রাজনীতির সৌন্দর্য, রাজনীতির অলঙ্কার আশরাফ ভাই

রেহানা বেগম রানু : আশরাফ ভাই। সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। জাতীয় চার নেতার অন্যতম সৈয়দ নজরুল ইসলামের যোগ্য উত্তরাধিকার। দীর্ঘ ২৩ বছর পর ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ যখন রাষ্ট্রক্ষমতায়, সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম তখন বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী। মূলত তখন থেকেই আশরাফ ভাইকে চেনার এবং জানার ক্ষেত্র তৈরি হয়। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হওয়ার পর রাজনীতির নানা ইস্যুতে তাঁর শিষ্টাচার, পরিমিতিবোধ আমাকে ভীষণ স্পর্শ করতো। আওয়ামী লীগের মাঠপর্যায়ের একজন কর্মী হিসেবে আমার অহংবোধের ঠিকানা আশরাফ ভাই। তাঁর মতো একজন নির্লোভ, দেশপ্রেমিক মানুষ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক।

এ যেন আমাদের জন্য বাড়তি অলঙ্কার, একটু বেশিই গৌরবের। আমি অত্যন্ত সৌভাগ্যবান যে, ঘটনাচক্রে সেই মানুষটির দিনভর সান্নিধ্য-সাহচর্য পাওয়ার সুযোগ হয়েছিল ২০০৮ সালের শেষের দিকে। কাছাকাছি যাবার পর আমার মনে হয়েছিল সত্যিকার অর্থেই রাজনীতিতে ‘অনিন্দ্য সুন্দর’ মানুষ আশরাফ ভাই।

জরুরি অবস্থায় চরম ঝুঁকি নেয়া কর্মী আমি। ঝুঁকি নেওয়াটাকে পবিত্র দায়িত্ব মনে করেছি। আর এ ক্ষেত্রে সাহসের বাতিঘর আশরাফ ভাইয়ের মতো দুয়েকজন। দলের চরম সঙ্কটে অনেকেই যখন আত্মগোপনে, সংস্কারপন্থীর ভূমিকায় অবতীর্ণ তখনই নেত্রীর অনুপস্থিতিতে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হিসেবে সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম দলকে যেভাবে টেনে নিয়ে গিয়েছিলেন তা আমার মতো ক্ষুদ্র কর্মীকে দলের দুঃসময়ে, নেত্রীর মুক্তির দাবিতে জীবনের ঝুঁকি নিতে পরোক্ষভাবে উদ্দীপ্ত, উজ্জীবিত করেছিল। জরুরি অবস্থা শিথিল হয়ে আসছে ধীরে ধীরে। একটি নির্বাচনী পরিবেশের দিকে এগোচ্ছে দেশ। তখনই ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইনস্টিটিউট (আইআরআই) নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন নিয়ে গুলশানের হোটেল লেক শোরে একটি অনুষ্ঠান আয়োজন করে।

স্থানীয় সরকারের নারী জনপ্রতিনিধি, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের শীর্ষনেতাদের নিয়ে এই অনুষ্ঠান। আয়োজক কর্তৃপক্ষ অনুষ্ঠানের ছোট্ট একটি ভূমিকা টেনে মূল অনুষ্ঠান শুরু করে। একজন রাজনীতিবিদকে ঘিরে ৩ জন নারীনেত্রী, জনপ্রতিনিধির আড্ডা। গল্পচ্ছলে সেই রাজনীতিবিদের কাছ থেকে রাজনীতির পাঠগ্রহণ। শিক্ষনীয়, চমৎকার এই আয়োজনে জামায়াতের এক শীর্ষ নেতার টেবিলেই আমি পার্টিসিপেন্ট। জামায়াত নেতার সঙ্গে রাজনীতির আড্ডা, নারীর ক্ষমতায়নের কিচ্ছা শুনবো আমি! মেজাজ আমার সপ্তমে। আয়োজকদের বিষয়টি জানিয়ে গড় গড় করে হাঁটা শুরু করলাম। না আমি এ অনুষ্ঠানে থাকবো না। শামীমা আপা দৌড়ে এসে আমাকে থামান। বলেন, রানু আপনি কই যান! বিষয়টি তিনি দেখছেন বলেই আমাকে টেনে নিয়ে বসিয়ে দিলেন সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের টেবিলে। বাহ, মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি। আশরাফ ভাইয়ের মতো রাজনীতিকের সঙ্গেই রাজনীতির আড্ডা হবে সারাদিন!

