শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

চট্টগ্রামে করোনা পরীক্ষার নামে কী হচ্ছে?

প্রকাশিতঃ ৭ অগাস্ট ২০২১ | ১১:৩৮ অপরাহ্ন


জোবায়েদ ইবনে শাহাদত : তিনদিন ধরে জ্বর, বুকে ও শরীরে তীব্র ব্যথা অনুভব করার পর চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবে স্থাপন করা ব্র্যাকের বুথে বৃহস্পতিবার (৫ আগস্ট) নমুনা দেন শামছুল ইসলাম হাকেমী (৫২)। এর আগেই ডাক্তারের শরণাপন্ন হন তিনি। উপসর্গ এবং এক্স-রে রিপোর্টসহ আরও নানা পরীক্ষার রিপোর্ট দেখে ডাক্তাররা ধারণা করেন, তিনি করোনায় সংক্রমিত। এজন্য ওষুধ এবং ইনজেকশন দিয়ে চিকিৎসাও শুরু করে দিয়েছিলেন তারা।

এরপর শুক্রবার (৬ আগস্ট) মধ্যরাতে ‘আনঅফিসিয়ালি’ শামছুল ইসলাম হাকেমী জানতে পারেন, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে (চমেক) তার করোনা পরীক্ষার ফলাফল নেগেটিভ এসেছে। রাত পেরিয়ে সকাল হতেই পরীক্ষার সময় দেওয়া মোবাইল নাম্বারে (০১৮৫৪৩৪৩***) মেসেজের মাধ্যমে করোনা পরীক্ষার রিপোর্ট পান শামছুল ইসলাম হাকেমী। রিপোর্টেও নেগেটিভ আসে তার। তবে এমন খবরেও খুশি হতে পারেননি তিনি। কারণ রিপোর্টে দেওয়া নামটি যে তার নয়! রোগীর নামের জায়গায় লেখা হয়েছে মো. এরশাদ। ঠিকানাও ভিন্ন। তাহলে শামছুল ইসলাম হাকেমীর করোনা পরীক্ষার ফলাফল কী?

নগরের বহদ্দারহাট এলাকার বাসিন্দা শামছুল ইসলাম হাকেমীর করোনা পরীক্ষার ফলাফলের ব্যাপারে নিশ্চিত হতে তার সন্তান স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে গিয়ে মোবাইল নাম্বার দিয়ে রিপোর্ট ডাউনলোড করেন। রিপোর্টেও দেখা যায়, শামছুল ইসলাম হাকেমীর মোবাইল নাম্বারটি ছাড়া রোগীর নাম-বয়স, ঠিকানা সবই ভুল। যথারীতি রোগীর নাম মো. এরশাদ লেখা হয়েছে।

বিষয়টি খতিয়ে দেখতে গিয়ে একুশে পত্রিকার হাতে চমেকে করোনা পরীক্ষার পর তৈরি করা ফলাফলের একটি তালিকা আসে। ৬ আগস্ট তৈরি করা ওই তালিকায় দেখা যায়, ১৫৫ নাম্বারে শামছুল ইসলাম হাকেমীর নাম, মোবাইল নাম্বার, বয়স, ঠিকানা- সব তথ্যের পাশাপাশি করোনা নেগেটিভ থাকার তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে।

ওই তালিকায় ১৫৪ নাম্বারে দেখা যায় মো. এরশাদ (৪০) নামের ওই ব্যক্তির নাম-ঠিকানা; যার তথ্যগুলো স্বাস্থ্য অধিদপ্তর শামছুল ইসলাম হাকেমীর মোবাইল নাম্বারে পাঠানোর পাশাপাশি ওয়েবসাইটেও রেখেছে। তালিকায় থাকা চট্টেশ্বরী এলাকার বাসিন্দা মো. এরশাদের নাম্বারে (০১৭৫৬৪৩৪***) ফোন করে তার রিপোর্ট ঠিকঠাক আছে কি না জানতে চাওয়া হয় একুশে পত্রিকার পক্ষ থেকে। তিনি জানান, এসএমএসে পাঠানো তার নাম-ঠিকানার সব তথ্য সঠিক আছে।

