সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১

হাদিসুরের পরিবারের সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেল

প্রকাশিতঃ ৩ মার্চ ২০২২ | ৭:৩৬ অপরাহ্ন

একুশে প্রতিবেদক : কদিন ধরেই ইউক্রেনে আটকে পড়া পণ্যবাহী বেসরকারি জাহাজ ‘বাংলার সমৃদ্ধি’-র মেরিন ইঞ্জিনিয়ার হাদিসুর রহমান ও অন্য সদস্যদের পরিবারের দিন কাটছিল শঙ্কা ও দুশ্চিন্তার মধ্য দিয়ে। সে শঙ্কা সত্যি হলো। লাশ হতে হলো বরগুনার বেতাগি উপজেলার হোসনাবাদ গ্রামের আব্দুর রাজ্জাক হাওলাদারের সন্তান মো. হাদিসুর রহমানকে।

ইউক্রেনের অলিভিয়া বন্দরে গতকাল বাংলাদেশ সময় রাত ৯টা ২৫ মিনিটে বাংলাদেশি জাহাজটিতে রকেট হামলা চালায় রাশিয়া। এতে প্রাণ হারান ওই জাহাজের ‘থার্ড ইঞ্জিনিয়ার’ হিসেবে কর্মরত মেরিন ইঞ্জিনিয়ার মো. হাদিসুর রহমান আরিফ।

পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি হাদিসুরের মৃত্যুতে পরিবার ও স্বজনদের মধ্যে চলছে আহাজারি। হাদিসুরের বাবা আব্দুর রাজ্জাক হাওলাদার পেশায় একজন শিক্ষক। ছেলের মৃত্যুর খবর শোনার পর থেকেই বাকরুদ্ধ হয়ে গেছেন তিনি।

অন্যদিকে, সন্তানকে হারিয়ে তার মা স্বজনেরা বারবার কান্নায় ভেঙে পড়ছেন। আহাজারি করে তিনি বলেন, ‘হাদিসুর আমার পরিবারের একমাত্র সম্বল ছিল। জমিজমা বন্ধক রেখে ছেলেকে মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং পড়িয়েছি। এখন সুখের সময়ে আসার আগেই আমার ছেলেকে আল্লাহ নিয়ে গেল।’

নিহত হাদিসুরের স্মৃতিচারণ করে ছোট ভাই মো. তারেক বলেন, ‘বুধবার সকালেও ভাই আমাদের সঙ্গে কথা বলেছেন। সে সময় ইউক্রেনে বোমা, গুলির শব্দ ও যুদ্ধ পরিস্থিতি নিয়েও ভাই শঙ্কায় ছিলেন। তার ভীতিকর কণ্ঠে বাড়ি ফেরার তাড়া যে রয়েছে, তা কথা শুনেই বোঝা যাচ্ছিল।’

বাড়ি ফিরে কী কী কাজ করবেন, ছোট ভাইয়ের সঙ্গে তা নিয়েও আলোচনা করেন হাদিসুর। তারেক বলেন, ‘ফোনালাপে পারিবারিক বিষয়েও আমাদের কথা হয়েছিল। ভাই বলেছিল, আমাদের আর ভাঙা ঘরে থাকতে হবে না। বাড়িতে এসেই যেভাবে হোক ঘরের কাজ ধরব।’ তারেক জানান, ‘হাদিসুরের মৃত্যুর বিষয়টি জাহাজে থাকা তার সহকর্মীদের কাছে থেকে নিশ্চিত হয়েছেন তারা।

রকেট হামলায় নিহত হাদিসুরের মৃত্যুর সংবাদে স্তব্ধ গ্রামবাসীও। হাদিসুরের মরদেহ দ্রুত দেশে ফিরিয়ে আনতে পরিবারের পাশাপাশি সরকারের কাছে আকুতি জানিয়েছেন গ্রামবাসীরা। তারা বলেন, ‘আমাদের অনেক বড় ক্ষতি হয়ে গেছে, যা কোনো ভাবেই পুষিয়ে নেওয়া সম্ভব না। এখন আমাদের একটাই চাওয়া, আমরা যাতে তার (হাদিসুর রহমান) দেহটা শেষবারের মত দেখতে পারি। তার দাফন যাতে আমরা ঠিকমতো করতে পারি।’

