
একুশে প্রতিবেদক : একজন মানুষ, যিনি নিজের জীবনকে শুধু নিজের জন্য নয়, বরং দেশের এবং বিশ্বের কল্যাণে নিবেদন করেছেন, তিনি হলেন রতন টাটা। তাঁর জীবনের প্রতিটি অধ্যায়ে আছে সংগ্রাম, সাফল্য, বিনয় এবং মানুষের প্রতি অগাধ ভালোবাসা। দরিদ্র পরিবারে জন্ম নিয়ে বিশ্বব্যাপী খ্যাতিমান একজন ব্যবসায়ী ও মানবতাবাদীতে পরিণত হওয়া, এটি শুধু কল্পকাহিনীর মতো শোনায়।
কিন্তু রতন টাটার জীবনে এটি ছিল বাস্তবতা। তিনি ছিলেন এমন একজন, যিনি সম্পদের পাহাড় গড়ার পরিবর্তে মানুষের হৃদয়ে জায়গা করে নেওয়াকে অধিক মূল্যবান মনে করতেন। তাঁর মৃত্যুতে শুধু ভারত নয়, সারা বিশ্ব একজন মহান মানুষকে হারিয়েছে। তাঁর জীবনগাথা আমাদেরকে শিক্ষা দেয় যে সত্যিকারের সাফল্য কীভাবে অর্জন করা যায় এবং সেটি কীভাবে মানবকল্যাণে ব্যবহার করা যায়।
৯ অক্টোবর রাতে মুম্বাইয়ের ব্রিচ ক্যান্ডি হাসপাতালে আইসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন ভারতের শিল্পজগতের অন্যতম নক্ষত্র রতন টাটা। ৮৬ বছর বয়সে পৃথিবী থেকে বিদায় নেন এই মহান ব্যক্তিত্ব। তাঁর মৃত্যুর খবরে ভারতের ব্যবসায়িক মহলসহ সমগ্র বিশ্বে শোকের ছায়া নেমে আসে।
অটোমোবাইল ও ইস্পাত শিল্পে আধিপত্য থাকা টাটা গ্রুপকে তিনি নিয়ে গেছেন এক নতুন উচ্চতায়। নিজের নামে সম্পদ না গড়ে, তিনি সব সময় চেষ্টা করেছেন সমাজের উন্নয়নে অবদান রাখতে। তাঁর হাতে গড়ে উঠেছে টাটা ট্রাস্ট, যার মাধ্যমে তিনি বিপুল সম্পদ দান করে গেছেন।
মৃত্যুর আগে তিনি টাটা সন্সের ইন্টারিম এমেরিটাস চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। পাশাপাশি তিনি টাটা চ্যারিটেবল ট্রাস্টের চেয়ারম্যানও ছিলেন। ভারতীয় ধনকুবের ব্যবসায়ী, উদ্যোক্তা, বিনিয়োগকারী ও শিল্পপতি হিসেবে তিনি বিশ্বব্যাপী পরিচিতি লাভ করেন।
এয়ারলাইনস, গাড়ি তৈরি, কেমিক্যাল, প্রতিরক্ষা ও মহাকাশ, ইঞ্জিনিয়ারিং, বিদ্যুৎ পরিষেবা, স্বাস্থ্যসেবা, তথ্য ও প্রযুক্তি, টেলিকম, স্টিল, রিয়েল এস্টেট, খাদ্য-পানীয়, কসমেটিক্স ইত্যাদি বিভিন্ন খাতে টাটা গ্রুপের ব্যবসা বিস্তৃত।
দরিদ্র পরিবারে জন্ম নেওয়া রতন টাটা প্রথমে ব্লাস্ট ফার্নেস সরানোর কাজ পেয়েছিলেন টাটা স্টিলে। ১৯৯১ সালে তিনি টাটা গ্রুপের চেয়ারম্যান হন এবং সেখানেই পান বিস্ময়কর সাফল্য। তাঁর নেতৃত্বে টাটা গ্রুপের ব্যবসা ছড়িয়ে পড়ে ভারত, এশিয়া, ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা ও দক্ষিণ আমেরিকায়।
হুরুন ইন্ডিয়া রিচ লিস্টের প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২৪ সালের আগস্ট মাস পর্যন্ত রতন টাটার সম্পদের পরিমাণ প্রায় ৭,৯০০ কোটি রুপি। টাটা গ্রুপ হোল্ডিংস, টাটা সন্সের মাত্র ০.৮৩ শতাংশ শেয়ার নিজের নামে রেখেছিলেন তিনি।
তাঁর কীর্তির স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি পদ্মভূষণ ও পদ্মবিভূষণ সম্মাননায় ভূষিত হন।
