সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১

বাঁশখালীর সেই ইউপি চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে ১০ সদস্যের অনাস্থা

প্রকাশিতঃ ১০ এপ্রিল ২০২৪ | ৮:০৩ অপরাহ্ন


বাঁশখালী (চট্টগ্রাম) প্রতিনিধি : বাঁশখালীর চাম্বল ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মুজিবুল হক চৌধুরীর বিরুদ্ধে বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ এনে ১০ জন ইউপি সদস্য অনাস্থা প্রস্তাব দিয়েছেন। দ্রুত তাকে অপসারণের দাবি জানিয়ে মঙ্গলবার (৯ এপ্রিল) উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) জেসমিন আক্তার বরাবর লিখিতভাবে অনাস্থা প্রস্তাব দেওয়া হয়।

অভিযোগে উল্লেখ করা হয়, চেয়ারম্যান মুজিবুল হক চৌধুরীর সীমাহীন দুর্নীতি, অনিয়ম ও স্বেচ্ছাচারিতা এবং জাল জালিয়াতির কারণে ইউনিয়নের কোনো উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে নিজেদেরকে সম্পৃক্ত করার সুযোগ পাচ্ছেন না ইউপি সদস্যরা। মুজিবুল হক চৌধুরী ইউপি সদস্যদের নামে সবার অজান্তে আলাদা আলাদা সীলমোহর তৈরি করে নিজেই সীল মেরে ও দস্তখত জাল করে তা ইউপি সদস্যদের দস্তখত বলে চালিয়ে দিয়ে ইউনিয়ন পরিষদের বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মসূচির ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করেন। চাম্বল ইউনিয়ন পরিষদের সচিব ফয়সাল আবেদীন এবং উদ্যোক্তা সৌরভ দেবনাথের সহায়তায় চেয়ারম্যান মুজিবুল হক চৌধুরী এমন অনিয়ম ও দুর্নীতি করে যাচ্ছেন বলেও অভিযোগে উল্লেখ করা হয়।

অভিযোগে আরও উল্লেখ করা হয়, মুজিবুল হক চৌধুরী সরকারের কর্মসংস্থান কর্মসূচি প্রকল্পের (ইজিপিপি) বরাদ্দের অর্থ আত্মসাতের লক্ষ্যে নিজ ইউনিয়নের বিভিন্ন নাগরিকদের নামে তাদের অজান্তে নিজে সিম উত্তোলন করে নিজেই উক্ত কর্মসূচীর টাকা আত্মসাৎ করে। এ নিয়ে বিভিন্ন স্থানীয় ও জাতীয় দৈনিকে সংবাদ প্রকাশ হলে ভুক্তভোগী জনগণ জানতে পেরে স্থানীয় থানায় সাধারণ ডায়েরি করেন।এছাড়াও চাম্বল ইউনিয়নের বিভিন্ন ওয়ার্ডের টিআর কাবিখা কর্মসূচিতে মেম্বারগণের কোন দস্তখত না নিয়ে মুজিবুল হক চৌধুরী ও সচিব ফয়সাল আবেদীন দস্তখত জাল করে নিজেরাই উক্ত কর্মসূচির জন্য সরকারের বরাদ্দের অর্থ আত্মসাৎ করে। মুজিবুল হক চৌধুরীর নানামুখী অপরাধ, অনিয়ম ও দুর্নীতির মাত্রা দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে। এসব কারণে দুদক, পরিবেশ অধিদপ্তর কর্তৃক দায়েরকৃত এবং অস্ত্র মামলাসহ এক ডজনের অধিক মামলা বিভিন্ন আদালতে বিচারাধীন রয়েছে।

এছাড়াও মুজিবুল হক চৌধুরী বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের বিরুদ্ধে ঔদ্ধত্যপূর্ণ ও আক্রমণাত্মক বক্তব্য প্রদান করে চাম্বল তথা সমগ্র বাংলাদেশের জনগণের মানসম্মানের হানি করেন। মুজিবুল হক চৌধুরীর এমন আগ্রাসী বক্তব্যের কারণে বর্তমানে উচ্চ শিক্ষাসহ বিভিন্ন উদ্দেশ্য যুক্তরাষ্ট্রে গমন ইচ্ছুক বাঁশখালীর সন্তানরা বিভিন্নভাবে হয়রানির শিকার হচ্ছেন এবং আরও হয়রানি হওয়ার আশঙ্কা আছে বলে অভিযোগে উল্লেখ করা হয়।

