কোরিয়ান গণমাধ্যমে সাতকানিয়ার সন্তান ফরিদকে নিয়ে লেখা
ওমর ফারুক হিমেল : প্রখ্যাত মনীষী উইলিয়াম হ্যাজলিট বলেছিলেন, আমি যা নই, তা হবার এবং আমরা যা করতে পারি না, তা করার অবিরাম সংগ্রামের নাম ‘জীবন’। একজন সাধারণ মানুষ অসাধারণ হতে পারে, অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারে এই অমিয় বাণীর শক্তিতে।
আজ একজন মানুষের গল্প বলবো, যিনি ছোটকাল থেকে সংগ্রামে-সাধনায় বড় হয়েছেন, পদে পদে সংগ্রামী জীবনের ‘অভিজ্ঞতা’ ফেরি করে ‘জীবনতরী’ কূলে ভিড়িয়েছেন, অজেয়কে জয় করেছেন। নাম তার ফরিদ হান।
চট্টগ্রাম জেলার সাতকানিয়া উপজেলার করইয়ানগর গ্রামে তার জন্ম। বাবা মোহাম্মদ ইসমাঈল হোসেন। একান্নবর্তী পরিবারে বেড়ে ওঠা ফরিদের পড়ালেখার হাতেখড়ি গ্রামেরই পাঠশালায়। ১৯৮৮ সালে করইয়ানগর বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি এবং ১৯৯০ সালে চট্টগ্রাম হাজী মুহাম্মদ মহসিন কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করেন। পরে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে চট্টগ্রাম কলেজ থেকে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন।
কর্মজীবনের প্রথম দিকে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং ইনকাম ট্যাক্স অফিসে চাকরি পেয়েছিলেন। নিয়োগপত্রও হাতে এসেছিল। কিন্তু ৯টা থেকে ৫টার গৎবাঁধা জীবনে জড়াতে চাননি তিনি। চ্যালেঞ্জ নিতে যিনি ভালোবাসেন, অ্যাডভেঞ্চার যার পছন্দ, তার এমন সাদামাটা ‘চাকরিজীবন’ অপছন্দ হওয়াটাই স্বাভাবিক। চ্যালেঞ্জটা শুরু করলেন সেখান থেকেই। দেশের দুদুটো চাকরি ফিরিয়ে দিয়ে শিক্ষানবীশ ভিসায় (স্কিল ভিসা) পাড়ি জমান দক্ষিণ কোরিয়ায়, ১৯৯৬ সালে।
কোরিয়ায় প্রথমদিকে পাশে দাঁড়ানো দূরের কথা, পথ বাতলে দেওয়ারও কেউ ছিল না। ঘামে-শ্রমে, সাধনায় নিজেই নিজের ভাগ্য গড়েছেন, চিনেছেন বহু মতের মানুষ, পথের ঠিকানা।
২০১৪ সালে এশিয়ার দ্বিতীয় শিল্পোন্নত শহর দক্ষিণ কোরিয়ার আনসানে গড়ে তুলেন হ্যাপি হালাল ফুড ও হ্যাপী ট্রাভেল। গ্রাহক ও ভোক্তা সাধারণের সন্তুষ্টিকে মূল উপার্জন ধরে শুরু করা ফরিদ হানের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের ছাতায় এখন অসংখ্য, অজস্র মানুষের আনাগোনা। ভালো খাবার, হালাল খাবারের টানে মানুষ ছুটে আসে হ্যাপি হালাল ফুডে।
সততা, সাহস, অধ্যবসায়ের পাঠশালার প্রথম সারির ছাত্র ফরিদ হান কোরিয়ানদের কাছে ‘হান চে জুন’। প্রবাসী বাংলাদেশিদের স্বজন, বিপদের বন্ধু। মানবিক গল্পের প্লট তৈরির জন্য একাধিকবার কোরিয়ান পত্রিকায় সংবাদ শিরোনাম হয়েছেন কোরিয়ান নাগরিকত্ব পাওয়া ফরিদ হান।
কোরিয়ায় সফল বাংলাদেশি ফরিদ হানের মতে, জীবনের প্রতিটি সময় কাজে লাগিয়ে একাগ্রতা, নিষ্ঠা আর সততাকে পুঁজি করে এগিয়ে গেলে সাফল্য ধরা দেবেই। চেষ্টা, চেষ্টা, চেষ্টা। চেষ্টার কোনো বিকল্প নেই। চেষ্টা ছাড়া কেউ সফল হয়েছে এমন দৃষ্টান্ত নেই। বলেন ফরিদ হান।