যদিও ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ পরিস্থিতির কারণে হাদিসুরের মরদেহ দেশে ফিরিয়ে আনা অনেকটা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।

বড় স্বপ্ন নিয়ে ছেলেকে লেখাপড়া করিয়েছিলেন মা-বাবা। স্বপ্ন পূরণ হয়েছিল। চাকরিও পেয়েছিলেন মেধাবী সন্তান হাদিসুর রহমান। কথা ছিল দেশে এলেই এবার ছেলেকে বিয়ে করাবেন। এজন্য নতুন ঘর করার পরিকল্পনাও ছিল তাদের। কিন্তু, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এলোমেলো করে দিল সবকিছু। যুদ্ধবিমানের হামলায় সব স্বপ্ন মুছে, না ফেরার দেশে পাড়ি জমালেন বরগুনার বেতাগী উপজেলার হাদিসুর।

জানা যায়, চট্টগ্রাম মেরিন একাডেমির ৪৭তম ব্যাচের ছাত্র ছিলেন হাদিসুর। লেখাপড়া শেষ করে এমভি ‘বাংলার সমৃদ্ধি’ জাহাজে থার্ড ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে চাকরি নেন তিনি। স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২০২১ সালের ১২ ডিসেম্বর বেসরকারি পণ্যবাহী জাহাজ ‘বাংলার সমৃদ্ধি‘-তে থার্ড ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে চাকরি হয় হাদিসুরের।

রাষ্ট্রীয় উদ্যোগের বিষয়ে বরগুনা জেলা প্রশাসনের কাছ জানতে চাইলে সহকারী কমিশনার (ভূমি) ফারহানা ইয়াসমিন বলেন, ‘‌যিনি মারা গেছেন, তিনি আমাদের সম্পদ ছিলেন। তিনি বলেন, ‘নিহতের বিষয়টি জানার পরপরই শোক সন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলার জন্য জেলা প্রশাসক মহদয় আমাকে এখানে পাঠিয়েছেন। আমি এরই মধ্যে তাঁদের সার্বিক পরিস্থিতি জেলা প্রশাসক মহদয়কে জানিয়েছি। তিনি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে কথা বলেছেন।’

মরদেহ কবে নাগাদ আসতে পারে জানতে চাইলে সহকারী কমিশনার বলেন, ‘যেহেতু এটি একটি রাষ্ট্রীয় বিষয়। নির্ধারিত প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে খুব তাড়াতাড়ি আমরা নিহতের মরদেহ ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে বলে আশা করা যাচ্ছে।’

মা-বাবাসহ ছয় সদস্যের পরিবারে একমাত্র উপার্জনক্ষম ছিলেন হাদিসুর। তাঁর পরিবারকে সহযোগিতার প্রশ্নে ফারহানা ইয়াসমিন বলেন, ‘জেলা প্রশাসক স্যার বলেছেন, এরই মধ্যে স্থানীয়ভাবে সহযোগিতার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। খুব অল্প সময়ের মধ্যে সেটি পৌঁছে যাবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘নিহতের পরিবারের যেকোনো প্রয়োজনে জেলা প্রশাসন তাঁদের সঙ্গে আছে।’

এদিকে, রকেট হামলায় থার্ড ইঞ্জিনিয়ার হাদিসুর রহমানের নিহতের পর চরম নিরাপত্তহীনতায় ভুগছেন জাহাজের বাকি সদস্যেরা। সেখান থেকে নিরাপদে ফিরে আসার আকুতি জানিয়েছেন তারা।

