পলিথিনের আগ্রাসন জলাবদ্ধতা ও পরিবেশ দূষণের কারণ


হাসিনা আকতার নিগার : পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর নিষিদ্ধ পলিথিন ব্যাগের ব্যবহার সারাদেশে প্রকাশ্যে চলছে। বাজারে মাছ-মাংস, শাক-সবজি সহ সবকিছুই বহনে বিক্রেতারা পলিব্যাগ ব্যবহার করে। দেশে আইনের কার্যকর প্রয়োগ না থাকায় দেদারছে চলছে নিষিদ্ধ পলিথিনের উৎপাদন, বাজারজাত, বিক্রি ও ব্যবহার। কঠোর আইন থাকা সত্ত্বেও আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর দুর্নীতি ও অবহেলার কারণে বন্ধ হচ্ছে না নিষিদ্ধ পলিথিনের উৎপাদন ও ব্যবহার।

পলিথিন ব্যবহার সংক্রান্ত আইনের দিকে ফিরে তাকালে দেখা যায়, পরিবেশ আইন ১৯৯৫ কে ২০০২ সালে সংশোধন করে নতুন আইনে বলা হয়, ‘আইন অমান্য করে পলিথিন উৎপাদন করলে ১০ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড ও ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানা করা হবে। পলিথিন বাজারজাত করা হলে ছয় মাসের জেল ও জরিমানা করা হবে ১০ হাজার টাকা।’ এ আইনের প্রথম দিকে সরকারের আহব্বানে সাড়া দিয়ে ক্রেতারা পাট ও কাগজের ব্যাগ ব্যবহার শুরু করলেও তদারকির অভাবে এ উদ্যোগ ভেস্তে যায় বার বার। যার ফলে বর্তমানেও পলিথিনের ব্যবহার বিদ্যমান।

পরিবেশ অধিদফতরের মতে, দেশের সিংহভাগ নাগরিক পলিথিন শপিং ব্যাগের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে সচেতন। এমনকি ৯০ ভাগেরও বেশি নাগরিক এর উৎপাদন বন্ধের পক্ষে হলেও সহজলভ্য হওয়ায় তারা এর ব্যবহার করেন। এছাড়া স্বল্পমূল্য, স্থায়িত্ব এবং পানিরোধক সুবিধাও পলিথিন ব্যাগ ব্যবহারের অন্যতম কারণ। বিশেষজ্ঞদের মতে, অবৈধ উৎপাদন, আইনের যথাযথ প্রয়োগের অভাব, দুর্বল মনিটরিং ব্যবস্থা, পলিথিনের বিকল্প পাট, কাপড় ও কাগজের ব্যাগ সহজলভ্য ও সুলভ মূল্য না হওয়া এবং বিকল্প ব্যাগ ব্যবহারে মানুষের অনভ্যস্থতায় পলিথিনের যথেচ্ছ ব্যবহার বন্ধ হয়নি। এক সমীক্ষা অনুযায়ী, ঢাকা শহরের একটি পরিবার প্রতিদিন গড়ে চারটি পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার করে। সে হিসাবে প্রতিদিন প্রায় এক কোটি পলিথিন ব্যাগ একবার ব্যবহার শেষে ফেলে দেওয়া হয় যত তত্র। যা প্রতিনিয়তই বিপন্ন করছে পরিবেশকে।

শুরুতে সঠিক উদ্যোগের অভাব, সচেতনা সৃষ্টি ও ক্ষতিকর দিকগুলো প্রচার না পাওয়ায় পলিথিনের ব্যবহার উৎসাহিত হয় মানুষ। বাজারের থলি হাতে নিয়ে কেনাকাটা করতে যাওয়ার চিরায়ত অভ্যাসকে পাল্টে দিয়েছে এই পলিথিন। শুধু নগর, মহানগর, শহর-বন্দর নয়; পলিথিন দুষণের ভয়াবহতা আজ ছড়িয়ে পড়েছে গ্রাম-গঞ্জেও। এখানে সেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়া পলিথিন আমাদের স্বাস্থ্য ও পরিবেশকে প্রতিনিয়ত ঠেলে দিচ্ছে বিপদজনক পর্যায়ে।