এসব ঘটনায় ক্ষুব্ধ হয়ে ইউপি সদস্য মোক্তার আহমদ, মো. ফজল কাদের, আহমদ কবির, নুরুল হোসাইন, জসিম উদ্দিন সিকদার, রহমত উল্লাহ, সোহেল ইকবাল চৌধুরী, সংরক্ষিত নারী ইউপি সদস্য মোছাম্মৎ হিরামনি, ফাতেমা বেগম, সুলতানা নার্গিস অনাস্থা দিয়েছেন।

অভিযোগদাতা ইউপি সদস্য রহমত উল্লাহ বলেন, আমরা জনগণের আশা আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটানোর লক্ষ্যে জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হয়েছি। কিন্তু আমাদের কোনো মতামতকে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে না। অবিলম্বে আমরা এই দুর্নীতিবাজ চেয়ারম্যানকে অপসারণের দাবি জানাচ্ছি।

এ বিষয়ে চাম্বল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মুজিবুল হক চৌধুরী একুশে পত্রিকাকে বলেন, আমি আজ অবধি ৭ বছর ধরে চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করতেছি। কই এর আগে তো কোনো অভিযোগ আসেনি। সবকিছু কি ৭ জানুয়ারির পরে হয়? আগে কাগজে-কলমে অনেক অনিয়ম করা যেতো। এখন সেই সুযোগ নেই। এখন কোনো প্রকল্প শুরু করার সময়ের ছবি, কাজ চলমান থাকার ছবি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে দেখাতে হয়। তাই অনিয়ম করার সুযোগ নেই।

তিনি আরও বলেন, আপনি (প্রতিবেদক) অনেক কিছু জানেন। আপনার বাড়ি আমার বাড়ি এক জায়গায়। আপনি না জানার কথা না। আপনি তো জানেন নির্বাচনের পর থেকে একটি চক্র আমার বিরুদ্ধে উঠে পড়ে লেগেছে।’

একই বিষয়ে জানতে চাম্বল ইউনিয়ন পরিষদের উদ্যোক্তা সৌরভ দেবনাথকে ফোন দেওয়া হলে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। একই প্রসঙ্গে জানার জন্য চাম্বল ইউনিয়ন পরিষদের সচিব ফয়সাল আবেদীনকে একাধিকবার কল দেওয়া হলেও তিনি রিসিভ করেননি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাঁশখালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) জেসমিন আক্তার একুশে পত্রিকাকে বলেন, চাম্বল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মুজিবুল হক চৌধুরীর বিরুদ্ধে ১০ ইউপি সদস্যের অনাস্থা সংক্রান্ত একটি অভিযোগ পেয়েছি। অভিযোগটি খতিয়ে দেখে প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা নেব।

প্রসঙ্গত, ২০২৩ সালের ৮ নভেম্বর বাঁশখালীতে হরতালবিরোধী মিছিল ও প্রতিবাদ সমাবেশে বক্তব্য দিতে গিয়ে মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাসকে পেটানোর হুমকি দেন চাম্বল ইউপি চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক মুজিবুল হক চৌধুরী।

বিএনপি-জামায়াতের অবরোধ ও নৈরাজ্যের প্রতিবাদে চাম্বল বাজারে ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ আয়োজিত সভায় তিনি মার্কিন রাষ্ট্রদূতের উদ্দেশ্যে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় বক্তব্য দেন। সমাবেশে তার দেওয়া সাড়ে ১৮ মিনিটের বক্তব্য ফেসবুকের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।