সকাল ১০ টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত এক টেবিলেই খাওয়া-দাওয়া, রাজনীতির আড্ডা, গল্পগুজব। খুব কাছ থেকে জানা হলো আশরাফ ভাইকে, আশরাফ ভাইয়ের স্বতন্ত্র রাজনৈতিক দর্শনকে। ২০০০ সাল থেকে আমি একটি কনসেপ্ট নিয়ে কাজ করছি। আর সেটি হলো ওয়ান ইসটু ওয়ান। দেশের ১৬ কোটি মানুষের অর্ধেক নারী অর্ধেক পুরুষ। ক্ষমতার ভারসাম্যরক্ষা এবং নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করতে হলে অবশ্যই সংসদ এবং স্থানীয় নির্বাচনে সমানসংখ্যক জনপ্রতিনিধি থাকতে হবে। অর্থাৎ সংসদ নির্বাচন, স্থানীয় সরকার নির্বাচন হবে ওয়ান ইসটু ওয়ান পদ্ধতিতে। সংসদে আসন সংখ্যা হবে ৬শ’। ৩শ’ পুরুষ : ৩শ’ নারী। প্রতিটি আসনে একজন নারী এবং একজন পুরুষ আলাদা আলাদা মনোনয়ন পাবেন। নারীর সঙ্গে নারী এবং পুরুষের সঙ্গে পুরুষ ভোটযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে সাংসদ নির্বাচিত হবেন। স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোতেও অনুসরণ হবে একই পদ্ধতি। দলীয় প্রতীকে হবে সমস্ত নির্বাচন।

আশরাফ ভাইয়ের কাছে জানতে চাই একটি বৃহৎ রাজনৈতিক দলের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে এই কনসেপ্টটিকে কীভাবে দেখেন। আশরাফ ভাই স্বীকার করলেন ভালো কনসেপ্ট। তবে দলের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে নয়, ব্যক্তিগতভাবে এই কনসেপ্ট তিনি যৌক্তিক বলে মনে করেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশে এখনো নারী-পুরুষ নিয়ে দৃষ্টিভঙ্গিগত অনেক সমস্যা। তাই রাজনৈতিকভাবে এই কনসেপ্ট বাস্তবায়ন করা সময়সাপেক্ষ এবং কঠিন। তবে দলীয় প্রতীকে সবধরনের নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়টিকে তিনি তাৎক্ষণিক সাধুবাদ জানান। প্রধানমন্ত্রীসহ কয়েকটা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে নারী আসীন হলেই নারীর ক্ষমতায়ন হয় না-আমার সঙ্গে একমত পোষণ করে আশরাফ ভাই আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলে নারীর ক্ষমতায়নে সত্যিকারের উদ্যোগ গ্রহণের কথা বলেন।

প্রায় ৭ ঘণ্টা আড্ডার পর আশরাফ ভাই সম্পর্কে আমার ধারণা পাল্টে গেলো। আসার সময় আমার একটা ভিজিটিং কার্ড দিয়ে এসেছিলাম। কয়েক মাস পর সেই ভিজিটিং কার্ড আমার কাছে গল্প হয়ে ওঠলো। সেই গল্পটি শুনে আমি অবাক, অভিভূত। একদিন ইন্দিরা আপার (ফজিলাতুন্নেসা ইন্দিরা, মহিলা আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক ও বর্তমানে মহিলা ও শিশু বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী) সঙ্গে টেলিফোনে আলাপ। তিনি বললেন, ‘আশরাফ ভাই তোমার একটি ভিজিটিং কার্ড দিলেন আমাকে। কার্ডটি দিয়ে বললেন- মেয়েটা যোগ্য, তার পড়াশোনা আছে। তুমি তাকে একটু দেইখো।’