রকেট হামলার পর জাহাজের কক্ষ থেকে ফেরার আকুতি জানিয়ে এক নাবিকের একটি ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। সেখানে ওই নাবিককে বলতে শোনা যায়, ‘আমি বাংলার সমৃদ্ধির সেকেন্ড ইঞ্জিনিয়ার। আমাদের জাহাজে একটু আগে রকেট হামলা হইছে। একজন অলরেডি ডেড হইছে। আমাদের পাওয়ার সাপ্লাই নাই, ইমার্জেন্সি জেনারেটর দিয়া পাওয়ার চলতেছে।’

‘আমরা মৃত্যুর সম্মুখীন হইছি। আমাদের এখনও উদ্ধার করা হয় নাই। দয়া করে আপনারা আমাদের বাঁচান। আমরা সবাই আছি এখানে। দেখেন, সবাই আছি। আমরা মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছি। আমাদের বাঁচান, আমাদের কোনো জায়গা থেকে আন্তরিক সহযোগিতা আসে নাই। আমাদের বাঁচান।’

জাহাজটির অপর এক নাবিক আসিফুল ইসলাম আসিফ নিজের ফেইবুকে একটি ভিডিও পোস্ট করেছেন। যেখানে, তিনি বলেছেন, ‘আল্লাহর রহমতে এখনও ভালো আছি। আমাদের জাহাজে অ্যাটাক হইছে। তো যারা যারা আমাকে ফোন দিছিলেন, তাঁদের উদ্দেশে বলতেসি—এখনও ভালো আছি।’

‘প্লিজ এই গভর্নমেন্টের যে যার লাইনে একটু চেষ্টা করেন, যেন আমাদের উদ্ধার করা হয়। আমাদের এখনও উদ্ধার করা হয়নি। মিডিয়াতে আসছে আমরা নাকি নিরাপদভাবে পোল্যান্ডে চলে গেছি। এটা একটা ভুল নিউজ, ফেক নিউজ। আমাদের প্লিজ এখান থেকে উদ্ধার করার ব্যবস্থা করেন।’

যদিও এ ব্যাপারে নিজেদের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশন। বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের এমডি কমডোর সুমন মাহমুদ সাব্বির জানান, ‘বুধবার স্থানীয় সময় বিকেল ৫টা ১০ মিনিটে একটি শেল জাহাজের ব্রিজে বিস্ফোরিত হয়। এ সময় জাহাজে আগুন ধরে যায়। তবে সবার চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। হামলার পর জাহাজে থাকা কর্মকর্তারা ফেসবুক ও ম্যাসেঞ্জারে এ নিয়ে তথ্য দিয়েছেন। তাঁরা বলেছেন, জাহাজে অবস্থানকারী বাকি ২৮ জন অক্ষত রয়েছেন।’

২৯ নাবিক নিয়ে আটকা পড়া জাহজটিতে বুধবার রকেট হামলায় হাদিসুর নিহত হলেও বাকিরা অক্ষত আছেন বলে জানা গেছে। কীভাবে জাহাজটি নিরাপদে দেশে ফিরিয়ে আনা যায়, তা এখন পর্যন্ত স্পষ্ট নয়।

এব্যাপারে জানতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ করা হলে মন্ত্রী ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ও প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম দেশের বাইরে আছেন বলে জানানো হয়। অন্যদিকে, পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ ‍বিন মোমেনের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তিনি মিটিংয়ে আছেন বলে জানানো হয়।

প্রসঙ্গত, সিরামিকের কাঁচামাল ‘ক্লে’ পরিবহণের জন্য বাংলাদেশি জাহাজ ‘বাংলার সমৃদ্ধি‘ গত ২২ ফেব্রুয়ারি তুরস্ক থেকে ইউক্রেনের অলভিয়া বন্দরের জলসীমায় পৌঁছায়। তবে যুদ্ধাবস্থা এড়াতে জাহাজটিকে সেখানে পৌঁছানোর পরই পণ্য বোঝাই না করে দ্রুত ফেরত আসার জন্য নির্দেশনা দেন শিপিং করপোরেশনের কর্মকর্তারা। শেষ মুহূর্তে বন্দরের পাইলট না পাওয়ায় ইউক্রেনের জলসীমা থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি জাহাজটি।