
মিয়ানমারের উত্তরাঞ্চলের পাহাড়ি রাজ্যগুলোতে ২০২৪ সালে দেশটির সশস্ত্র প্রতিরোধযোদ্ধাদের অগ্রযাত্রা ছিল অভাবনীয়। সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে ‘অপারেশন ১০২৭’ চালু হওয়ার পর কয়েক মাসের মধ্যে জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর জোট ‘ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স’ একের পর এক এলাকা দখল করতে থাকে। ওই সময় শান রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ লাসিও, কুটকাই, নাওংকিওসহ সব জায়গায় মিয়ানমার সেনাবাহিনীর ঘাঁটির পতন ঘটে। মনে হচ্ছিল, সামরিক জান্তা হয়তো দ্রুত ভেঙে পড়বে, কিন্তু সেই চিত্র বদলে দিয়েছে চীনের কৌশল।
সীমান্তজুড়ে নিজেদের অর্থনৈতিক স্বার্থ ও ভূরাজনৈতিক প্রভাব টিকিয়ে রাখতে বেইজিং নতুন এক কৌশল নেয়, যার ফলে ধীরে ধীরে থেমে যায় মিয়ানমারের প্রতিরোধ আন্দোলনের অগ্রগতি। ‘অপারেশন ১০২৭’-এর দ্বিতীয় ধাপ যখন পুরো শক্তিতে এগোচ্ছে, তখন চীন জানায় ‘মিয়ানমারের রাজনীতিতে সেনাবাহিনী সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান’। বেইজিং পরিষ্কার জানিয়ে দেয়, যদি লড়াই বন্ধ না হয় তাহলে তারা সীমান্তপথে অর্থ, সরঞ্জাম ও জ্বালানির প্রবাহ বন্ধ করবে।
এর ফলও হয় দ্রুত। লাশিও দখলের পর অগ্রযাত্রা থামিয়ে দেয় মিয়ানমার ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স আর্মি (এমএনডিএএ)। তারা ঘোষণা দেয়, পশ্চিমা রাষ্ট্র বা নির্বাসিত জাতীয় ঐক্য সরকারের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক রাখবে না। গত এপ্রিলে চীনের মধ্যস্থতায় তারা শহরটি বিনা যুদ্ধে সেনাবাহিনীর হাতে ফিরিয়ে দেয়। জুলাইয়ে টাং ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি (টিএনএলএ) চীনের চাপের মুখে নাওংকিও থেকে সরে আসে। এরপর আগস্টে মোগোক ও মংমিত—দুটি কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ শহর চীনা ‘শান্তি চুক্তি’র অংশ হিসেবে জান্তার হাতে ফেরত যায়।
লাশিও, কুটকাই ও নাওংকিও থেকে প্রতিরোধ বাহিনীর পিছু হটার পর উত্তর শান রাজ্যে জান্তা সেনাবাহিনী পুনর্গঠনের সময় পায়। চীনের মধ্যস্থতায় স্বাক্ষরিত যুদ্ধবিরতির ফলে ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্সের কার্যক্রম থেমে যায়, আর জান্তা সীমান্তপথের কিছু গুরুত্বপূর্ণ শহর পুনর্দখল করে নেয়। কৌশলগতভাবে এটি বেইজিংয়ের জন্যও লাভের ছিল, কারণ এ করিডোর দিয়েই চীন-মিয়ানমার বাণিজ্যের বড় অংশ পরিচালিত হয়। যুদ্ধবিরতির সুবাদে সেনারা পুনর্গঠিত হয়ে সৈন্য ও সরঞ্জাম সরিয়ে নেয় দেশের অন্য ফ্রন্টে, বিশেষ করে মন্ডল, রাখাইন, কাচিন ও মাগওয়ে অঞ্চলে।
এ অবস্থায় রাখাইন রাজ্যে পরিস্থিতি দ্রুত অবনতি ঘটতে থাকে। আরাকান আর্মি (এএ) জানায়, সম্প্রতি উত্তর শানে যুদ্ধবিরতির সুযোগে জান্তা রাখাইনে বিমান ও নৌবাহিনীর হামলা ব্যাপকভাবে বাড়িয়েছে। রাথেদাং, পননাগিউন, পোকতাউ, কিয়াউকফিউ ও সিত্তে এলাকাজুড়ে চলছে বোমাবর্ষণ ও আর্টিলারি হামলা, যার বেশির ভাগ লক্ষ্য ছিল বেসামরিক এলাকা। আরাকান আর্মির দাবি, এসব হামলায় ১২ জনেরও বেশি নিহত হয়েছে এবং ১৯টি গ্রামের ১২ হাজারের বেশি বাসিন্দা বাস্তুচ্যুত হয়েছে। আরাকান আর্মি বলছে, উত্তর শানে সাময়িক বিরতি তৈরি হলেও রাখাইন এখন নতুন যুদ্ধক্ষেত্র। রাজধানী সিত্তে ও চীনা বিনিয়োগনির্ভর কিয়াউকফিউ বন্দরের দিকে অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা করছে আরাকান আর্মি, আর জান্তা সেই অগ্রযাত্রা ঠেকাতে রাখাইনকে রণক্ষেত্রে পরিণত করেছে।
