মা’কে ইউএনও’র কক্ষে প্রবেশে বাধা, ছেলেই এখন ইউএনও

.আজাদ তালুকদার : জীবনে খুব বেশি চাওয়া বা আকাঙ্ক্ষা ছিল না মুক্তিযোদ্ধা আবদুল খালেক-রাবেয়া দম্পতির। তবে তাদের মাঝে উৎকণ্ঠা ছিলো। ছিলো ‘তাগাদা’, ‘তাড়না’। সেই ‘তাড়না’ সন্তানদের ‘মানুষ’ হিসেবে গড়ে তোলার, ‘মানবসম্পদে’ পরিণত করার।

তারা দেখছেন, সমাজে প্রতিনিয়ত ‘লোকসংখ্যা’ বাড়ছে, কিন্তু বাড়ছে না ‘মানুষ’-এর সংখ্যা। মনুষত্বহীন ক্রমবর্ধিষ্ণু ‘লোকসংখ্যা’র ভিড়ে তাঁদের সন্তানেরা ‘মানুষ’ই হবে, মানবসম্পদে পরিণত হবে এমন প্রত্যয় আর প্রত্যাশায় অহর্নিশ ছুটে চলা এই দম্পতির ইচ্ছা ঠিকই পূরণ হয়েছে।

তাদের ৫ সন্তানের মধ্যে কেউ কাস্টমস অফিসার, কেউ বাংলাদেশ ব্যাংকের অডিট অফিসার, কেউ শিক্ষকতাসহ নামকরা পেশায় জড়িত। এর মাঝেই ঘটলো মন খারাপের ঘটনাটি।

বলে রাখা ভালো, গৃহিণী হলেও তাপসী রাবেয়া শিক্ষিত, সচেতন নারী। পারিবারিক কাজে তিনি নিজেই ছুটে যান, মোকাবেলা করেন সংসারের খুঁটিনাটি কাজ। ঘটনাটি ১০ বছর আগের। পারিবারিক প্রয়োজনে ঢাকা জেলার দোহার উপজেলার তৎকালীন ইউএনও’র সঙ্গে কথা বলতে গিয়েছিলেন তাপসী রাবেয়া।

কিন্তু কথা বলা দূরে থাক, দিনভর অপেক্ষা করে ইউএনও’র কক্ষেই প্রবেশ করতে পারেননি। দিনশেষে কষ্টের পাহাড় ডিঙিয়ে ঘরে ফেরেন তিনি। পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সেই কষ্ট শেয়ার করে একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। বলেন, আমার একটা সন্তান যদি ইউএনও হতো! মা’র দীর্ঘশ্বাসটা আর বড় হয়। বিসিএস দিয়ে ইউএনও হওয়ার মতো তার সন্তানদের মাঝে আর কেউ অবশিষ্ট নেই। এরমধ্যে ৫ সন্তানের সবাই কর্মস্থলে প্রবেশ করে ভালো চাকরি করছেন।

কিন্তু মায়ের প্রতি অসম্মান, অবামননা মানতে রাজি নন রাবেয়া তাপসীর কনিষ্ঠ সন্তান শামীম হোসেন। তখন বান্দরবানের জেলসুপার তিনি। স্থির করলেন এ অবস্থায়ই বিসিএস দেবেন, মায়ের ইচ্ছা পূরণ করবেন!ইউএনও হয়ে মায়ের ‘অমর্যাদার’ প্রতিবাদ জানাবেন।

কিন্তু এ কীভাবে সম্ভব? জেল সুপারের পদ ছেড়ে ইউএনও হতে চাওয়ার ইচ্ছা কিংবা চেষ্টা অত সহজও নয়। এ অসহজ কাজটিকে সহজ করতে নেমে পড়লেন শামীম হোসেন। অদম্য স্পৃহার এ মানুষটি জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে অসম্ভবকে সম্ভব করা, অজেয়কে জয় করার প্রমাণ এর মধ্যে রেখেছেন। একে একে চারটি চাকরি ধরেন তা আবার ছেড়েও দিয়েছেন। জীবনের প্রথম চাকরি সেনাবাহিনীর সেকেন্ড লেফটেনেন্ট। নতজানু, গৎবাধা জীবন পছন্দ নয় শামীমের। তাই ছেড়ে দিলেন সেনাবাহিনীর চাকরি।

উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার পর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে ভর্তি হয়েছিলেন। সেখানেই ভর্তি হবেন নাকি অন্য কোথাও পড়বেন-ভাবতে ভাবতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজিতে ভর্তির সুযোগ পান তিনি। অনার্স শেষ করে পূবালী ব্যাংকে পরীক্ষা দিয়ে টিকে গেলেন, হলেন ব্যাংক-অফিসার। বাংলাদেশ ব্যাংকে অডিট অফিসারের চাকরি পেয়ে ছাড়লেন পূবালী ব্যাংক। অডিট অফিসারের চাকরিতে গিয়ে দেখলেন-পুরাতন টাকা পোড়ানোই তার মূল কাজ। ভাবলেন এখানে টাকা পোড়াতেই পোড়াতেই জীবন যাবে-তাই করলেন না সে চাকরিও!

এবার অংশ নিলেন ২৬ তম বিসিএস পরীক্ষায়। শিক্ষাক্যাডারে উত্তীর্ণ হয়ে প্রভাষক হিসেবে সরকারি কলেজে যোগ দিলেন চারদলীয় জোট সরকারের আমলে। এখানে এসে দেখলেন নোংরা রাজনীতির খেলা। ছাত্রজীবনে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের একটি ছাত্রসংগঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ততার বিষয়টি এখানে কাল হলো। সেই চাকরিও ছেড়ে দিলেন। এবার যুক্ত হলেন কারাগারের চাকরিতে। জেলসুপার হিসেবে যোগ দিলেন বান্দরবানে। কারাবন্দিদের সুখ-দুঃখের জীবন নিয়ে এখানেই থিতু হতে চেয়েছিলেন শামীম হোসেন।

কিন্তু সেখানেও থাকলেন না। মায়ের প্রতি ইউএনও’র অমর্যাদা তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিলো। পণ করলেন প্রশাসন-ক্যাডারে যুক্ত হয়ে কর্মের মাধ্যমে মা’র প্রতি অবমাননার প্রতিবাদ জানাবেন।

২৮ তম বিসিএসে উত্তীর্ণ হয়ে প্রশাসন-ক্যাডারে যুক্ত হন। প্রথম পোস্টিং হয় পুরোনো কর্মস্থল বান্দরবানে। এখানে তিনবছর ভিআইপিদের প্রটোকল দেয়ার কাজ করেন। এরপর কুমিল্লা, লক্ষ্মীপুরের রায়পুরার এসি ল্যান্ড হিসেবে দায়িত্ব পালন শেষে ২০১৬ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর মা’র স্বপ্নের ইউএনও হিসেবে যোগ দেন চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলায়।

ইউএনও শামীম হোসেন বলেন, ‘এখানে যোগ দিয়ে পরিবর্তনের রাউজান গঠনে মাননীয় সংসদ সদস্য এ বি এম ফজলে করিম চৌধুরী স্যারের সারথী হয়েছি। আমার কার্যালয়কে বানিয়েছি সর্বস্তরের মানুষের কার্যালয়। আমার ফোন খোলা থাকে ২৪ ঘণ্টা। যে কেউ, যে কোনো সময় আমার সঙ্গে ফোনে কথা বলার সুযোগ পান। জীবনের শেষসময় পর্যন্ত তূণমূলের সঙ্গে থাকতে চাই। হতে চাই তাদের সুখ-দুঃখের সারথী।’

তবে নিজের আক্ষেপের কথা বলতে গিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘মা আমার বেঁচে নেই। প্রশাসন-ক্যাডারে যোগ দেয়ার খবরে মা অসম্ভব খুশি হয়েছিলেন। আমার ইউএনও হবার আগেই পৃথিবী ছেড়ে যান তিনি। মা নেই, চাইলেও তাকে আর পাবো না, পাওয়া যাবে না। কিন্তু তার চাওয়া অনুযায়ী সাধারণ মানুষকে অহর্নিশ সেবা দিয়ে যাচ্ছি। তাতে যদি মা’র আত্মা শান্তি পায়!’

একুশে/এটি/এডি