বৃহস্পতিবার, ২ মে ২০২৪, ১৯ বৈশাখ ১৪৩১

আমার সৌভাগ্য এখনো বেঁচে আছি : প্রধানমন্ত্রী

প্রকাশিতঃ ২১ অগাস্ট ২০১৯ | ১০:১৫ অপরাহ্ন

 

একুশে প্রতিবেদক:  আমার সৌভাগ্য আমি এখনো বেঁচে আছি। যখনই কোথাও মিটিং বা সমাবেশ করতে গিয়েছি সব জায়গায় কমবেশি হামলা আর বাধার সম্মুখীন হয়েছি। কখনো বোমা, কখনো গুলি, কখনো গ্রেনেড। তবে আমি এসবে কখনো ভীত হইনি। কারণ ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাড়িতে আমার পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে স্বপরিবারে হত্যা করা হয়েছিলো। দেশের বাইরে থাকায় প্রাণে বেঁচে যাই আমি আর আমার বোন শেখ রেহেনা। তারপর যখন আওয়ামী লীগ আমাকে সভানেত্রী করলো আমি মৃত্যুভয়কে উপেক্ষা করে দেশে ফিরে আসি। জীবনের মায়া কিংবা মৃত্যুভয় আমার নেই।

বুধবার,২১ আগস্ট বিকালে রাজধানীর কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে আয়োজিত ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় নিহতদের স্মরণে আয়োজিত শোকসভায় এসব কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা।

তিনি বলেন, সেদিন আমরা সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে মিছি- সমাবেশ করার সিদ্ধান্ত নিই। সেদিন আমাদের নিরাপত্তার জন্য আমাদের কোনো ভলান্টিয়ারকে রমনা থেকে শুরু করে আশেপাশের বিল্ডিংয়ে কিংবা রাস্তায় থাকতে দেয়নি আইনশৃঙ্খলাবাহিনী। আমাদের মিটিং-মিছিলে সবসময়ই বাধা দেয়া হতো। সেদিন কিন্তু ঐধরনের কোনো তৎপরতা দেখা যায়নি। যখন আমি সমাবেশে আসলাম এবং বক্তব্য শেষ করলাম তখন ফটোগ্রাফার গোর্কি এসে বললো ‘আপা আপনার ছবি নিতে পারি নাই’।

যেহেতু গোর্কির বাবাকে আমি চিনতাম অবজারভারের ফটোগ্রাফার ছিলো, সেই সূত্রে তার সাথে পরিচয় ছিলো ছাত্ররাজনীতির সময় থেকে। সেই সাথে আরও কয়েকজন ফটোগ্রাফার বলে উঠলো, আপা ছবি পাইনি। এই ছবি তুলতে গিয়েই কয়েক সেকেন্ড দাঁড়ানো। এরই মধ্যে কিন্তু গ্রেনেড হামলা শুরু হয়ে গেলো। সাথে সাথে আমার পাশে যারা ছিলো বিশেষ করে হানিফ ভাইসহ মানববর্ম তৈরি করে আমাকে নিচে বসিয়ে দিলো। সেসময় কে জানতো যে আর্জেস গ্রেনেড যুদ্ধের ময়দানে ব্যবহার করা হয় সে গ্রেনেড সমাবেশে ব্যবহার করবে? একটা-দুইটা নয়। ১৩টি গ্রেনেড। তার মধ্যে ১২টিই বিস্ফোরিত হয়। ১টি পড়ে থাকে রাস্তায়। আমার নেতাকর্মীদের রক্তে আমার শরীর ভিজে যায়। যখন গাড়িতে উঠি তখন আবার গুলি করা হয়। গুলি এসে লাগে আমার ড্রাইভার মাহবুবের গায়ে। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় ছিলো যে ট্রাকে আমরা সভা করি সেটি সেদিন যেখানে দাঁড়ানোর কথা ছিলো তার থেকে একটু সামনে চলে যায়। আমি ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করি ট্রাক এতো সামনে কেন? সে বলে ব্রেক করায় সামনে চলে গেছে। আসলে আল্লাহর ইশারায় সেদিন বেঁচে যাই।

এরপর সেখান থেকে গাড়ি নিয়ে বের হয়ে স্টেডিয়াম পার হতেই পুলিশের টিয়ারশেল ও লাঠিচার্জ। আমাদের নেতাকর্মীরা যারা আহতদের উদ্ধার করতে যাচ্ছিলো তাদেরও লাঠিচার্জ করা হচ্ছিলো। পুলিশ এমনটা করছিলো যাতে হামলাকারীরা পালাতে সক্ষম হয়। আরেকটি গ্রেনেড পাওয়া যায় জেলাখানার সামনে। পরে জানতে পারি হামলার জন্য জেলখানা থেকে আসামি চিকিৎসার নাম করে অ্যাম্বুলেন্সে করে বাইরে নিয়ে আসে। পরে জেলখানায় প্রবেশের সময় একটি গ্রেনেড বাইরে ফেলে যায়। আরেকটা গ্রেনেড পাওয়া যায় রমনা গেটের ভেতরে। তাহলে কতো গ্রেনেড ছিলো তাদের? সেদিনের সেই হামলার পর আমাদের কোনো নেতাকর্মী যাতে কোনো চিকিৎসা না পায় তার সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হয়েছিলো। ঢাকা মেডিকেল কলেজে বিএনপির কোনো ডাক্তার ছিলো না। বঙ্গবন্ধু মেডিকেল কলেজে কোনো রোগী ঢুকতে দেয়নি। আমাদের সমর্থনে যেসব ডাক্তার ছিলো তারাই শুধু চিকিৎসা দিয়েছে। ডা. রোকেয়া একাই আইভীসহ ৭০ জনকে এনস্থেশিয়া দিয়েছে। সে এক বীভৎসতা।

