রবিবার, ১৮ মে ২০২৫, ৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

মহেশখালীর প্যারাবন গিলে খাচ্ছে ভয়ঙ্কর ভূমিদস্যু চক্র, উধাও ৩০০ একর বন

সোনাদিয়ায় চিংড়ির রাজত্ব, নেপথ্যে প্যারাবন বিনাশ: বন বিভাগের আশ্বাস শুধুই ‘নাটক’?

ফুয়াদ মোহাম্মদ সবুজ | প্রকাশিতঃ ১৪ মে ২০২৫ | ৭:৪৯ অপরাহ্ন


সাবেক সরকারের পতনের পর দশ মাস পরেও কক্সবাজারের মহেশখালীতে প্যারাবনখেকোদের লাগাম টেনে ধরতে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিতে পারেনি অন্তর্বর্তী সরকার। উল্টো প্রশাসন ও বিচার বিভাগের বিস্ময়কর নীরবতায় ম্যানগ্রোভ বন ধ্বংসের মহোৎসব চলছে বলে অভিযোগ উঠেছে। চট্টগ্রাম উপকূলীয় বন বিভাগের দায়ের করা একাধিক মামলাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে এরই মধ্যে প্রায় তিন শতাধিক একর প্যারাবন গ্রাস করেছে দুর্বৃত্ত চক্র।

শুধু তাই নয়, সোনাদিয়া এলাকায় বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেজা) নিয়ন্ত্রিত প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার একর জমির বিশাল অংশেও থাবা বসিয়েছে দখলদাররা। সেখানে অন্তত ৪৭টি অবৈধ চিংড়ি ঘের নির্মাণের মাধ্যমে প্রকৃতির বুকে চালানো হচ্ছে নির্মম আগ্রাসন, আর এসবের পেছনে রয়েছে প্রভাবশালী মহলের সক্রিয় ছত্রচ্ছায়া।

এ যেন দেখার কেউ নেই! সোনাদিয়ার বুকে প্যারাবন কেটে লবণ চাষের উপযোগী জমিতেও গড়ে তোলা হয়েছে অসংখ্য চিংড়ি ঘের। কিছু এলাকায় এখনও দিনদুপুরে এক্সক্যাভেটর (খননযন্ত্র) দিয়ে শত শত বাইনগাছসহ বিভিন্ন প্রজাতির গাছ কেটে বনভূমিকে পরিণত করা হচ্ছে বিরানভূমিতে।

স্থানীয়দের অভিযোগ, বন বিভাগের অভিযান অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ‘নাটকীয়তায়’ সীমাবদ্ধ। বিভিন্ন মামলায় অভিযুক্ত আসামিদের গ্রেপ্তারে প্রশাসনিক তৎপরতা কার্যত শূন্যের কোঠায়। ফলে আগাম জামিন নিয়ে দখলদাররা আরও বেপরোয়া হয়ে উঠছে, যা আইনের শাসনকেই প্রশ্নবিদ্ধ করছে। ক্ষুব্ধ এলাকাবাসীর কথায়, “আইনের শাসন এখন দখলদারদের হাতের পুতুল।”

পরিস্থিতির ভয়াবহতায় গত বছরের ২৭ ডিসেম্বর সোনাদিয়ার উপকূলীয় বন পরিদর্শনে এসেছিলেন প্রধান বন সংরক্ষক আমির হোসাইন চৌধুরী। তিনি তখন দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে ঘোষণা দিয়েছিলেন, দখল হওয়া প্যারাবন উদ্ধার করে পুনরায় বনাঞ্চল সৃষ্টি করা হবে। এই মহৎ কাজে তিনি স্থানীয় জনসাধারণের সমন্বিত সহযোগিতাও কামনা করেছিলেন। পাশাপাশি, দম্ভের সাথে দখলদারদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের আশ্বাসও দিয়েছিলেন তিনি। তবে সেই ঘোষণার পর ছয় মাস পেরিয়ে গেলেও চট্টগ্রাম উপকূলীয় বন বিভাগের পক্ষ থেকে কার্যত কোনো দৃশ্যমান পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। বন বিভাগের এই নিষ্ক্রিয়তায় স্থানীয় পরিবেশবাদী ও সাধারণ মানুষ চরম হতাশ। অন্যদিকে, দখলদারদের মনোবল বেড়ে গেছে কয়েকগুণ।

অভিযোগ রয়েছে, মহেশখালীর ইতিহাসে প্যারাবন নিধন, দখল এবং গাছ কাটার সবচেয়ে ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটেছে গোরকঘাটা রেঞ্জের তৎকালীন কর্মকর্তা আনিসুর রহমানের দায়িত্বকালে। মাত্র দুই বছরের চাকরি জীবনে অসংখ্য বিতর্কের জন্ম দিয়ে তিনি ২০২৩ সালে বিদায় নেন। অভিযোগ, স্থানীয় পুলিশ এবং বনবিভাগের কিছু অসাধু কর্মকর্তাকে ‘ম্যানেজ’ করেই দখলদার চক্র ওই সময়ে প্যারাবনের এক বিশাল অংশ নিজেদের কব্জায় নেয়। এই অশুভ আঁতাতের পেছনে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, রাজনীতিবিদ এবং সমাজের বিভিন্ন স্তরের প্রভাবশালীদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদদ ছিল বলে পরিবেশকর্মীরা দাবি করেছেন।

