শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

‘বিজয়ের শেষ ৩ দিন পাগলা কুকুরের মতো আচরণ করে হানাদার বাহিনী’

প্রকাশিতঃ ১৩ ডিসেম্বর ২০১৯ | ৯:২৪ অপরাহ্ন


বাসস : বিজয়ের শেষ ৩ দিন ছিল আতংক-ভয়, উৎসব-উচ্ছ্বাসের চট্টগ্রাম। পাশাপাশি ছিল ব্যাপক গুজবও। পরাজয় নিশ্চিত জেনে পাক হানাদার বাহিনী পাগলা কুকুরের মতো আচরণ করে। এসময় তাদের রসদ গোলাবারুদ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তারা ঘরে ঘরে দোকানে দোকানে ঢুকে লুটতরাজ চালায়।

আজ সকালে চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক মিলনায়তনে ‘বিজয়ের শেষ ৩ দিন, কেমন ছিল চট্টগ্রাম’ শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনায় অংশ নিয়ে একাত্তরের ১১ বীর মুক্তিযোদ্ধা স্মৃতিচারণে এ অভিমত ব্যক্ত করেন।

আলোচনায় মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে অংশ নেন ডা. মাহফুজুর রহমান, মোহাম্মদ হারিছ, এবিএম খালেকুজ্জামান দাদুল, আবু সাঈদ সরকার, জাহাঙ্গীর চৌধুরী (সিইনসি), অধ্যাপক মোহাম্মদ মইন উদ্দিন, ফেরদৌস হাফিজ খান রুমু (সিইনসি), রেজাউল করিম চৌধুরী, মোহাম্মদ শাহাবুদ্দিন, মোজাফফর আহমদ, মনজুরুল আলম মঞ্জু।

বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা (বাসস) চট্টগ্রাম অফিস এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। অনুষ্ঠান উদ্বোধন করেন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন। পরিচালনায় ছিলেন বাসসের চট্টগ্রাম ব্যুরো প্রধান কলিম সরওয়ার।

মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ হারিছ বলেন, এ মহান মুক্তিযুদ্ধের নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। চট্টগ্রামে ৩ ডিসেম্বর থেকে ১৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত ভয়াবহ যুদ্ধ হয়। চট্টগ্রাম নগরীর হালিশহর, ওয়্যারলেস ও বিহারি কলোনিতে পাকিস্তানিরা বসবাস করতো। ওয়্যারলেস কলোনিতে যে বাঙালিকে তারা ধরে নিয়ে গেছে সে আর ফিরে আসে নাই। রেল দাঁড় করে বাঙালি যাত্রীদের নামিয়ে তারা জবাই করেছে।

মাহফুজুর রহমান বলেন, চট্টগ্রামে ফৌজদারহাট, পতেঙ্গা, আমিন জুট মিল এলাকায় কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্ত মতে একযোগে শতাধিক অপারেশন হয়েছিল। ৩ ডিসেম্বর বন্দরের অয়েল ডিপোতে বিমান আক্রমণ হয়। তখন যোগাযোগ ব্যবস্থা বলতে গেলে ছিলই না। আফসোস করতাম, হাতে যদি একটি রাইফেল থাকতো গুলি করে বিমান ফেলে দিতাম। তখন আগ্রাবাদের একটি নালায় ডুকে নাক উঁচু করে অবস্থান নেয়ার স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, নাকের পাশ দিয়েই তখন যাচ্ছিল মলমূত্রসহ আবর্জনা।

জাহাঙ্গীর চৌধুরী বলেন, সিটি কলেজের ছাত্র ছিলাম। যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত না থাকায় পুরো মুক্তিযুদ্ধের চিত্র কেউ দেখেননি। একটি হাতিকে যে আংশিক দেখেছে তার কাছে মনে হয় ‘মূলার মতো বা কুলার মতো’। তেমনি মুক্তিযোদ্ধারাও অনেকে অনেককে চেনেন না। অনেক অপারেশন সম্পর্কে জানেন না।

তিনি বলেন, ২৩ মার্চ নৌবাহিনীর পোশাক পরে লাঠি হাতে মার্চপাস্ট করে সবাইকে লালদিঘি মাঠে নিয়ে আসি। মার্চপাস্ট শেষ হয় চকবাজারে। ২৫ মার্চ স্টেশনের অনেক কুলির অবদান দেখেছি। ভারতের হরিণা ক্যাম্পে আমাদের গ্রুপের ১৪ জন ছিলাম।

আবু সাঈদ সর্দার বলেন, জাতীয়ভাবে ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস হলেও, চট্টগ্রাম সম্পূর্ণভাবে মুক্ত হয় ১৭ ডিসেম্বর। ১৪-১৭ ডিসেম্বর তিনি ছিলেন আগ্রাবাদ এলাকায় মৌলভী সৈয়দের বেস ক্যাম্পে। তখন ওয়ারল্যাস ছিল না বলে খুব দূরের খবর পেতেন না।

তিনি বলেন, ১৪ ডিসেম্বর ৩০০ গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা একত্রিত হই মুহুরী পাড়ার বিলে। হঠাৎ একটি মাইক্রোবাস আসে। বাঙালি চালক ছিলেন। দুইজন বিহারিকে পাই। তাদের ধরে মাটির দোতলায় আমাদের গোয়েন্দা সেলে নিয়ে যাই। তাদের তথ্য মতে নগরীর একটি হোটেল থেকে চারজন মেয়েকে উদ্ধার করি। কিছু অস্ত্রও পাই।

