চট্টগ্রাম : লাগাতর করোনা-দুর্যোগে অসহায়, খেটে খাওয়া নিম্ম আয়ের মানু্ষদের সরকারি-বেসরকারি কিংবা ব্যক্তি-উদ্যোগ- যে যেভাবেই পারছেন খাবার দিচ্ছেন। দিয়েই ছবি তুলছেন। আর সেই ছবি দিচ্ছেন ফেসবুকে। অথবা ছুটছেন গণমাধ্যমের দুয়ারে।
খাবারসামগ্রী বিতরণের নামে এমনই চিত্র যখন চারপাশে, আত্মপ্রচারের উদগ্র তাড়না সমাজে – তখনই এক যুবক একটি কালো মাইক্রোবাসে চড়ে চট্টগ্রাম নগরের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে বেড়াচ্ছেন।
রাস্তার ধারে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে অসহায়ের মতো কাউকে বসে থাকতে দেখলেই নামছেন গাড়ি থেকে। চুুপচাপ হাতে তুলে দিচ্ছেন ৫ কেজি চাল, এক কেজি ডাল, এক কেজি তেল, এক কেজি বাংলা সাবান নিয়ে তৈরি একেকটি প্যাকেট। আর বলছেন, ’এটি শেখ হাসিনা দিয়েছেন।’ এভাবে রিক্সাওয়ালা, দিনমজুর, খেটে খাওয়া কিংবা অসহায় অভুক্ত যেখানেই পেয়েছেন তাদের হাতে তুলে দিয়েছেন খাদ্যসামগ্রীর প্যাকেট, আর সবাইকে বলছেন ওই একটি কথা; ’এটি আপনার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পাঠিয়েছেন।
মঙ্গলবার (৩১ মার্চ) দুপুরে বায়েজিদ এলাকার ইংরেজি মাধ্যম সাইডার ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের গেইটের কাছে উদ্দেশ্যহীনভাবে বসেছিলেন নাসিমা। ৯ বছর বয়সী একটি ছেলেকে নিয়ে বাসা-বাড়িতে কাজ করে নাসিমার জীবন চলে।
করোনা ভাইরাস আতঙ্কে দিন দশেক আগে বাসার মালিক বলে দিয়েছেন নাসিমা আপাতত যেন বাসায় না যায়। বিদায়ের সময় যে ক’টি টাকা দিয়েছিলেন সেই টাকায় একসপ্তাহ চললো মা-ছেলে। কিন্তু গতকাল থেকে নাসিমার বাসায় কোনো খাবার নেই। ক্ষুধার জ্বালায় ছেলেটি সকাল থেকেই কাঁদছে।
কোনো ভরসা না পেয়ে স্কুলের পাশেই ফুটপাত ধরে বসেছিলেন নাসিমা। অমনিই গাড়ি থেকে নেমে যুবকটি নাসিমার হাতে প্যাকেট তুলে দিয়ে বললেন, ’এটা নিন, শেখ হাসিনা পাঠিয়েছেন।’
আনন্দে আত্মহারা নাসিমা দৌড়ে এলেন কলোনিতে। বললেন, ‘দ্যাখো, দ্যাখো শেখ হাসিনা আমার জন্য খাবার পাঠিয়েছেন।’ মুহূর্তে আশপাশে ছড়িয়ে পড়ে সেই খবর- শেখ হাসিনা খাবার পাঠিয়েছেন। কলোনির লোকদের বিশ্বাস হয় না এই কথা। শেখ হাসিনা কোত্থেকে, কীভাবে খাবার পাঠাবেন! গল্প করার জায়গা পায় না নাসিমা!
মজার ব্যাপার হচ্ছে, মঙ্গলবার সন্ধ্যার দিকে ওই এলাকায় বসে থেকে আরও অন্তত কয়েকজন সেই খাবার পেয়েছেন। খাবারভর্তি মাইক্রো বাসটি বারবার ঘোরাঘুরির সময় অপেক্ষমাণ কয়েকজনের হাতে খাবার তুলে দিয়ে শেখ হাসিনার জন্য দোয়া করতে বলা হয়। আর তখনই বিশ্বাস হলো, খাবারগুলো শেখ হাসিনাই পাঠিয়েছেন।
একইভাবে মঙ্গলবার পড়ন্ত বিকেলে পলিটেকনিক্যাল এলাকায় এক যাত্রী নিয়ে রিকশায় প্যাডেল ঘোরাচ্ছেন এক বয়স্ক লোক। দৃশ্যটি দেখেই গাড়ি থেকে নেমে যুবকটি গতিরোধ করেন রিকশার। বলেন, ’চাচা নিন, এখানে চাল, ডাল, তেল, সাবান সবই আছে। শেখ হাসিনা আপনার জন্য পাঠিয়েছেন।’
এই কথায় রিক্সাওয়ালা যতটা না অবাক, তার চেয়েও বেশি অবাক রিক্সাযাত্রী। কৌতূহলী রিক্সাযাত্রী যুবককে আর ছাড়েই না। ভাই, বলুন তো ঘটনা কী, আসলেই কি শেখ হাসিনা দিয়েছেন? হ্যাঁ, শেখ হাসিনাই দিয়েছেন।
চলে যেতেই উজ্জীবিত রিক্সাযাত্রী আগ বাড়িয়ে যুবকটির মোবাইল ফোন নাম্বারটি চেয়ে নেন। এরপর মঙ্গলবার রাত সাড়ে ৭টার দিকে একুশে পত্রিকা প্রতিবেদককে প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ ও যুবকের কৌতূহলী গল্পটি শুনিয়ে তার মোবাইল ফোন নাম্বারটি বাড়িয়ে দেন।
নাম্বারটিতে ফোন করতেই জানা গেলো যুবকের নাম আরিফ, আবু মোহাম্মদ আরিফ। আপনি কিছু খাবারসামগ্রী দিয়েছেন আজ প্রধানমন্ত্রী পাঠিয়েছেন জানিয়ে। আসলেই কি প্রধানমন্ত্রী পাঠিয়েছেন, ব্যাপারটি বলা যাবে?
জবাবে মহানগর ছাত্রলীগের সহ সভাপতি, ভেটেরিনারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা আরিফ বললেন, আমি অতসব জানি না। গাড়িতে কিছু খাবারসামগ্রী তুলে দিয়ে আমাকে বলা হয়েছে, প্রধানমন্ত্রী পাঠিয়েছেন এই কথা বলে যেন ভাসমান মানুষদের কাছে গিয়ে বিলি করি। কোনো ছবি তোলা বা প্রচার করতেও এসময় আমাকে নিষেধ করা হয়েছে।
কে নিষেধ করেছেন, কে বা দিয়েছেন আপনাকে এই খাবার। আরিফের জবাব -মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়ার ছোটভাই ডা. বিদ্যুত বড়ুয়া।
ডা. বিদ্যুত বড়ুয়াকে ফোন করতেই জানা গেলো আসল ঘটনা। মূলত ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়া ঢাকা থেকে শুকনো খাবারগুলো পাঠিয়ে কোনো জনসমাগম না ঘটিয়ে, নিজেকে জাহির না করে বিলি করতে বলেছেন এবং বিলির সময় যেন বলা হয়, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাই খাবারগুলো পাঠিয়েছেন। একইসঙ্গে বিষয়টি প্রচার না করতেও ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়া স্পষ্ট বলে দিয়েছেন বলে জানান ডা. বিদ্যুত বড়ুয়া।