কে এই শিশির শীল, যিনি সাংসদ না হয়েও সাংসদদের সংগঠন এপিপিজি’র সাধারণ সম্পাদক? এই পদে ১৪ বছরই বা বহাল থাকেন কী করে? এমন প্রশ্নের পাশাপাশি সাংসদদের মধ্যে নেতৃত্ব সঙ্কটেরও প্রশ্ন উঠেছে। বলা হচ্ছে, সংসদ সদস্যদের মধ্যে যোগ্য লোক কি নেই যে তাদের সংগঠনে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য বাইরের কাউকে ‘হায়ার’ করতে হবে?
তথ্য মতে, ২০০৩ সালে সংসদে সরকারি ও বিরোধী দলের সদস্যদের নিয়ে অল পার্টি পার্লামেন্টারিয়ান গ্রুপ (এপিপিজি) গঠিত হয়। সংসদের স্পিকার প্রধান উপদেষ্টা এবং ডেপুটি স্পিকার কো-চেয়ারম্যান মনোনীত হন। আর শুরু থেকেই গুরুত্বপূর্ণ এই সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন এই শিশির শীল, যার রাজনৈতিক কোনো পরিচয় নেই।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, নিয়মানুযায়ী অল পার্টি পার্লামেন্টারিয়ান গ্রুপ (এপিপিজি) বাংলাদেশের সদস্য হতে হলে তাকে অবশ্যই সংসদ সদস্য হতে হবে। কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে, সংসদ সদস্য না হয়েও শিশির শীল এপিপিজি’র সাধারণ সম্পাদকের মতো পদ আঁকড়ে আছেন বছরের পর বছর। কার ইশারায়, কোন শক্তিতে যুগপৎ নিয়ম ভেঙে তিনি এই পদে আসীন আছেন- তা রীতিমতো বিস্ময়কর ঠেকেছে অনেকের কাছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আইনপ্রণয়নকারীদের সংগঠনে যদি এধরনের অনিয়ম ও অন্যায় চলে এবং তা বছরের পর বছর সয়ে যাওয়া হয় তাহলে দেশের রন্ধ্রে রন্ধ্রে অন্যায়-অনিয়ম প্রশ্রয় পাওয়া খুবই স্বাভাবিক।
এদিকে, এপিপিজিকে পুঁজি করে সংসদ ভবনের অভ্যন্তরেই শিশির শীল গড়ে তুলেন এনজিও সংস্থা পিপলস এমপাওয়ারমেন্ট ট্রাস্ট (পিইটি) ও এন্টি পোভার্টি ক্যাম্পেইন অব পার্লামেন্ট নামের আরও দুটি সংগঠন।
আশ্চর্য্যরে বিষয় হচ্ছে, জাতীয় সংসদের সঙ্গে এপিপিজি’র কোনো সম্পর্ক না থাকলেও এমপি হোস্টেলের ৩/১০ নম্বর মিনিস্টারস অ্যাপার্টমেন্টের পশ্চিম ব্লকে শিশির শীলের জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে চোখধাঁধানো একটি অফিসকক্ষ। এটি তিনি পেয়েছেন পিপলস এমপাওয়ারমেন্ট ট্রাস্ট (পিইটি)-এর নামে। আর এই কার্যালয়ে বসেই তিনি চালিয়ে যাচ্ছেন তিনটি সংগঠনের কার্যক্রম।
প্রশ্ন হচ্ছে, একটি বেসরকারি এনজিও কীভাবে মিনিস্টারস অ্যাপার্টমেন্টে অফিস পেতে পারে? কারণ, রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ও গোপনীয়তার দিক থেকে মিনিস্টারস অ্যাপার্টমেন্ট অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর এলাকায় অবস্থিত। তাছাড়া শিশির শীল নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি নন, তার এপিপিজিও সরকারি কোনো সংগঠন নয়। এর রেজিস্ট্রেশনও নেই। কিন্তু তা সত্ত্বেও রাষ্ট্রের সংরক্ষিত একটি এলাকায় শিশির শীলকে অফিস দেয়া হয় কিসের ভিত্তিতে। এ নিয়ে কথা উঠলেই শিশির শীল স্পিকারের দোহাই দেন। বলেন, স্পিকার ও সরকার দলীয় চিফ হুইপ তাকে এই অফিস দিয়েছেন।
শুধু তাই নয়, দারিদ্র্যবিমোচনের নামে শিশির শীলের ওই সংস্থাটি ওয়েবসাইটও করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়া ও স্পিকারের ছবি দিয়ে। ওয়েবসাইটের পাতায় ব্যবহার করেন জাতীয় সংসদের লোগো, বাংলাদেশ সরকারের লোগো, এরপর এপিপিজি ও পিইটি’র লোগো, জাতিসংঘের লোগো এবং সবশেষে ২০১৫ সালের মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোল (এমডিজি) এর লোগো।
একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইটে এ ধরনের লোগো ব্যবহার নিয়ে সমালোচনার ঝড় উঠে সংশ্লিষ্ট মহলে। পরবর্তীতে এসব ছবি ও লোগো সরিয়ে নিলেও এখনো এপিপিজির ওয়েবসাইটে জাতীয় সংসদের লোগো শোভা পাচ্ছে।
জানা যায়, শুরু থেকে এইচআইভি-এইডস, মানবপাচার, অভিবাসন, শিক্ষা, সহ¯্রাব্দের উন্নয়ন লক্ষ্য (এমডিজি), দারিদ্র্য বিমোচন কৌশলপত্র (পিআরএসপি) ও জলবায়ু নিয়ে কাজ করার কথা বলে আসছে এপিপিজি। এসব কর্মসূচির জন্য পিইটি কমনওয়েলথ অ্যাডুকেশন ফান্ড, ইউনিসেফ (জাতিসংঘ শিশু তহবিল), ইউএনএফপিএ (জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিল), ইউএনডিপিসহ (জাতিসংঘ উন্নয়নসহ কর্মসূচি) একাধিক উন্নয়ন সহযোগীর কাছ থেকে প্রচুর অনুদান সংগ্রহ করে।
অভিযোগ উঠেছে, জাতীয় সংসদের সর্বদলীয় সংসদীয় গ্রুপ (এপিপিজি) ১৪ বছর ধরে সংসদ ও সাংসদদের নামে উল্লেখিত উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে টাকা আনলেও এর হিসাব তারা সংসদে জমা দেয়নি। সম্প্রতি সংসদ থেকে হিসাব চাইলে হিসাব দূরের কথা, সন্তোষজনক কোনো ব্যাখ্যাও দিতে পারেনি এপিপিজির উদ্যোক্তা সংস্থা পিপলস এমপাওয়ারমেন্ট ট্রাস্ট (পিইটি)।
ফলে স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী বর্তমান দশম সংসদের শুরুতে পিইটি ও এপিপিজির সঙ্গে সংসদের সংশ্লিষ্টতা এবং এর আর্থিক স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেন। তিনি উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে এ পর্যন্ত কী পরিমাণ টাকা এসেছে এবং কত ব্যয় হয়েছে, তার হিসাব জানতে চান পিইটির প্রধান নির্বাহী শিশির শীলের কাছে। কিন্তু কোনো ব্যাখ্যা দিতে না পারায় স্পিকারের নির্দেশে এপিপিজির কার্যালয় সংসদের মূল ভবন থেকে সরিয়ে মন্ত্রী হোস্টেলে স্থানান্তর করা হয়। এ অবস্থায় অচিরেই তাদের মন্ত্রী হোস্টেলের কক্ষও ছাড়ার নির্দেশ দেওয়া হতে পারে বলে জানা গেছে।
এ প্রসঙ্গে স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী বলেন, এপিপিজির সঙ্গে সংসদের প্রাতিষ্ঠানিক কোনো সম্পর্ক নেই। তা সত্ত্বেও সংসদকে কোনো না কোনোভাবে সম্পৃক্ত করা হয়। যে কারণে এর আয়-ব্যয়ের হিসাবে স্বচ্ছতা থাকা উচিত। কিন্তু স্বচ্ছতা পাওয়া যায়নি। অতীতে অনেক ভুল হয়েছে। নতুনভাবে ভুল করে সংসদ কোনো দায় নেবে না।
সূত্র বলছে, ২০০৯ সালের ১৭ অক্টোবর এন্টি পোভার্টি ক্যাম্পেইন অব পার্লামেন্ট-এর ব্যানারে রাজধানীতে জাতিসংঘের নাম ভাঙিয়ে দারিদ্র্য বিমোচন বিষয়ক একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনের আয়োজন করেন শিশির শীল। এই সম্মেলন আয়োজনের সঙ্গে যুক্ত ছিল পিপল্স এমপাওয়ারমেন্ট ট্রাস্ট (পিইটি), ব্রিটিশ সরকারের ডিপার্টমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট (ডিএফআইডি) এবং বাংলাদেশে তৎপর কয়েকটি দেশি-বিদেশি এনজিও।
অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেত্রী খালেদা জিয়া ছাড়াও বিশ্বনেতৃবৃন্দ উপস্থিত থাকার কথা প্রচার করে আন্তর্জাতিক ও দেশিয় বিভিন্ন সংস্থা-প্রতিষ্ঠান থেকে কোটি কোটি টাকা অনুদান সংগ্রহ করা হয়। এ নিয়ে উঠে আসে আরও কিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য।
জানা যায়, ‘আন্তর্জাতিক’ সম্মেলনটি করার জন্য জাতিসংঘের ইউনাইটেড নেশন মিলেনিয়াম ক্যাম্পেইন থেকে শিশির শীল এক লাখ ২৬ হাজার ডলার সাহায্য পাওয়ার