চীনের এ হস্তক্ষেপকে প্রতিরোধ বাহিনীর অনেক নেতা সরাসরি ‘বলপ্রয়োগী কূটনীতি’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। তাদের মতে, বেইজিং শান্তির নাম করে বাস্তবে মিয়ানমারের সামরিক সরকারের টিকে থাকা নিশ্চিত করছে। কারণ সেনা সরকার টিকে থাকলেই সীমান্ত বাণিজ্য, বিরল খনিজ, গ্যাস পাইপলাইন ও বেল্ট অ্যান্ড রোড প্রকল্পগুলো নির্বিঘ্নে চালানো সম্ভব। যদিও চীন বলছে তারা শুধুই মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাজ করছে এবং মিয়ানমারে শান্তি প্রতিষ্ঠাই তাদের লক্ষ্য।
২০২১ সালের অভ্যুত্থানের পর প্রথম দিকে বেইজিং মিন অং হ্লাইংয়ের সরকারকে স্বীকৃতি না দিয়ে দূরত্ব বজায় রেখেছিল। কিন্তু পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা বাড়লে তারা অবস্থান বদলায়। মিয়ানমারের খনিজ, কাঠ, গ্যাস ও বন্দর প্রকল্পে অনায়াস প্রবেশাধিকার পেতে হলে যে সরকারই থাকুক, তাকে সঙ্গ দেওয়ার নীতিই এখন চীনের কূটনীতির ভিত্তি। উত্তর মিয়ানমারের কাচিন ও শান রাজ্যে বিরল খনিজ—বিশেষত ল্যান্থানাম, নিওডিমিয়াম ও টারবিয়াম খনন এখন বেইজিং সমর্থিত কোম্পানির নিয়ন্ত্রণে। জান্তা সেনাবাহিনী তাদের খনিজ উত্তোলনের অনুমতি দিয়েছে কূটনীতিক ও সামরিক সহায়তা পাওয়ার শর্তে। বিশ্লেষকরা বলছেন, চীনের এ কৌশল প্রতিরোধ আন্দোলনের অভ্যন্তরীণ ভারসাম্য বদলে দিয়েছে। ওয়াহ স্টেট আর্মি, যারা একসময় বিপ্লবীদের অস্ত্র ও অর্থ দিত, তারাও এখন চীনের প্রভাবে নিরপেক্ষ অবস্থান নিয়েছে।
আন্তর্জাতিক কৌশলবিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের (আইআইএসএস) বিশ্লেষণ অনুযায়ী, মিয়ানমারের সশস্ত্র প্রতিরোধ এখন ‘ওয়ার টু নোহয়্যার’ অর্থাৎ এমন এক যুদ্ধে এসে ঠেকেছে, যার সুস্পষ্ট বিজয়ের সম্ভাবনা ক্রমেই ক্ষীণ হয়ে পড়ছে। আইআইএসএস মনে করে, অপারেশন ১০২৭ ছিল জান্তাবিরোধী প্রতিরোধের সবচেয়ে বড় সামরিক সাফল্য, কিন্তু সেই অগ্রগতি টেকসই হয়নি। এর কারণ হিসেবে অসংগঠিত নেতৃত্ব, সমন্বয়ের অভাব এবং চীনের কূটনৈতিক চাপকে উল্লেখ করা হয়েছে।
মিয়ানমারের ইতিহাসে ত্রয়োদশ শতকের শেষভাগে বাগান সাম্রাজ্যের রাজা নারাথিহাপাতে মঙ্গোলদের আক্রমণের মুখে রাজধানী ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন। ইতিহাস তাকে ‘তাইওক প্রেই মিন’ অর্থাৎ ‘চীনা আক্রমণে পালানো রাজা’ নামে স্মরণ করে। তার সেই পরাজয় বাগান সাম্রাজ্যের পতনের সূচনা করেছিল। আজকের মিয়ানমার যেন সেই ইতিহাসের উল্টো প্রতিফলন দেখছে। এবার কোনো রাজা পালিয়ে যাচ্ছেন না, বরং সামরিক জান্তার প্রধান মিন অং হ্লাইং চীনের কৌশল, কূটনৈতিক ছায়া ও অর্থনৈতিক সহায়তায় রাষ্ট্রক্ষমতায় টিকে আছেন। ওই সময় ইউয়ান সাম্রাজ্যের আক্রমণে মিয়ানমারের পতন হয়েছিল; এখন চীনের কূটনৈতিক আশ্রয়ে টিকে আছেন মিন অং হ্লাইং।