রতন টাটার ব্যক্তিগত জীবন ছিল সাদামাটা ও নিরহংকারী। বিদেশে পড়াশোনার পর তিনি গাড়ি ও বিমান চালনা শিখেন। নিজের কোম্পানির ব্যবসায়িক জেট বিমান তিনি নিজেই ওড়াতেন। ‘দ্য স্টোরি অব টাটা’ বইয়ে জানা যায়, মুম্বাইয়ে থাকলে তিনি সাপ্তাহিক ছুটি কাটাতেন আলিবাগে নিজের ফার্মহাউসে। সেখানে তাঁর সঙ্গে থাকত শুধুমাত্র তাঁর প্রিয় কুকুর গোয়া। ২০১৮ সালে পোষা কুকুরের অসুস্থতার কারণে যুক্তরাজ্যের রাজ পরিবারের দেওয়া লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ড নিতেও যাননি তিনি।
রতন টাটা ছিলেন এমন একজন ভিআইপি, যিনি একা ভ্রমণ করতেন। ‘দ্য টাটাজ: হাউ অ্যা ফ্যামিলি বিল্ট অ্যা বিজনেস অ্যান্ড অ্যা নেশন’ বইয়ে গিরিশ কুবের লিখেছেন, টাটা সন্সের প্রধান হওয়ার পরও তিনি একটি সাধারণ ছোট কামরায় বসতেন। তাঁর বন্ধুরা জানান, যে কেউ তাঁর সঙ্গে দেখা করতে পারত, এবং তিনি নিজেই ফোন রিসিভ করতেন।
রতন টাটার অঢেল সম্পদ ও ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও তিনি কখনো বিয়ে করেননি। টাইমস অব ইন্ডিয়াকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি স্বীকার করেন যে, চারবার বিয়ে করতে গিয়েও করতে পারেননি। প্রতিবারই কোনো না কোনো ঘটনার কারণে বিয়ে সম্পন্ন হয়নি। তিনি বলেন, “কখনো নিজেকে দেখে স্বস্তি লাগে। বিবাহিত কাউকে দেখে মনে হয়, বিয়ে বিষয়টি বেশ জটিল।” যুক্তরাষ্ট্রে তাঁর এক প্রেমিকা ছিল, যিনি ভারতেও এসেছিলেন; কিন্তু ভারতের জীবনে মানিয়ে নিতে না পারায় তিনি যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে যান।
রতন টাটার জীবনের শুরুটা ছিল সাধারণ মানুষের মতোই। তাঁর বাবা নাভাল টাটাকে দত্তক নিয়েছিলেন টাটা গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা জামশেদজি টাটার নিঃসন্তান ছোট ছেলে। এভাবেই টাটা পরিবারের সঙ্গে তাঁদের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তবে নাভাল টাটার দুটি বিয়ে ছিল, এবং প্রথম স্ত্রী সোনির গর্ভেই জন্ম নেন রতন টাটা। বাবা-মায়ের বিবাহ বিচ্ছেদের পর দাদি লেডি নাভাজবাইয়ের কাছে তিনি ও তাঁর ভাই জিমি বড় হন।
মুম্বাইয়ের ক্যাথেড্রাল অ্যান্ড জন ক্যানন স্কুল থেকে মাধ্যমিক শেষ করে তিনি আর্কিটেকচার ও স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়াশোনা করেন। পরে হার্ভার্ডে অ্যাডভান্স ম্যানেজমেন্ট বিষয়ে পড়াশোনা করেন। ১৯৬১ সালে টাটা স্টিলে ব্লাস্ট ফার্নেস সরানোর কাজ দিয়ে তাঁর কর্মজীবন শুরু হয়।
১৯৯১ সালে জে আর ডি টাটা তাঁর মেধা ও পরিশ্রম দেখে তাঁকে টাটা গ্রুপের চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দেন। এ নিয়ে সমালোচনা হলেও তিনি প্রমাণ করেন যে তিনি সেই দায়িত্বের যোগ্য। তাঁর নেতৃত্বে টাটা গ্রুপ একটি সাধারণ ভারতীয় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে আন্তর্জাতিক বহুজাতিক কোম্পানিতে পরিণত হয়।