চাম্বলে আয়োজিত সমাবেশে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় মার্কিন রাষ্ট্রদূতের উদ্দেশে মুজিবুল হক বলেন, পিটার হাস বলেছেন, এখানে সুষ্ঠু নির্বাচন হবে না। পিটার হাস আমরা আপনাকে ভয় পাই না। আমরা মোটা চালের ভাত খাই। আপনি বিএনপির ভগবান। কিন্তু আমরা আওয়ামী লীগ ইমান বেচি না। আপনাকে এমন মারা মারব, বাঙালি কত দুষ্ট তখন বুঝতে পারবেন।’

রাষ্ট্রদূত পিটার হাসকে পেটানোর প্রকাশ্য হুমকিকে ‘সহিংস বক্তব্য’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছিল মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর। এ বক্তব্যকে তারা খুবই অসহযোগিতামূলক আচরণ হিসেবে উল্লেখ করেছে। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের ব্রিফিংয়ে এক প্রশ্নের জবাবে এসব মন্তব্য করেছিলেন উপপ্রধান মুখপাত্র বেদান্ত প্যাটেল।

এ ঘটনায় গত ২৭ ফেব্রুয়ারি মুজিবুল হক চৌধুরীকে চেয়ারম্যান পদ থেকে সাময়িক বরখাস্ত করে প্রজ্ঞাপন জারি করে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। গত ৪ এপ্রিল সাময়িক বরখাস্ত আদেশ খারিজ হয়ে তাকে আবারও স্বপদে বহাল করা হয়েছে। এছাড়াও গেল বছরের ২৮ ডিসেম্বর মুজিবুল হক চৌধুরী ও তার স্ত্রী সাহেদা বেগম নুরীর বিরুদ্ধে পৃথক দুইটি মামলা দায়ের করেন দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সমন্বিত জেলা কার্যালয় চট্টগ্রাম-২ এর সহকারী পরিচালক মো. আব্দুল মালেক।

মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়, মুজিবুল হক চৌধুরী জ্ঞাত আয়ের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ ৫৬ লাখ ৭১ হাজার ১৪ টাকা মূল্যের স্থাবর ও অস্থাবর অর্জন করে ভোগদখলে রেখেছেন। এটি দুদক আইনের ২৭ (১) ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

এছাড়া স্ত্রীর বিরুদ্ধে করা অপর মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়, মুজিবুলের স্ত্রী সাহেদা জ্ঞাত আয়ের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ ৮৬ লাখ ৬২ হাজার ৭৯৭ টাকার সম্পদ উপার্জন করে ভোগদখলে রেখেছেন। এটি দুদক আইনের ২৭ (১) ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ। দ্বিতীয় মামলায় স্ত্রীর নামে অবৈধ সম্পদ উপার্জনে সহযোগিতা করায় মুজিবুলের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধি ১০৯ ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন।

সর্বশেষ গত ২১ মার্চ ৩ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে আবু তাহের নামের এক ব্যক্তি বাদী হয়ে বাঁশখালী সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট আদালতে মামলাটি দায়ের করেন। মামলায় ইউপি সচিব ফয়সাল আবেদীন ও উদ্যোক্তা সৌরভ নাথকে আসামি করা হয়। মামলার বাদী আবু তাহের চাম্বল ইউনিয়নের ৪ নং ওয়ার্ডের নন্না মিয়ার ছেলে।

মামলার অভিযোগে উল্লেখ করা হয়, আবু তাহেরের অজান্তে তার নাম ব্যবহার করে এয়ারটেল কোম্পানির 01615-110589 নাম্বারের মোবাইলের সিম সংগ্রহ করেন মুজিবুল হক চৌধুরী। চাম্বল ইউনিয়নের অতিদরিদ্রদের জন্য সরকারের জনকল্যাণমূলক কর্মসূচি ‘কর্মসংস্থান কর্মসূচির (ইজিপিপি) বরাদ্দকৃত টাকা বাদীর অগোচরে স্বাক্ষর জাল করে চেয়ারম্যান মুজিবুল হক চৌধুরী, সচিব ফয়সাল আবেদীন ও সহযোগী সৌরভ নাথসহ আসামিরা টাকা আত্মসাৎ করেন। আদালত মামলাটি গ্রহণ করে সিআইডিকে তদন্তের নির্দেশ দেন।