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে চট্টগ্রাম আজ যে সহিংসতার চক্রে আটকা পড়েছে, তা থেকে মুক্তি অতি জরুরি। নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিকে অর্থবহ করতে হলে, প্রথমে জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। প্রশাসনকে কেবল বিবৃতি বা রুটিন টহলের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না। অবৈধ অস্ত্রের ভাণ্ডার উদ্ধারে সর্বাত্মক ‘ব্লক রেইড’ এবং চিহ্নিত সন্ত্রাসীদের পাশাপাশি তাদের গডফাদারদেরও আইনের আওতায় আনতে হবে।
সরোয়ার হোসেন বাবলা কিংবা আব্দুল হাকিমের মতো ব্যক্তিদের মৃত্যু কেবল দুটি পরিবারের ক্ষতি নয়, এটি রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রতি আস্থার সংকট তৈরি করে। নির্বাচন যদি জনগণের উৎসব হওয়ার কথা থাকে, তবে সেই উৎসবের প্রাঙ্গণকে অবশ্যই রক্তমুক্ত করতে হবে। চট্টগ্রামের আসন্ন নির্বাচন তাই কেবল ব্যালটের লড়াই নয়, এটি দুষ্কৃতকারী ও সন্ত্রাসীদের কবল থেকে জনপদকে মুক্ত করার এক অগ্নিপরীক্ষাও বটে।
লেখক : ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, একুশে পত্রিকা।