হোয়ানক ইউনিয়নের পানিরছড়ার পশ্চিম অংশে বিশাল এলাকাজুড়ে সরকারি প্যারাবন এবং সরকারি খাল দখল করে চিংড়িঘের তৈরিতে (জাপাপন্থী) হিসেবে পরিচিত অ্যাডভোকেট সাহাব উদ্দিনকে ‘চার আনা শেয়ার’ দিয়ে সহযোগিতা করার অভিযোগ উঠেছে ক্ষমতাচ্যুত দলেরই কয়েকজন প্রভাবশালী নেতার বিরুদ্ধে। এই দখলদারিত্বের সময় পুলিশ ও বন বিভাগ মোটা অংকের ঘুষের বিনিময়ে রহস্যজনকভাবে নীরব ভূমিকা পালন করেছিল বলে গুরুতর অভিযোগ রয়েছে। এমনকি, উপজেলা সমন্বয় সভার মতো গুরুত্বপূর্ণ ফোরামেও প্রভাবশালী ব্যক্তিরা এমনভাবে বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন, যা প্রকারান্তরে প্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ঘুষ গ্রহণে উৎসাহিত এবং পরিবেশ ধ্বংসে প্ররোচিত করেছে। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে আদালত এবং থানায় একাধিক মামলা দায়ের করা হলেও এখন পর্যন্ত কোনো আসামিকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়নি, যা আইনের শাসনের প্রতি চরম অবমাননার এক নির্লজ্জ উদাহরণ।

অমাবশ্যাঘোনা ও বেক্সিমকো ঘোনা এলাকায় প্যারাবন দখলের ঘটনায় আদালতে দুটি এবং মহেশখালী থানায় একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। আদালতে দায়ের করা একটি মামলায় হোয়ানকের অ্যাডভোকেট সাহাব উদ্দিন, মো. ইসহাক, ছদর আমিন এবং বড় মহেশখালীর মারুফুল হকসহ অজ্ঞাত আরও ৩০-৪০ জনকে আসামি করা হয়েছে। অপর একটি মামলায় প্রধান আসামি করা হয়েছে কুতুবদিয়ার সাবেক এক চেয়ারম্যানের ছেলে এরশাদকে। এছাড়া কালাগাজি পাড়ার নাজু, মতিন ও শাহাদাত কবিরসহ আরও ৩০-৪০ জন অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিকেও আসামি করা হয়েছে এসব মামলায়। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো, এতগুলো মামলা থাকার পরেও কোনো আসামিকেই এখনো পর্যন্ত গ্রেপ্তার করা হয়নি।

দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সুন্দরবনের মতোই গুরুত্বপূর্ণ মহেশখালীর এই প্যারাবন ধ্বংসের ঘটনায় তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন এলাকার সিনিয়র সাংবাদিক ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা। দৈনিক যুগান্তরের সাংবাদিক মাহবুব রোকন সম্প্রতি তাঁর ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন, “হোয়ানকের এক সময়কার জঙ্গিবাদী নেতা, উখিল শাহাব উদ্দিন ও তাঁর শ্বশুরপক্ষের আন্তর্জাতিক হুন্ডি চক্র পানিরছড়ার পশ্চিমে সরকারি প্যারাবন ও খাল দখল করে চিংড়িঘের করেছে। সেখানে প্রথম দাগের লবণ উৎপাদনও হয়ে গেছে।” এই ঘটনায় অবৈধ অর্থ, রাজনৈতিক প্রভাব এবং প্রশাসনিক দুর্নীতির এক বিষাক্ত চক্র সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হচ্ছে বলে তিনি মন্তব্য করেন।

এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে উপকূলীয় বন বিভাগের মহেশখালী রেঞ্জের বর্তমান দায়িত্বরত কর্মকর্তা (চলতি দায়িত্ব) আইয়ুব আলী অনেকটা দায়সারাভাবে বলেন, “দখলদারদের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলাগুলো এখনো প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। আমরা আইনি লড়াই চালিয়ে যাচ্ছি। সোনাদিয়া ছাড়া নতুন করে ৩০০ একরের বাইরে কোনো দখলের তথ্য আমার কাছে নেই।”

তিনি আরও দাবি করেন, দখলদারদের বিরুদ্ধে তাঁদের ‘জিরো টলারেন্স’ (শূন্য সহনশীলতা) নীতি রয়েছে। তবে বন বিভাগের এই ‘জিরো টলারেন্স’ নীতির বাস্তব কার্যকারিতা নিয়ে স্থানীয় জনসাধারণের মধ্যে বিরাজ করছে তীব্র সন্দেহ, ক্ষোভ ও অসন্তোষ, যা প্রকারান্তরে প্রশাসনের সদিচ্ছা এবং নৈতিক অবস্থানকেই বড়সড় প্রশ্নের মুখে ঠেলে দিয়েছে।

পরিবেশবাদীরা আশঙ্কা করছেন, এখনই কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে মহেশখালীর অবশিষ্ট প্যারাবনটুকুও অচিরেই বিলীন হয়ে যাবে দখলদারদের অতৃপ্ত লালসার শিকার হয়ে।