এরপর আশরাফ ভাই যতবার সাংগঠনিক কাজে চট্টগ্রাম এসেছেন আমি দেখা করেছি। বিভিন্ন ইস্যুতে কথা বলার সুযোগ পেয়েছি। পেয়েছি তার অপত্য স্নেহাশীষ। একবার মুক্তিযোদ্ধাদের একটি অনুষ্ঠান উপলক্ষে চট্টগ্রাম আসেন আশরাফ ভাই। অনুষ্ঠান শেষ করে বিশ্রামের সময় সংরক্ষিত আসনের এমপি নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল। সেখানেই আমার প্রসঙ্গ তুলে আশরাফ ভাই বললেন, রানু এমপি ডিজার্ব করে। সেখান থেকে বেরিয়েই ফোন করে খবরটি দিলেন আশরাফ ভাইয়ের স্নেহধন্য রিজু চেয়ারম্যান এবং চট্টগ্রাম জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার সাহাবুদ্দিন ভাই। আশরাফ ভাইয়ের মুখে আমার প্রশংসার কথা জানিয়ে তারা বললেন, আপনি ভাগ্যবান। আশরাফ ভাই আপনাকে ভালো জানেন।

একবার চট্টগ্রামের এক অনুষ্ঠানে এসে সিডিএ’র গেস্ট হাউসে উঠেছেন আশরাফ ভাই। চট্টগ্রামের অনেক নেতাকর্মী, আমিও উপস্থিত সেখানে। আমার সদ্য প্রকাশিত ‘নারীর ক্ষমতায়ন’ গ্রন্থটি তাঁর হাতে তুলে দিই। বইটির নারীর ক্ষমতায়ন সংক্রান্ত বিভিন্ন দিক নিয়ে আইআরআই’র অনুষ্ঠানে আশরাফ ভাইকে জানিয়েছিলাম। সেই কথাগুলো আবার স্মরণ করিয়ে দিই। এসময় গ্রন্থটির প্রকাশনা উৎসবে আশরাফ ভাইকে প্রধান অতিথি হওয়ার আবদার করি। বললেন, চট্টগ্রাম হলে তার পক্ষে অংশ নেয়া কঠিন। জাতীয় প্রেসক্লাব বা ঢাকার অন্য কোথাও হলে তিনি থাকবেন বলে আমাকে আশ্বস্ত করেন।

পরবর্তীতে নানা ঝামেলায় আশরাফ ভাইকে অতিথি করে ঢাকায় অনুষ্ঠানটি আর করা হয়নি। আশরাফ ভাইয়ের ঢাকার বাসায়ও আমার কয়েকবার যাতায়াত হয়েছে। পরের দেখায় আশরাফ ভাই জানালেন বইটি তিনি পুরো পড়েছেন। কিছু বিষয় তার ভালো লাগলো- সেকথাও জানান। আমি শুনে অবাক। এত ব্যস্ততার মাঝেও তিনি আমার বইটি পড়লেন কীভাবে! অবশ্য তিনি পড়ুয়া মানুষ, সবকিছুতে আপডেট থাকার চেষ্টা করেন- সে কথা আমার আগে থেকেই জানা।

একবার তাঁর ঢাকার বাসায় অনেক দর্শনার্থী। সকাল ১১টার দিকে নিচে নেমে তড়িঘড়ি করে অফিসে যেতে চাচ্ছিলেন তিনি। সময়াভাবে সবাইকে সাক্ষাৎ দিতে পারছেন না। এত দর্শনার্থীর ভিড়ে রাজশাহীর মেয়র খায়রুজ্জামান লিটন এবং আমাকেই তিনি সময় দেন। আমার এমপি প্রসঙ্গে সিভি হাতে নিয়ে তার পিএসকে রাখতে বললেন। তখন আবারও বললেন এমপি আমি ডিজার্ব করি।

আশরাফ ভাই কথা বলেন কম, কিন্তু সেই কথায় থাকে অনেক দৃঢ়তা। স্বল্পকথায় বড় ‘বার্তা’। তার জানাশোনার পরিধি অত্যন্ত ব্যাপক, বিস্তৃত। তিনি আপাদমস্তক শিষ্টাচারবোধসম্পন্ন মানুষ। শুদ্ধ, সুস্থ রাজনীতির ধারক। ভেতরে-বাইরে সমান সুন্দর তিনি। চিন্তাকর্মে চমৎকার ঐক্য। এককথায় আদর্শ রাজনীতির আইকন, ধ্রুবতারা আশরাফ ভাই। ওপাড়ে অনেক ভালো থাকুন প্রিয় আশরাফ ভাই।

লেখক : আইনজীবী, নারীনেত্রী, প্রাক্তন কমিশনার, চসিক।