কোরিয়ায় বসবাসরত প্রবাসী বাংলাদেশিদের উদ্দেশ্যে ফরিদ হান বলেন, দেশে শুধু রেমিটেন্স প্রেরণ করে বসে থাকলে হবে না, বিনিয়োগ করে দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে হবে। দেশকে উন্নত, শক্তিশালী অর্থনৈতিক ভিতের উপর দাঁড় করাতে হবে। সেজন্য দেশকে নিয়ে তাঁর ভাবনার জগত বিস্তৃত, বিশাল।
এপিজে আবদুল কালাম বলেছিলেন, স্বপ্ন সেটা নয় যেটা মানুষ ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে দেখে; স্বপ্ন সেটাই যেটা মানুষকে ঘুমাতে দেয় না। স্বপ্নবাজ ফরিদ হানকে এখন ঘুমাতে দেয় না একটি সামষ্টিক, মানবিক স্বপ্নপূরণের তাগাদা।
বাংলাদেশে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং হাসপাতাল নির্মাণের মধ্যদিয়ে এই স্বপ্নপূরণের আশৈশব ইচ্ছে ফরিদ হানের।
ফরিদ হান কোরিয়ান প্রবাসীদের জন্য নিজেকে অকাতরে বিলিয়ে দিয়েছেন। মানুষের সেবায় নিয়োজিত আছেন নিরন্তর। বাংলাদেশিদের প্রয়োজনে দোভাষী হিসেবে কাজ করছেন কোরিয়ান পুলিশ ও আদালতে।
বাংলাদেশ দূতাবাসের অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করছেন ফরিদ হান, মঞ্চে উপবিষ্ট রাষ্ট্রদূত আবিদা ইসলাম।
বলাবাহুল্য, ফরিদ হানের সকালে ঘুম ভাঙে বিপদাপন্নদের ডাকে, মানুষের প্রয়োজনে। কেউ বেকার, চাকরি দরকার; অসুস্থ কেউ, হাসপাতালে নিতে হবে; পুলিশে ধরেছে, আদালতে যেতে হবে; দুর্ঘটনায় পড়েছে, সাহায্য দরকার; ফরিদ হানই যেন সবকিছুতে সহায়-অবলম্বন। আত্মমানবতার সেবার মূর্তপ্রতীক।
একুশে প্রতিবেদকের দেখা এমন একটি মানবিক ঘটনার গল্প বলা যাক এবার। ফরিদ হান একদিন নিজের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে অবস্থান করছেন। এসময় এক ইপিএসকর্মী এলেন কোম্পানির মালিকের বিরুদ্ধে মারধরের অভিযোগ নিয়ে। সঙ্গে সঙ্গে মালিককে ফোন দিলেন ফরিদ। কথা বলে ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত হলেন। এরপর ওই মালিকের বিরুদ্ধে ইপিএসকর্মীকে দিয়ে মামলা দিলেন। মামলার চার্জ গঠন থেকে রায় পর্যন্ত আদালতে দোভাষির ভূমিকা পালন করলেন ফরিদ হান। বাংলাভাষি কর্মীটির নিগৃহীত হওয়ার বিষয়টি কোরিয়ান ভাষায় সঠিকভাবে উপস্থাপন করে মামলায় জিতিয়ে আনলেন কর্মীটিকে।
বাংলাদেশ কোরিয়া অ্যাসোসিয়েশনের উপদেষ্টা, দক্ষিণ কোরিয়া চট্টগ্রাম সমিতির সহ সভাপতি, কোরিয়াস্থ চট্টগ্রাম অর্থনৈতিক ফোরামের সভাপতি, কোরিয়া-বাংলাদেশ ফাউন্ডেশনের সদস্য, কোরিয়াস্থ চট্টগ্রাম স্টুডেন্ট ফোরামের উপদেষ্টাসহ নানান সংগঠনে সক্রিয়, সপ্রতিভ ফরিদ হান।
তিনি ইপিএস সংক্রান্ত রেমিটেন্স যোদ্ধাদের নানা সংগঠনের নানা আয়োজনে অর্থনৈতিক সহযোগিতা করে থাকেন। দক্ষিণ কোরিয়ার রেমিটেন্স যোদ্ধাদের আত্মার আত্মীয় বলা হয় ফরিদ হানকে।
ফরিদ হানরা ৩ ভাই, ৫ বোন। ভাইবোনদের প্রতিষ্ঠিত করতে নিজেকে উৎসর্গ করেছেন। ফলে সবাই আজ স্ব স্ব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত, সমুজ্জ্বল। ছোটভাই আমিনুল ইসলাম সিলেট শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইঞ্জিনিয়ারিং-এর সহকারী অধ্যাপক, আরেক ভাই মোহাম্মদ হোসাইন চট্টগ্রাম কলেজে কোরিয়ান ভাষার শিক্ষানবীশ শিক্ষকতার সঙ্গে যুক্ত।
একুশে/ওএফএইচ/এটি