বিধাতা, এই যাত্রায় আমাদের রক্ষা করুন…

বিপ্লব বড়ুয়া : এখনই নিজেকে নিয়ে নতুন করে ভাবার যথোপযুক্ত সময়। জীবনের প্রয়োজন অতিরিক্ত ক্ষুধা নিবারণের দৌড়ঝাঁপ কত যে দীর্ঘ তা এই নির্ঘুম সময়ে হাড়ে হাড়ে উপলবব্ধি করতে পারছি। কোথায় যেনো পড়েছিলাম, বাংলা ভাষায় উচ্চারিত সর্বাপেক্ষা শব্দটি নাকি – ‘দাও ‘. এটা দাও, ওটা দাও, মধুর মিলনের…দাও, সোনায় সোহাগা সন্তান-সন্ততি দাও, ওদের সহসা বড় মানুষ করে দাও, পরীক্ষায় সফলতা এনে দাও, খোদা প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করে দাও, প্রভাবশালী করে দাও, সিংহাসনে বসিয়ে দাও ইত্যাদি ইত্যাদি।

শুধু দাও আর দাও! এগুলো ব্যঙ্গ-রসাত্মক শোনালেও আসলেই তাই! আমাদের চাওয়া অন্তহীন। সাধারণ দৃষ্টিকোণ হতে সহজেই অনুমেয়, এই বিশ্ব পরিমণ্ডলের জানা-অজানায় কত হাজারে হাজার মানুষ কতই না দুঃখ-দুর্দশার মধ্যে দিয়ে দিনাতিপাত করছে জন্মলগ্ন হতে।

আবার এমন কিছু হৃদয়বিদারক পরিস্থিতির রোষানলে অনেকের বসবাস, যেটার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ রিমের পর রিম কাগজে লিখেও উপসংহারে আসা প্রায়ই অসম্ভব! তারপরও মানুষ বাঁচার তাগিদে নিত্য লড়াই করে যাচ্ছে।

যেটা উল্লেখ করার অভিপ্রায়ে আজকের এই প্যানপ্যানানি, সে কথায় আসা যাক। আমাদের সামগ্রিক অবস্থা, অনেকের চাইতে অনেকগুণে ভালো ও শ্রেয়। তথাপি আমাদের মধ্যে ‘দাও’ শব্দটির স্বপ্নীল চাওয়া অপেক্ষাকৃত অবহেলিত মানুষগুলোর চেয়ে ঢের বেশি! মূলত যাদের সম্মুখপথ কিছুটা মসৃণ তারাই আরো বেশি বেশি ‘দাও’ (পাওয়ার এবং ভোগের নেশা ) -এর জন্যে মরিয়া থাকে!

আমি নিজেও কম কিসে? জন্মেছিলাম, অজোপাড়া গাঁয়ে। যেথায় বিজলিবাতি ছিলো না, ছিলো না টেলিযোগাযোগের কোনো মাধ্যম! কেরোসিনের আলোতে (লেম্পো, চেরাগ), হারিকেন দিয়ে রাতের পর রাত কাটিয়েছি। খোলা আকাশের নিচে, ঝুপ ঝুপ বৃষ্টির নুপুর শব্দে কেটেছে কত বিনিদ্র রজনী!

দিনবদলের পালাক্রমে ঢাকা। কলেজ জীবন পেরিয়ে কলকাতা, ব্যাংকক, শ্রীলংকা, বার্মা , লাওস, সিঙ্গাপুর , দক্ষিণ কোরিয়া , জাপান, ইংল্যান্ড, সুইডেন ঘুরে কানাডা। অন্য আরো দশজনের মতো Lawyer , Immigration , Refuge Board সবকিছু উতরিয়ে কর্মসংস্থান খুঁজে নেওয়া। কিছু বছর পরে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ, পিতার ডাক শুনতে পাওয়া, আনুষ্ঠানিক আরো কত কী! এতকিছুর পরে ও চাওয়ার কোনো স্থবিরতা নেই!

