রবিবার, ১৮ মে ২০২৫, ৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

অদম্য বাবর আলী: ডেথ জোনের ভয় জয় করে অন্নপূর্ণা-১ এর চূড়ায় বাংলাদেশের পতাকা

একুশে প্রতিবেদক | প্রকাশিতঃ ৭ এপ্রিল ২০২৫ | ২:৫৩ অপরাহ্ন


বাংলাদেশের পর্বতারোহণের ইতিহাসে এক নতুন এবং অবিস্মরণীয় অধ্যায় যুক্ত হলো। বিশ্বের অন্যতম বিপজ্জনক এবং দশম সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ অন্নপূর্ণা-১ (৮,০৯১ মিটার) এর চূড়ায় সগৌরবে বাংলাদেশের লাল-সবুজ পতাকা ওড়ালেন চট্টগ্রামের কৃতী সন্তান ডা. বাবর আলী। আজ, ৭ এপ্রিল, সোমবার সকালে তিনি এই ঐতিহাসিক সাফল্য অর্জন করেন। এই বিপদসংকুল অভিযানে তার সঙ্গী ছিলেন অভিজ্ঞ গাইড ফূর্বা অংগেল শেরপা।

বাবর আলীর এই বিশাল অর্জনের খবরটি নিশ্চিত করেছেন তার অভিযানের ব্যবস্থাপক ফরহান জামান এবং নেপালে অভিযান পরিচালনাকারী সংস্থা মাকালু অ্যাডভেঞ্চারের স্বত্বাধিকারী মোহন লামসাল। এই সাফল্য শুধু বাবরের ব্যক্তিগত নয়, এটি সমগ্র বাংলাদেশের অর্জন।

পেশায় চিকিৎসক বাবর আলী চট্টগ্রামের পর্বতারোহণ ক্লাব ‘ভার্টিক্যাল ড্রিমার্স’-এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা এবং বর্তমান সাধারণ সম্পাদক। পর্বতারোহণের প্রতি তার অদম্য ভালোবাসা এবং নেশা তাকে বারবার হিমালয়ের দুর্গম পথে টেনে নিয়ে গেছে। এর আগেও তিনি ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন। গত বছর প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে একই অভিযানে তিনি জয় করেন বিশ্বের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ মাউন্ট এভারেস্ট এবং চতুর্থ সর্বোচ্চ শৃঙ্গ লোৎসে। সেই ধারাবাহিকতায় এবার তিনি বেছে নিলেন অন্নপূর্ণা-১ কে, যা উচ্চতার বিচারে দশম হলেও পর্বতারোহীদের কাছে ‘ডেথ জোন’ বা মৃত্যুহার বিবেচনায় বিশ্বের অন্যতম ঝুঁকিপূর্ণ পর্বত হিসেবে পরিচিত।

এই চ্যালেঞ্জিং অভিযানের জন্য বাবর আলী গত ২৪ মার্চ বাংলাদেশ থেকে নেপালের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। প্রস্তুতি সেরে কাঠমান্ডু ও পোখারা হয়ে তিনি ২৮ মার্চ অন্নপূর্ণা বেজক্যাম্পে পৌঁছান। পর্বতের বৈরী পরিবেশের সঙ্গে শরীরকে মানিয়ে নিতে তিনি একাধিকবার বিভিন্ন উচ্চতার ক্যাম্পে আরোহণ ও অবরোহণ করেন। ক্যাম্প ১ (৫২০০ মিটার) এবং ক্যাম্প ২ (৫৭০০ মিটার) এ রাত্রিযাপন করে ২ এপ্রিল তিনি আবার বেজক্যাম্পে নেমে আসেন।

চূড়া জয়ের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো অনুকূল আবহাওয়া। বাবর আলী আবহাওয়ার পূর্বাভাসে জানতে পারেন, ৬ এপ্রিল পর্যন্ত একটি সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য আবহাওয়া অনুকূলে থাকবে। এই সুযোগ কাজে লাগাতে তিনি ৩ এপ্রিল পুনরায় চূড়ার দিকে যাত্রা শুরু করেন। এক এক করে ক্যাম্প ১ ও ক্যাম্প ২ পেরিয়ে যখন তিনি ক্যাম্প ৩ (৬৫০০ মিটার) এর দিকে এগোচ্ছিলেন, তখন শুরু হয় তুষারঝড়। কিন্তু বাবরের মনোবল ছিল অটুট। প্রতিকূলতার মধ্যেই তিনি ক্যাম্প ৩-এ পৌঁছান। সাধারণত, পর্বতারোহীরা ৭,৪০০ মিটার উচ্চতায় ক্যাম্প ৪ স্থাপন করে সেখান থেকে চূড়ার উদ্দেশ্যে চূড়ান্ত যাত্রা (সামিট পুশ) শুরু করেন। কিন্তু সময়ের স্বল্পতা এবং আবহাওয়ার পূর্বাভাস বিবেচনা করে বাবর আলী ও তার গাইড ফূর্বা শেরপা এক অত্যন্ত সাহসী সিদ্ধান্ত নেন – তারা ৬ এপ্রিল রাতেই ক্যাম্প ৩ থেকে সরাসরি সামিট পুশের জন্য বেরিয়ে পড়েন।

রাতের অন্ধকার, কনকনে ঠান্ডা আর চরম প্রতিকূলতাকে জয় করে অবশেষে ৭ এপ্রিল সকালে বাবর আলী অন্নপূর্ণা-১ এর চূড়ায় পা রাখেন। সেখানে তিনি উড়িয়ে দেন বাংলাদেশের পতাকা, যা বিদেশের মাটিতে দেশের এক অনন্য সম্মান বয়ে আনলো।

অভিযানের ব্যবস্থাপক ফরহান জামান উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে বলেন, “অন্নপূর্ণা-১ শীর্ষে পৌঁছানোর মাধ্যমে বাবর আলী বাংলাদেশের পর্বতারোহণের ইতিহাসে একটি নতুন অধ্যায় যুক্ত করেছে। ওর কঠোর পরিশ্রম এবং নিরলস অধ্যবসায়ের প্রতিফলন এই সাফল্য। আমরা আশা করি এই অর্জন বাংলাদেশের পর্বতারোহণে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে।”

জানা গেছে, বাবর আলী আজই নিরাপদে নিচের ক্যাম্পগুলোর দিকে অবতরণ শুরু করেছেন এবং আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে আগামীকাল ৮ এপ্রিল বেজক্যাম্পে পৌঁছানোর কথা রয়েছে।

ডা. বাবর আলীর এই ঐতিহাসিক অভিযানে পৃষ্ঠপোষকতা করেছে ভিজ্যুয়াল নীটওয়্যার্স লিমিটেড, ভিজ্যুয়াল ইকো স্টাইলওয়্যার লিমিটেড, এডিএফ এগ্রো, ফ্লাইট এক্সপার্ট, এভারেস্ট ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড এবং ব্লু জে। অভিযানের সার্বিক ব্যবস্থাপনায় ছিল বাবরের নিজের হাতে গড়া ক্লাব ভার্টিক্যাল ড্রিমার্স।