পাকিস্তানি সেনাদের টর্চার সেল খ্যাত চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে প্রথম বাংলাদেশের পতাকা উড়ানো মুক্তিযোদ্ধা এবিএম খালেকুজ্জামান দাদুল বলেন, চট্টগ্রামে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েছিল লালদিঘি মাঠ থেকে। সেখানে মার্চের শুরু থেকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও নাটক হতো। পুরো নয় মাস চট্টগ্রামজুড়ে পাকিস্তানি সৈন্যরা ভয়ংকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছিল। সার্কিট হাউজ ছাড়াও পুলিশ লাইন ও সাকা চৌধুরীর গুডস হিলসসহ কয়েকটি টর্চার সেল ছিল। ১৬ তারিখ সকালে সার্কিট হাউজে গিয়ে একটা ডক্যুমেন্ট পাই। সেখানে চট্টগ্রামের কারা আওয়ামী লীগ করেন এবং কাদের মারতে হবে তার লিস্ট উদ্ধার করি। পাকিস্তানের পতাকাটা নামিয়ে চট্টগ্রাম কলেজের ছাত্র শামীমসহ বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে দেই সার্কিট হাউজে।

মোহাম্মদ মইন উদ্দিন বলেন, আমি মায়ের একমাত্র সন্তান ছিলাম। আমার মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণটা তিনি কিভাবে যে সহ্য করেছেন এটা আপনাদের বলে বুঝাতে পারবোনা। বিজয়ের পর আমি বাড়ি ফিরে গেলে মা আমাকে ঝড়িয়ে ধরে হুঁশ হারিয়ে ফেলেন। যুদ্ধকালীন মাকে একা ঘরে রেখে যাওয়ার স্মৃতি রোমন্থন করতে গিয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন এই বীর মুক্তিযোদ্ধা।

ফেরদৌস হাফিজ খান রুমু বলেন, রাউজানের সিইনসি স্পেশাল হিসেবে দায়িত্বে ছিলাম, যুদ্ধকালীন ৭ অক্টোবর আমরা মদুনাঘাট আক্রমণ করি। সেই সম্মুখ যুদ্ধে ৮জন পাকিস্তানি সেনা মারা যায়। একজন মুক্তিযোদ্ধাও মারা যায়। সেই স্মৃতি এখনো আমাকে কাঁদায়।

মোহাম্মদ শাহাবুদ্দিন বলেন, মুক্তিযুদ্ধের শেষ তিন দিন মিরসরাইয়ের দক্ষিণাঞ্চলে ক্যাম্পে অবস্থান করি। এসময় শুনছিলাম প্রচুর মিলিটারি শহর অভিমুখে যাচ্ছে। মানুষের মধ্যে আতঙ্ক, উদ্বেগ ও ভয় দুটোই ছিল। রাতে কিছু বাড়ি লুট হয়। রাজাকার আতাউস সোবহানের জল্লাদখানায় করুণ অবস্থা দেখেছি। চারদিকে মানুষের মাথার খুলি, রক্তের দাগ।

রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, মুক্তিযুদ্ধ বিরাট উপাখ্যান। চট্টগ্রাম শহরে ছিলেন গেরিলা যোদ্ধারা। এর জন্য বেস গড়ে তুলতে হয়। চট্টগ্রাম শহরে ১৪ ডিসেম্বর থেকে আতঙ্ক ছিল। আবার ভেতরে ভেতরে উল্লাসও ছিল। বোমারু বিমানে করে যৌথবাহিনী বোমা বর্ষণ করছিল। এসব বিমান দেখে ছোট ছোট বাচ্চারাও ঘরের ছাদে উঠে হাততালি দিত। জনগণের সাহস বেড়েছিল। জনগণ ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। তাদের বদ্ধমূল ধারণা হয়েছিল বিজয় সন্নিকটে। ১৫ ডিসেম্বর শুনতে পাই কুমিরা যুদ্ধে পাক বাহিনী পিছু হটেছে। কুমিরা ফৌজদারহাটে প্রাণপণ যুদ্ধ হয়। তাদের আশঙ্কা ছিল পাক বাহিনী শহরে ঢুকে পড়লে পরাজিত করা কঠিন হবে।

স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, চান্দগাঁওয়ের ইউনুস রাজাকার রাইফেল নিয়ে ঘুরতো আর বলতো হট যাও হট যাও। একদিন একজন মুক্তিযোদ্ধা মিস ফায়ার দিলে ইউনুস রাজাকার রাইফেল ফেলে দৌড় দেয়।

মোজাফফর আহমদ বলেন, মুক্তিযুদ্ধের কথা বললে আমার মায়ের কথা বলতে হয়। তার চার সন্তানকে যুদ্ধে পাঠিয়েছিলেন। অথচ আমার মা লেখাপড়া জানতেন না। আফসোস মীর কাশিম আলীকে অল্পের জন্য ধরতে পারিনি।
মনজুরুল আলম মঞ্জু বলেন, আমি পদকের জন্য যুদ্ধ করিনি। দেশ স্বাধীনের জন্য যুদ্ধে যাই। পতাকার জন্য যুদ্ধ করি। অনেকের নামে স্কয়ার, সড়ক হচ্ছে। মিত্র ও মুক্তিবাহিনীর নামে স্কয়ার করার জন্য মেয়রের প্রতি অনুরোধ জানান তিনি। বলেন, এর কারণ মিত্রবাহিনীর সহায়তা, অবদান ভোলার নয়।