আবেদন করেছিলেন। প্রাথমিকভাবে ৫০ হাজার ডলার অনুদান পান। আবেদনের বাকি টাকা পরবর্তীতে দেওয়ার কথা ছিল। এর বাইরে শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার নাম ভাঙিয়েও কয়েক কোটি টাকা চাঁদা তোলা হয়।
কিন্তু শেষপর্যন্ত বিশ্বনেতৃবৃন্দ দূরের কথা, খালেদা জিয়াও উপস্থিত হননি সেই সম্মেলনে। উপস্থিত ছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, জাতীয় সংসদের তৎকালীন স্পিকার অ্যাডভোকেট আবদুল হামিদ, অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, সংসদের তৎকালীন চিফ হুইপ উপাধ্যক্ষ আব্দুস শহীদসহ সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গ।
জানা যায়, আমন্ত্রণ জানানোর সময় খালেদা জিয়াকে বলা হয়েছিুল, জাতিসংঘের তৎকালীন মহাসচিব বান কি মুন, ভারতের কংগ্রেস নেত্রী সোনিয়া গান্ধী, তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন এবং নোবেল বিজয়ী অমর্ত্য সেন এই সম্মেলেনে যোগ দেবেন। সম্মেলনে কোনো আন্তর্জাতিক অতিথি আসছেন না জানতে পেরে খালেদা জিয়া শেষপর্যন্ত উপস্থিত হননি। আর উপস্থিত না হওয়াকে কেন্দ্র করে খালেদা জিয়া বাংলাদেশের দারিদ্র্য বিমোচন চান না, তিনি বাংলাদেশ এগিয়ে যাওয়ার বিপক্ষে- এমনতর সমালোচনার ঝড় উঠে দেশজুড়ে।
পরে দেখা গেল, এটি আদৌ কোনো ‘আন্তর্জাতিক’ সম্মেলন ছিল না। জাতিসংঘের নাম ব্যবহার করে বাংলাদেশের দারিদ্র্য নিয়ে নোংরা রাজনীতি করা এবং বিশেষ একটি এনজিও’র জন্য ফান্ড জোগাড় করাই ছিল সম্মেলনের মূল উদ্দেশ্য।
অভিযোগ আছে, সম্মেলনের মাধ্যমে ব্যক্তিবিশেষের পকেট ভারি হলেও সম্মেলনে ব্যবহৃত ডেকোরেটর, রেন্ট-এ কারের কোম্পানি, মঞ্চ নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান, খাবার সরবরাহকারী হোটেলসহ অনেকের পাওনা পরিশোধ করা হয়নি। নাম প্রকাশ না করার শর্তে পিইটি’র এক কর্মচারি জানান, অনেক পাওনাদারের মাত্র ১০-৩০ শতাংশ টাকা দিয়েই কেটে পড়েন শিশির শীল।
পাওনাদার সবারই এক কথা, দুই নেত্রী উপস্থিত হবেন বলেই তারা এত বিপুল অর্থের কাজ বাকিতে করেছিলেন। তাছাড়া তাদের বোঝানো হয়েছিল, সম্মেলনটি সরকারিভাবে আয়োজিত হচ্ছে। সুতরাং টাকা মার যাবে না।
এদিকে, এই সংগঠনের ব্যানারে সংসদ সচিবালয় ও সরকারি খরচে বিশ্বের এমন কোনো দেশ নেই যেখানে তিনি যাননি। সংসদ ও সরকার সম্পর্কিত নানা প্রোগ্রাম ছাড়াও কমনওয়েলত, জাতিসংঘের বিভিন্ন উন্নয়ন-সহযোগীর আন্তর্জাতিক অনুষ্ঠানের তিনি নিয়মিত পার্টিসিপেন্ট তিনি। এই অংশগ্রহণের মধ্যদিয়ে অনুষ্ঠান আয়োজক ও সরকারের কোনো উদ্দেশ্য সাধন না হলেও শিশির শীলের উদ্দেশ্য সাধন হয় ঠিকই।
২০০৩ সালের পর থেকে প্রায়সব জলবায়ু সম্মেলনে অংশগ্রহণের নামে বিদেশের মাটিতে গিয়ে শিশির শীলের পিকনিক করা নিয়মিত ঘটনায় পরিণত হয়েছে। আর এই পিকনিক পার্টিতে নিয়ে যান তার পছন্দের লোকজনকে। সদ্য সমাপ্ত মরক্কো জলবায়ু সম্মেলনেও অনুদানের টাকায় দলবল নিয়ে যোগদান করেন শিশির শীল। সেখানে গিয়ে তিনি মদ্যপান ও আমোদ-ফূর্তিতে মেতে ওঠেছেন বলে সম্মেলনে অংশ নেয়া বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের কয়েকজন সদস্য জানিয়েছেন।
এসব বিষয়ে কথা বলার জন্য বুধবার (১৪ ডিসেম্বর) একাধিকবার শিশির শীলের মোবাইল ফোনে রিং করা হয়। কিন্তু তিনি ফোন ধরেননি। এরপর একুশে পত্রিকার পক্ষে কথা বলার প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করে এসএসএম পাঠানো হয় তার মোবাইল ফোনে। তাতেও তিনি কোনো রেসপন্স করেননি।