প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, সেদিনের ঘটনার পরদিনই সকালে সিটি কর্পোরেশনের গাড়ি এসে পুরো ঘটনাস্থলে পানি ছিটাতে থাকে। আমি নানককে বললাম তাড়াতাড়ি ব্যবস্থা নাও। ওরা সব আলামত মুছে ফেলছে। আমাদের নেতাকর্মীরা সাথে সাথে সেখানে গিয়ে বিস্ফোরণের স্থানগুলোতে লাল পতাকা দিয়ে দেয়। অথচ সরকারের পক্ষ থেকে আলামত রক্ষার কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। পরে সেখানের অবিস্ফোরিত একটি গ্রেনেডসহ আলামত সেনাবাহিনীর এক অফিসার এসে নিয়ে যায়। কিন্তু সে গ্রেনেডটি যখন অফিসারটি রেখে দিতে চায় তখন তার চাকরি চলে যায়। পরে গ্রেনেডটি নষ্ট করে ফেলা হয়। তার মানে এই ঘটনার কোনো আলামতই যেন না থাকে সেই চেষ্টাটাই তারা করেছিলো। পরে হাইকোর্টের একজন বিচারককে দিয়ে একটি তদন্ত কমিটি করা হয়। সেই বিচারকের নাম ছিলো জয়নাল আবেদিন। সেখানে একজন সাধারণ লোক ধরে নিয়ে এসে তাকে জজ মিয়া নাম দিয়ে আসামি করা হয়। বলা হয় সে নাকি হামলার মূল হোতা। সে নাকি হামলা করেছে। পরে শোনা যায় তারেক জিয়া অর্থাৎ খালেদা জিয়ার বড় ছেলে ঘটনার আগের দশ মাস তার শ্বশুর বাড়ি এসে থাকে। ১৫ আগস্ট সে ক্যান্টনমেন্টের বাড়িতে চলে যায়। আর সেই শ্বশুর বাড়িতেই বসে পুরো পরিকল্পনা করা হয়। আর তারা রটালো শেখ হাসিনা হ্যান্ডব্যাগে করে গ্রেনেড নিয়ে নিজেই গ্রেনেড মেরেছে। এই কথা খালেদা জিয়া থেকে শুরু করে তাদের সকল নেতাকর্মীদের মুখে মুখে রটিয়ে দেয়া হলো। আমরা নাকি আত্মহত্যা করতে গিয়েছিলাম।

ঘটনার পুরো দায় তৎকালীন বিএনপি-জামাত সরকারের উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তখনকার জামাত-বিএনপি সরকারের মদদেই আমাদের উপর এই নারকীয় হামলা করা হয়। তাদের উদ্দেশ্য ছিলো আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন করা। এটা এখন প্রমাণিত সত্য। যার জন্য এতোদিন পরে মামলা করে আমরা একটা রায়ও পেয়েছি। আশাকরি এর বিচার হবে। কিন্তু যাদেরকে হারিয়েছি তাদেরকে তো আর ফেরত পাবো না।

শেখ হাসিনা আরও বলেন, একটা কথা আছে ‘আল্লাহর মাইর দুনিয়ার বাইর’। যে শিক্ষা খালেদা জিয়া আমাকে দিতে চেয়েছে আজ তিনি তা পেয়েছেন। আল্লাহর মাইর বলে একটা কথা আছে। এটা হলো বাস্তবতা। তিনি তো সেসময় প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ছিলো তাঁর অধীনে। বাবর তো ছিলেন প্রতিমন্ত্রী। যদিও খালেদা জিয়াকে আসামি করা হয়নি। তারপরও তিনি এই ঘটনার কোনো দায় এড়াতে পারেন না।

দলের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক, তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ ও উপ-প্রচার সম্পাদক আমিনুল ইসলাম আমিনের সঞ্চলনায় শোকসভায় প্রধানমন্ত্রী ছাড়াও বক্তব্য রাখেন দলের উপদেষ্টা আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহামেদ, সভাপতি মন্ডলীর সদস্য অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন, মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া, সাবেক মেয়র মোহাম্মদ হানিফের সন্তান ও বর্তমানে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকনসহ দলের সিনিয়র নেতৃবৃন্দ।