রবিবার, ১৮ মে ২০২৫, ৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

ম্যালেরিয়া কমেছে, তবে বান্দরবান-রাঙামাটি এখনও ‘হটস্পট’

একুশে প্রতিবেদক | প্রকাশিতঃ ২৫ এপ্রিল ২০২৫ | ১০:১০ পূর্বাহ্ন


দেশে গত বছর শনাক্ত হওয়া ম্যালেরিয়া রোগীদের প্রায় ৮৮ শতাংশই বান্দরবান ও রাঙামাটি জেলার বাসিন্দা। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, এই দুই জেলায় মশাবাহিত এই রোগের প্রকোপ সবচেয়ে বেশি, যা ২০৩০ সালের মধ্যে দেশ থেকে ম্যালেরিয়া নির্মূলের লক্ষ্যমাত্রার সামনে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দাঁড়িয়েছে।

ম্যালেরিয়া নির্মূলে জনসচেতনতা বৃদ্ধি ও সমন্বিত পদক্ষেপের ওপর জোর দিয়ে প্রতিবছরের মতো এ বছরও ২৫ এপ্রিল, শুক্রবার, পালিত হচ্ছে বিশ্ব ম্যালেরিয়া দিবস। এবারের প্রতিপাদ্য– ‘আমরাই করবো ম্যালেরিয়া নির্মূল; নব উদ্যমে, নব বিনিয়োগে, নব চিন্তায়’।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাব বলছে, গত বছর (২০২৩ সাল) দেশে মোট ১৩ হাজার ৯৯ জন ম্যালেরিয়া রোগী শনাক্ত হয়েছে। এর মধ্যে ১১ হাজার ৫০১ জনই ছিলেন বান্দরবান (৭,৭২৭ জন) ও রাঙামাটি (৩,৭৭৪ জন) জেলার। অর্থাৎ, মোট রোগীর ৮৭ দশমিক ৮০ শতাংশই এই দুই জেলার। বাকি ১ হাজার ৫৯৮ জন রোগী শনাক্ত হন ম্যালেরিয়াপ্রবণ হিসেবে চিহ্নিত আরও ১১টি জেলায়।

অধিদপ্তরের তথ্যে আরও দেখা যায়, ২০২৩ সালে ম্যালেরিয়ায় মোট শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ছিল ১৬ হাজার ৬৭৭ জন এবং মৃত্যু হয়েছিল ছয়জনের। এই হিসাবে গত বছর রোগী শনাক্তের হার আগের বছরের (২০২২) তুলনায় ২০.৪ শতাংশ কমেছে। ২০২২ সালে ১৮ হাজার ১৯৫ জন ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হন এবং ১৪ জনের মৃত্যু হয়।

তবে চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্যে নতুন করে ৬৪১ জন ম্যালেরিয়া রোগী শনাক্ত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে এবং একজনের মৃত্যু হয়েছে।

প্রাদুর্ভাব ১৩ জেলায়, উদ্বেগ পাহাড়ে

স্ত্রী অ্যানোফিলিস মশা বাহিত এই রোগের প্রাদুর্ভাব এখনও দেশের ১৩টি জেলার ৭১টি উপজেলায় রয়ে গেছে। জেলাগুলো হলো– পার্বত্য তিন জেলা রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান এবং কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, সিলেট, হবিগঞ্জ, নেত্রকোনা, ময়মনসিংহ, শেরপুর ও কুড়িগ্রাম। মূলত পার্বত্য ও সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতেই ম্যালেরিয়া রোগীর সংখ্যা বেশি দেখা যায়।

গত বছর যে ছয়জন মারা গেছেন, তাদের পাঁচজনই ছিলেন বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া মিয়ানমারের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সদস্য।

গত ১১ বছরের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০১৪ সালে দেশে সর্বোচ্চ ৫৭ হাজার ৪৮০ জন ম্যালেরিয়া রোগী শনাক্ত হয়েছিল এবং ৪৫ জনের মৃত্যু হয়েছিল, যা এক বছরে সর্বোচ্চ। এরপর ২০২০ সালে ৬,১৩০ জন এবং ২০২১ সালে ৭,২৯৪ জন শনাক্ত হন; এই দুই বছর ৯ জন করে রোগীর মৃত্যু হয়।

নির্মূলে চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক ও ম্যালেরিয়া রোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. এম এ ফয়েজ বলেন, “বিশ্বের অনেক দেশে ম্যালেরিয়ার চিকিৎসায় ব্যবহৃত দুটি প্রধান ওষুধ কার্যকারিতা হারালেও বাংলাদেশে এখনও সেগুলো কার্যকর রয়েছে, যা আশার কথা। এখন ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলোতে সঠিক প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা জোরদার করা গেলে ম্যালেরিয়া নির্মূল সম্ভব।”

তিনি আফ্রিকায় শিশুদের জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অনুমোদিত দুটি টিকার কথা উল্লেখ করে বলেন, বাংলাদেশেও ম্যালেরিয়াপ্রবণ এলাকা যেমন লামা ও আলিকদমে পরীক্ষামূলকভাবে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে এবং সবার জন্য টিকার বিষয়ে গবেষণাও চলছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ বিভাগের ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার (ম্যালেরিয়া ও এডিসবাহিত রোগ) ডা. শ্যামল কুমার দাস চ্যালেঞ্জগুলো তুলে ধরে বলেন, “বান্দরবান ও রাঙামাটির পরিস্থিতি মোকাবিলা করাই এখন প্রধান চ্যালেঞ্জ। পার্বত্য তিন জেলার সীমান্ত এলাকাগুলো ঝুঁকিপূর্ণ। এছাড়া জুম চাষি ও বনজীবীদের মতো ভ্রাম্যমাণ জনগোষ্ঠীর কাছে পৌঁছানো কঠিন, কারণ তারা সবসময় বাড়িতে থাকেন না। জঙ্গলে কাঠ কাটতে বা অন্যান্য কাজে তারা দীর্ঘ সময় বাড়ির বাইরে থাকেন।”

তিনি আরও জানান, এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা চিহ্নিত করে প্রতিরোধমূলক ওষুধ বিতরণসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, যার ফলে গত বছর সংক্রমণে কিছুটা লাগাম টানা সম্ভব হয়েছে। সরকারের লক্ষ্য ২০৩০ সালের মধ্যে দেশ থেকে ম্যালেরিয়া সম্পূর্ণভাবে নির্মূল করা।