রতন টাটার নেতৃত্বে টাটা গ্রুপ নতুন উচ্চতায় পৌঁছে যায়। ‘সল্ট-টু-সফটওয়্যার’ নামে পরিচিত এই শিল্পগোষ্ঠীর কোম্পানির সংখ্যা ১০০-এর বেশি। গ্রুপটির বার্ষিক আয় ১০০ বিলিয়ন ডলারের বেশি, এবং প্রায় ৬ লাখ ৬০ হাজার মানুষ এখানে কর্মরত।
২০০৬ সালে ১,২০০ কোটি ডলারে ইস্পাত বহুজাতিক কোরাসকে অধিগ্রহণ করে টাটা গ্রুপ। এটি ছিল ইস্পাত ব্যবসায় আধিপত্য বিস্তারের একটি বড় পদক্ষেপ। ২০০৮ সালে ২৩০ কোটি ডলারে ব্রিটিশ গাড়ি প্রস্তুতকারী বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান জাগুয়ার-ল্যান্ড রোভারের মালিকানা অর্জন করে টাটা। রতন টাটার হাত ধরে জাগুয়ার বিশ্ববাজারে নতুন উচ্চতা লাভ করে।
টাটা টি হয়ে ওঠে বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয়। যুক্তরাজ্যের শীর্ষ চা কোম্পানি টেটলি টি-ও টাটা গ্রুপের অধীনে। স্টিল ব্যবসায় টাটা স্টিল ইউরোপীয় লিমিটেড গঠন করে লন্ডনের বাজারে আধিপত্য স্থাপন করে। নিউইয়র্কের পিয়েরে হোটেলও টাটার মালিকানাধীন। ভারতের সবচেয়ে বড় স্টিল কোম্পানি ও বৃহত্তম আউটসোর্সিং ফার্মটিও টাটার। টেলিকম সেক্টরে টাটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। টাটা গ্রুপের ৬৫ শতাংশ রাজস্বই আসে বিদেশ থেকে।
রতন টাটাকে নিয়ে আলোচনা করতে গেলে তাঁর গাড়ি ব্যবসার কথা অবশ্যই বলতে হয়। ১৯৯৮ সালে টাটা ইন্ডিকা নামে প্রথম প্যাসেঞ্জার কার আনে টাটা মোটরস। অল্প খরচে বেশি মাইলেজের এই গাড়িটি দ্রুতই ভারতের বাজারে জনপ্রিয়তা লাভ করে। সম্পূর্ণ দেশীয় প্রযুক্তিতে তৈরি এই গাড়ি ভারতের গাড়ি শিল্পে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে।
পরে জাগুয়ার ল্যান্ড রোভার অধিগ্রহণের মাধ্যমে টাটা মোটরস বিশ্ববাজারে প্রবেশ করে। জাগুয়ারের মতো বিলাসবহুল গাড়ি প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানকে নিজের করে নিয়ে রতন টাটা প্রমাণ করেন যে তিনি বিশ্বব্যাপী প্রতিযোগিতায় সক্ষম।
টাটা গ্রুপের যাত্রা শুরু হয় ১৮৬৮ সালে। রতন টাটার নেতৃত্বে এটি বিশ্বব্যাপী বিস্তৃতি লাভ করে। বর্তমানে টাটা গ্রুপের ব্যবসায়িক মূল্য ৪০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ভারতের গোটা শেয়ারবাজারের ৭ শতাংশ টাটা শিল্প গোষ্ঠীর দখলে। ২০১৭ সালে ভারতের করপোরেট ট্যাক্সের ৩ শতাংশ আসে এই গ্রুপের কল্যাণে।
ছয়টি মহাদেশের ১০০টি দেশে শতাধিক কোম্পানির মাধ্যমে টাটা গ্রুপের ব্যবসা পরিচালিত হচ্ছে। তথ্যপ্রযুক্তি, যোগাযোগ, প্রকৌশলী পণ্য ও সেবা, পণ্যদ্রব্য, জ্বালানি, ভোগ্যপণ্য, কেমিক্যাল এবং আন্তর্জাতিক কার্যক্রমসহ বিভিন্ন খাতে তাদের ব্যবসা বিস্তৃত।