এবার তালিকার ১৫৬ নাম্বারে থাকা নন্দনকাননের বাসিন্দা সারাবন তহুরার (১৯) নাম্বারে (০১৮৪১৭২৭***) যোগাযোগ করে জানতে চাই, সব ঠিকঠাক আছে কি না। তখনই ওই তরুণীর বাবা জানান, তার নাম্বারে পাঠানো এসএমএসে রোগীর নাম সারাবন তহুরা না লিখে শামছুল ইসলাম হাকেমী লেখা হয়েছে, ঠিকানাও ভিন্ন। রিপোর্ট নেগেটিভ আসলেও রোগীর ভুল নাম-ঠিকানা আসার ঘটনায় তারা চিন্তিত।

পরে গত ৫ আগস্ট ব্র্যাকের বুথে করোনা পরীক্ষার জন্য নমুনা দেয়া সারাবন তহুরার বাবাকে নাম ও তথ্যগত অদলবদলের বিষয়টি জানানো হয়। এবং চমেকে তৈরি হওয়া ওই তালিকার বিষয়েও অবগত করানো হয়। তখন কিছুটা হলেও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন তিনি।

জানা যায়, গত ৫ আগস্ট ব্র্যাক করোনা পরীক্ষার জন্য নমুনা সংগ্রহ করলেও এসব নমুনা পরদিন ৬ আগস্ট পরীক্ষা করা হয়েছে চমেকের পিসিআর ল্যাবে। পরীক্ষার অনুমতি পাওয়া সকল হাসপাতাল ও ল্যাবের কাছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সরবরাহ করা আইডি এবং পাসওয়ার্ড থাকে। এসব দিয়ে সার্ভারে ঢুকে পজিটিভ বা নেগেটিভ তথ্য ইনপুট দেয় তারা। নিয়ম অনুযায়ী, চমেকে করা পরীক্ষার ফলাফল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সার্ভারে ইনপুট দিয়েছে চমেক কর্তৃপক্ষ।

প্রশ্ন উঠেছে, কতটা নির্ভরযোগ্য চমেকের করোনা পরীক্ষার এই রিপোর্ট? আসলেই কি সঠিক নিয়ম অনুযায়ী পরীক্ষা হচ্ছে? আদৌ কি পরীক্ষা হচ্ছে নাকি পরীক্ষার নামে হচ্ছে জালিয়াতি? নাকি মনমতো রিপোর্ট প্রদান করা হচ্ছে?

শামছুল ইসলাম হাকেমীর সন্তান একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘কতটা অবহেলা করলে এত বড় ভুল করা যায়। পরিবারের সবাই এখন বেশ উৎকন্ঠিত। আমরা তো এটাও বুঝতে পারছি না যে, রিপোর্টে শুধু নামের পরিবর্তন হয়েছে নাকি পজিটিভকে নেগেটিভ করা হয়েছে। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের মত একটা স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠান এমন গাফিলতি করলে সাধারণ মানুষের ভরসার জায়গা আর থাকলো কোথায়?’

অন্যদিকে সারাবন তহুরার বাবা একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘এ বিষয়ে আসলে আমার কিছু বলার নেই। এখন এটা নিয়ে লেখালেখি করে কী হবে, দেশে কত অনিয়ম হচ্ছে, এসব নিয়ে লেখালেখিও হচ্ছে, এরপরও কি কোন সমাধান হচ্ছে? এটারও হবে না। আমি আর কিছু বলতে চাই না।’

জানতে চাইলে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের (চমেক) অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. সাহেনা আক্তার বলেন, ‘আমি ব্যস্ত আছি। পরে ফোন করুন।’ যদিও পরবর্তীতে একাধিকবার ফোন করলেও তিনি সাড়া দেননি।

এ বিষয়ে চট্টগ্রাম জেলা সিভিল সার্জন ডা. সেখ ফজলে রাব্বি একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘এমনটা কখনোই হওয়া উচিত নয়। ভুলটা কেন, কীভাবে হলো তা আমার বোধগম্য হচ্ছে না। তবে আমি ব্র‍্যাক এবং চমেক কর্তৃপক্ষকে এ বিষয়ে সতর্ক করবো। আমি নিজে বিষয়টি দেখবো।’