পলিথিনের কারণে ইতিমধ্যে ড্রেনেজ ব্যবস্থা অকেজো হয়ে পড়েছে। যেকোন ড্রেন বা সুয়ারেজ লাইনের দিকে তাকালেই দেখা যায়, তা পলিথিনের দখলে। নর্দমা, খাল-বিল, পুকুর, জলাশয়, খেলারমাঠ, দালান-কোঠার আনাচে কানাচে থেকে শুরু করে সব জায়গাতেই ব্যবহৃত পলিথিন যত্রতত্র পড়ে আছে। এভাবে পলিথিন চারদিকের পরিবেশকে গ্রাস করছে।

সর্বপ্রথম ১৯৮২ সনে পলিথিনের ব্যাগ ব্যবহার শুরু হয়। সস্তা ও সহজলভ্যতার কারণেই এটি দ্রুত বিস্তৃতি পায়। এক সমীক্ষায় জানা গেছে শুধু ঢাকা শহরেই প্রতিদিন প্রায় ৬০ লক্ষ পলিথিন ব্যাগ ব্যবহৃত হয়। ব্যবহৃত পলিথিনের শতকরা ৮০ ভাগই এখানে সেখানে ফেলা হয়। এর মধ্যে মাত্র ২০ ভাগ অপসারণ করা সম্ভব হয়।

পলিথিন পরিবেশের এমন এক শত্রু যার কোন ধ্বংস নেই, বিনাশ নেই। পুড়িয়েও একে বিনাশ করা যায় না। পলিথিন পোড়ালে সৃষ্ট গ্যাস হতে কার্বন মনো-অক্সাইড, কাবর্ন-ডাই-অক্সাইডসহ অন্যান্য গ্যাস বায়ু দূষণ ঘটায় এবং তা স্বাস্থ্যের জন্য খুবই ক্ষতিকর। এজন্য আমাদের পলিথিন বর্জন ছাড়া আর কোন উপায় নেই।

পলিথিন তৈরীর ইথিলিন, পলিকার্বনেট, পলি প্রোপাইলিন ইত্যাদি রাসায়নিক যৌগ বা পলিমারের অনুগুলো পরস্পর এতো সুষ্ঠুও শক্তভাবে থাকে যে, সেখানে কোন অনুজীব যেমন-ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক প্রবেশ করতে পারে না। ব্যাকটেরিয়া ময়লা, আর্বজনা পঁচিয়ে ও খেয়ে পরিবেশ রক্ষায় সহায়তা করে। অথচ ব্যাকটেরিয়া পলিথিন নষ্ট করতে পারে না বলে এর মরণ নেই। মাটির নিচে বা উপরে অথবা পানিতে সর্বত্রই এটা পচনহীন অবস্থায় শত শত বছর টিকে থাকে। পানিতে অদ্রবনীয় এবং পানিও এর ভেতর দিয়ে চলাচল করতে পারে না। এজন্য যেখানেই পলিথিন সেখানেই বাধা সৃষ্টি হয়।

ফলে ড্রেন ও সুয়ারেজ ব্যবস্থায় বিপর্যয় সৃষ্টি করছে পলিথিন। সারা দেশেই ড্রেনেজ ব্যবস্থাকে চালু রাখতে ও পরিবেশকে রক্ষায় পলিথিন বর্জনের বিকল্প নেই। কারণ এর ফলে সৃষ্ট জলাবদ্ধতায় নর্দমা, নিচু জায়গা, ড্রেন গুলোর পানি নিষ্কাশন বন্ধ হয়ে পানি বিষাক্ত হয়ে যায়। আর জলাশয় পরিণত হয় মশা, মাছির প্রজনন কেন্দ্রে। আর এ মশা মাছি নানা ধরনের জীবাণুর বাহক এবং রোগের কারণ।