২০১২ সালে রতন টাটা অবসর নেন। তাঁর স্থলে চেয়ারম্যান হন সাইরাস মিস্ত্রি, যা টাটা পরিবারের বাইরে প্রথমবারের মতো কেউ এই পদে আসীন হন। তবে কয়েক বছরের ব্যবধানে সাইরাস মিস্ত্রিকে অপসারণ করে রতন টাটা আবারও গ্রুপের হাল ধরেন। এই পরিবর্তন নিয়ে নানা বিতর্ক সৃষ্টি হলেও রতন টাটা কোম্পানির স্বার্থ রক্ষায় এই সিদ্ধান্ত নেন।
রতন টাটার সৎভাই নোয়েল টাটাকে টাটা ট্রাস্টের চেয়ারম্যান হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। টাটা ট্রাস্টের মাধ্যমেই টাটা গ্রুপ পরিচালিত হয়। নোয়েল টাটা টাটা ট্রেন্টের চেয়ারম্যান, যা জুডিও ও ওয়েস্টসাইডের মতো ব্র্যান্ড পরিচালনা করে। তিনি ভোল্টাস ও টাটা ইন্টারন্যাশনালেরও চেয়ারম্যান।
নোয়েল টাটার সন্তানরাও ধীরে ধীরে টাটা গ্রুপের নেতৃত্বে আসছেন। তাঁদের মধ্যে লিয়া টাটা, মায়া টাটা ও নেভিল টাটা উল্লেখযোগ্য। তাঁরা বিভিন্ন ক্ষেত্রে টাটা গ্রুপের ব্যবসায় অবদান রাখছেন।
একবার রতন টাটা জার্মানির হামবুর্গে এক রেস্তোরাঁয় খাবার অপচয়ের জন্য ৫০ ইউরো জরিমানা দেন। এই ঘটনা তাঁর জীবনে গভীর প্রভাব ফেলে। তিনি টুইটারে লিখেন, “আমরা টাকা দিয়ে খাবার কিনেছি, কিন্তু সম্পদ তো সমাজের। বিশ্বের অনেক মানুষের সম্পদের অভাব রয়েছে। সুতরাং সম্পদ নষ্ট করার কোনো অধিকার আমাদের নেই।”
এই ঘটনা থেকে তিনি শিখেছিলেন যে সম্পদের সঠিক ব্যবহার ও সংরক্ষণ কতটা গুরুত্বপূর্ণ। এটি তাঁর দানশীলতা ও সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতার আরও একটি উদাহরণ।
রতন টাটা শুধু ব্যবসায়ী নন, তিনি মানবতার সেবায় নিজেকে উৎসর্গ করেছেন। তিনি টাটা ট্রাস্টের মাধ্যমে বিপুল সম্পদ দান করেছেন শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সংস্কৃতি ও সামাজিক উন্নয়নে। তাঁর নেতৃত্বে টাটা গ্রুপ বিভিন্ন দুর্যোগে মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে।
রতন টাটার জীবনগাথা আমাদেরকে শুধুমাত্র একজন সফল ব্যবসায়ীর গল্প শোনায় না, এটি আমাদেরকে একটি অনুপ্রেরণার গল্প শোনায়। একজন মানুষ কিভাবে নিজেকে সমাজের কল্যাণে উৎসর্গ করতে পারেন, কিভাবে সম্পদের প্রতি আকর্ষণকে জয় করে মানবতার সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করতে পারেন, তা রতন টাটার জীবন থেকে আমরা শিখতে পারি। তাঁর মৃত্যুর মাধ্যমে আমরা শুধু একজন ধনকুবেরকে হারাইনি, আমরা হারিয়েছি একজন মানবতাবাদী, একজন নেতা, একজন পথপ্রদর্শককে।
তাঁর অবদান আমাদের হৃদয়ে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। তাঁর জীবন আমাদেরকে প্রেরণা জোগাবে সত্য, ন্যায় ও মানবতার পথে চলতে। রতন টাটার স্মৃতি আমাদেরকে সব সময়ই মনে করিয়ে দেবে যে সাফল্যের আসল অর্থ কী, এবং সেটি কিভাবে মানবকল্যাণে ব্যবহার করা যায়। তাঁর জীবন আমাদেরকে শেখায় যে একটি মানুষও পৃথিবীকে পরিবর্তন করতে পারে, যদি তাঁর মনোভাব ও উদ্দেশ্য সৎ ও ন্যায়ের পথে পরিচালিত হয়।