কালের বিবর্তনে মানবজাতি আজ তার ক্রান্তিকাল অবলোকন করছে। ধরাতলের কোথাও গিয়ে কিছুটা সুস্থতায় নিশ্বাস নিবো, তার কোনোই নিশ্চয়তা নেই। সৃষ্টির সেরা জীবের আচানক পদবী গ্রহণ ও বহন করে পূরো মানবগোষ্ঠী আজ সম্পূর্ণরূপে কোনঠাসা এবং বিপর্যস্ত। কে রক্ষিবে বা কেমনে রক্ষিবে তার কোনো কূল-কিনারা আজো বিদঘুটে অন্ধকারের স্রোতে হাবুডুবু খাচ্ছে।

আজ সবারই একই আরাধনা- বিধাতা এই যাত্রায় আমাদের রক্ষা করুন! মনে রাখা খুবই জরুরি, কার্যকারণ ব্যতীত এই ধরাধামে কিছুই ফলপ্রসূ হয় না।সহজ কথায় – ভালো কাজের সুফল, মন্দ কাজের কুফল! এই সহজতর উপলব্ধিকে আলোকিত করার মানসে আমাদের ভোগ-বিলাসের মাত্রাকে সংবরণ করতে হবে!

মৃত্যু যখন হাতছানি দিচ্ছে, সকল কামনা-বাসনায় যখন সংকীর্ণতার মোড়কে আবদ্ধ, বেঁচে থাকাটাই যখন একমাত্র অবলম্বন-তবে এখনই মোক্ষম সময় আমাদের চাওয়া-পাওয়ার তৃষ্ণাকে সংকুচিত করা। পূজা অর্চনার পাশাপাশি এই হোক আমাদের দুর্ঘম মুহূর্তের শপথ – মানবিক মূল্যবোধ যাতে আমরা আর কোনোকিছুর বিনিময়ে ভূলুন্ঠিত না করি।

মানুষের কল্যাণে যেন সবসময় নিজেদের আত্মনিয়োগে সচেষ্ট থাকি! কিছু সময়ের ব্যবধানে সবাইকে চলে যেতে হবে, তবে কেন আমাদের এতো এতো পাওয়ার নেশা! অন্যকে কিছু সাদরে দেয়া কিংবা শেয়ার করার মধ্যে যে অবারিত সুখানুভুতি আর আনন্দ নিহিত-তা কেবল সে জনাই তার নির্যাস সাধ অনুভব করেন, যিনি সে মহৎকাজে নিজিকে সঁপে দিয়েছেন।

সুন্দরতা আরো সৌন্দর্যমণ্ডিত হয়, আলো আরো বেশি আলোকিত হয় যখন সততা আর ত্যাগের মহিমায় অন্যের কল্যাণে কিছু মাঙ্গলিক কার্য সম্পাদিত হয়।

যে তীরন্দাজ আজ সবার জীবন-মরণের সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে, তা হতে মানসিক প্রশান্তির খানিকটা নির্মল আনন্দ পাওয়ার নিমিত্তে চলুন সবাই কিছুটা ত্যাগী, সংযমী আর মিতব্যয়ী হওয়ার জন্যে নিজেদের তৈরি করি।

সুখের অনুভূতি আপেক্ষিক। সে অনুভূতির ছোঁয়া পেতে হলে দুঃখীজনের মুখে হাসি ফোটানো চাই। যে হাসি সর্বদা অম্লান, চিরসবুজ আর চিরঞ্জীব।

পূর্বাপেক্ষা চলমান অশনিসংকেতের অগ্রজ কোনো পরিবর্তন হয়নি বরং বেড়েই চলেছে হুড়হুড় করে মৃত্যুর মিছিল। নিয়তি, তার নিরন্তর গতিতেই চলবে। বাঁচা-মরাটা যেহেতু আমাদের হস্তে এখনো খানিকটা অবশিষ্ট আছে, তাই সবার কাছে আকুল আবেদন, সর্বাধিক সাবধানতা অবলম্বন করে নিজে বেঁচে থাকুন এবং অন্যকে বেঁচে থাকতে সাহায্য করুন।

লেখক : কানাডা প্রবাসী