চিকিৎসকদের মতে, দীর্ঘদিন পলিথিন ব্যবহার চর্ম রোগ, ক্যান্সারসহ অন্যান্য স্বাস্থ্যগত সমস্যার কারণ। এছাড়া পলিথিন মাটির জন্যও ক্ষতিকর। শুধু খাদ্য উৎপাদন, গবাদিপশুর রক্ষা ও পানির সুরক্ষার জন্য মাটির দূষণ রোধ করা জরুরি। আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ইরি) মতে, পলিথিন মাটির উর্বরতা হ্রাস করে। পলিথিনের কারণে মাটির অনুজীবগুলোর জন্য বেঁচে থাকার প্রতিকূল পরিবেশ সৃষ্টি হয়। ফলে অনুজীবের শারীরবৃত্তীয় কার্যকলাপ ব্যাহত হয়ে সেগুলো মারা যায়। এতে করে মাটির গঠন পরিবর্তন হয়ে যায়। স্তরে স্তরে জমা হয়ে যাওয়া পলিথিন বহুতল ভবন নিমার্ণের জন্যও ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে।

বর্তমানে বে আইনীভাবে ব্যবহৃত পলিথিনের জটলায় আটকে আছে দেশের সব নালা-খন্দ থেকে শুরু করে ঢাকার বুড়িগঙ্গা, চট্রগ্রামের চাক্তাই খাল সহ অন্যান্য ঐতিহাসিক খাল, নদ নদী। বিভিন্নভাবে এই পলিথিন যাচ্ছে মাটির তলায়, জলের শরীরে। ঢাকা ও চট্রগ্রাম শহরের পয়ঃনিষ্কাশনের ৮০ ভাগ ড্রেন পলিথিন ব্যাগ কর্তৃক জমাট বেধে আছে। যার ফলে সামান্য বৃষ্টি হলেই রাজধানীতে দেখা দেয় অসহনীয় জলাবদ্ধতা। আর চট্রগ্রামে বৃষ্টি ছাড়াও জোয়ার ভাটার পানিতে ডুবে ভয়াবহ ভোগান্তিতে পড়ে নগরবাসী।

নিষিদ্ধ পলিথিনের ব্যবহার দিন দিন কমার কথা থাকলেও এর ব্যবহার বাড়ছে আশঙ্কাজনক হারে। খুচরা এবং পাইকারি বাজার ও শপিংমলসহ সর্বত্রই ব্যবহৃত হচ্ছে নিষিদ্ধ পলিথিন। ব্যবসায়ীদের সূত্র মতে চলতি সময়ে ব্যবসায়ীদের সূত্র মতে চলতি সময়ে বাংলাদেশে প্রতিদিন ১ কোটি ২২ লাখ পলিথিন ব্যবহার হচ্ছে। এভাবে পলিথিনের ব্যবহার বাড়তে থাকলে পরিবেশের মহাবিপর্যয়ের আশঙ্কা রয়েছে বলেও ধারণা পরিবেশবাদীদের।

আইনগতভাবে এর ব্যবহার নিষিদ্ধ হলেও জনসচেতনতার অভাবে সারাদেশে এর মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার পরিবেশকে বিপর্যস্ত করে তুলছে। অবৈধ উৎপাদন, আইনের যথাযথ প্রয়োগের অভাব, দুর্বল মনিটরিং ব্যবস্থা, পলিথিনের বিকল্প ব্যাগ ব্যবহারে মানুষের অনভ্যস্থতায় পলিথিনের যথেচ্ছ ব্যবহার বন্ধ হয়নি বলেও মনে করেন পরিবেশবিদরা।

অন্যদিকে বাজার ব্যবস্থাপনায় ক্রেতা বা বিক্রেতা, কারো মধ্যেই পলিথিনের ক্ষতি সম্পর্কে সচেতনতা নেই। আবার তাদের সচেতন করতে কোনো উদ্যোগও নেই। আইন থাকলেও নেই প্রয়োগ। বাজারে পাটের ব্যাগ পাওয়া যায়, তবে সেগুলো কেনা বা ব্যবহারের তাগিদ নেই ক্রেতাদের। এ অবস্থায় কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণহীন এ পলিথিন ব্যবহার ঠেকানো যাচ্ছে না।

বাজারে এখন টিস্যু পলিথিনের ব্যবহার চলছে হরদম। সকল সেক্টরেই যা জনপ্রিয়তাও লাভ করেছে, এর আকর্ষণীয় বাহ্যিক দিকে কারণে। কাপড়ের দোকান থেকে শুরু করে ইলেকট্রনি পণ্য কেনার পর এখন বিক্রেতারা টিস্যু পলিথিনেই দ্রব্য সরবরাহ করেন। টিস্যু পলিথিনকে বলা হচ্ছে ‘মুখোশধারী পলিথিন’। কেননা, এতেও ব্যবহার হচ্ছে ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ। কিন্তু এ নিয়ে সরকারে কিংবা যথাযথ কর্তৃপক্ষের কোনো মাথাব্যাথা নেই। সরকার একদিকে পাটজাত পণ্যের ব্যবহারের উৎসাহ দিচ্ছে আবার এই মুখোশধারী পলিথিন উৎপাদন, বিপনন ও সরবরাহকারীদের বিরুদ্ধে সরকারের কোনো অবস্থান বা পদক্ষেপ না থাকাটা রহস্যময়।

বিভিন্ন তথ্যমতে, চকবাজারে এইচডিপি পলিথিন প্রতি পাউন্ডের দাম পড়ে ৫৫-৬০ টাকা। এর চেয়ে উন্নতমানের পলিথিন বিক্রি হয় প্রতি পাউন্ড ৭০-৮০ টাকায়। চকবাজারের পাইকারি পলিথিন ব্যাগের দোকানগুলো সারাদেশের খুচরা ও পাইকারি ক্রেতাদের কাছে পলিথিন ব্যাগ সরবরাহ করে। বাংলাদেশ পলিপ্রোপাইল প্লাস্টিক রোল এন্ড প্যাকেজিং এসোসিয়েশনের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বর্তমানে সারাদেশে এক হাজার পলিথিন ব্যাগ উৎপাদনকারী ছোট-বড় কারখানা রয়েছে। এর মধ্যে সাতশ’টি কারখানা ঢাকাসহ পুরান ঢাকার কোতোয়ালি, চকবাজার, সূত্রাপুর, মিরপুর, কারওয়ান বাজার, তেজগাঁও, কামরাঙ্গীরচর ও টঙ্গীতে প্রচুর ছোট-বড় পলিথিনের কারখানা রয়েছে। বাকিগুলো ঢাকার বাইরে অবস্থিত। এরা আইনের তোয়াক্কা না করেই পলিথিন উৎপাদন করে পরিবেশকে বিপন্ন করেছে।

পলিথিনের ক্ষতিকর দিক অনেক। একারণে পলিথিন নিষিদ্ধের আইন কার্যকর করা জরুরী। পরিবেশকে দ্রুত রক্ষার জন্য সারাদেশ থেকে পলিথিনের মূলোপাটন করা জরুরি। পলিথিনের স্থলে কাগজ ও চটের ব্যাগ, যা সহজেই মাটিতে মিশে যায়, সেগুলোর ব্যবহারের উপর জোর দিতে হবে। তাছাড়া এগুলো পচলে মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি পায় এবং জলাবদ্ধতার আশংকা হ্রাস পাবে।

লেখক: কলামিস্ট