মঙ্গলবার, ৪ নভেম্বর ২০২৫, ২০ কার্তিক ১৪৩২

রপ্তানির ‘গাড়ি’ চলছে পেছনের গিয়ারে, টানা ৩ মাস পতন

একুশে প্রতিবেদক | প্রকাশিতঃ ৪ নভেম্বর ২০২৫ | ৮:২৫ পূর্বাহ্ন


দেশের রপ্তানি আয়ে বড় পতন হয়েছে, যা টানা তৃতীয় মাসের মতো ঘটল। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) জানিয়েছে, চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরের অক্টোবরে ৩৮২ কোটি ৩৯ লাখ ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের ৪১৩ কোটি ৮ লাখ ডলারের তুলনায় ৭ দশমিক ৪৩ শতাংশ কম। এর আগে সেপ্টেম্বরে রপ্তানি ৪ দশমিক ৬১ শতাংশ এবং আগস্টে ২ দশমিক ৯৩ শতাংশ কমেছিল।

চলতি অর্থবছরের জুলাইয়ে রপ্তানি খাতে ২৪ দশমিক ৯০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছিল। এই এক মাসের বড় প্রবৃদ্ধির প্রভাবেই প্রথম চার মাস (জুলাই-অক্টোবর) শেষে খাতটিতে এখনো ২ দশমিক ২২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি দেখা যাচ্ছে। তবে অর্থবছরের শুরুতে প্রায় ২৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি চার মাস পরে এসে মাত্র ২ শতাংশে ঠেকেছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ২০২৪ সালের জুলাইয়ের বেশির ভাগ সময় ছাত্র-জনতার গণ-আন্দোলনে সারা দেশ উত্তাল ছিল। সড়ক অবরোধ, সংঘাত-সংঘর্ষ ও কারফিউসহ শেখ হাসিনাবিরোধী আন্দোলনে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড স্থবির থাকার পরও সে মাসে ৩৮২ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছিল। বিপরীতে গত তিন মাস (আগস্ট, সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর) দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্থিতিশীল থাকার পরও রপ্তানি আয় না বেড়ে উল্টো কমে যাওয়াকে ‘উদ্বেগজনক’ হিসেবে দেখা হচ্ছে।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রফতানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বলেন, ‘ডোনাল্ড ট্রাম্প কর্তৃক অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ ইস্যুতে জুলাই ও আগস্টে আমাদের রপ্তানি খাত কিছুটা চাপে ছিল। সেটির প্রভাব সেপ্টেম্বরেও কিছুটা মেনে নেওয়া যায়। কিন্তু অক্টোবরে এসে আমাদের রপ্তানি এতটা কমে যাওয়া অবশ্যই অ্যালার্মিং। এ বিষয়ে আমাদের নীতিনির্ধারকদের সতর্ক হওয়া দরকার।’

রাইজিং ফ্যাশনস লিমিটেডের এই ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, ‘গত বছরের ৫ আগস্ট-পরবর্তী সময়ে দেশে রপ্তানিমুখী অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। ঋণখেলাপি হয়ে যাওয়ায় অনেক উদ্যোক্তা কাঁচামাল আমদানি করতে পারছেন না। ব্যাংক ঋণের সুদহারও প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেছে। এ পরিস্থিতিতে ব্যবসা পরিচালনা করা খুবই কঠিন।’

ইপিবির পরিসংখ্যান অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে বিশ্ববাজারে ১ হাজার ৬১৩ কোটি ৭০ লাখ ৩০ হাজার ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে, যা গত অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ১ হাজার ৫৭৮ কোটি ৬৩ লাখ ২০ হাজার ডলার।

দেশের রপ্তানি খাতের প্রধান পণ্য তৈরি পোশাক, যা মোট রপ্তানির ৮০ শতাংশের বেশি। গত বছরের অক্টোবরের তুলনায় চলতি অর্থবছরের একই মাসে তৈরি পোশাক রপ্তানি ৮ দশমিক ৩৯ শতাংশ কমে গেছে।

বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেছেন, ‘দেশের শিল্প ও অর্থনীতি এখন আইসিইউতে রয়েছে। ৮০ শতাংশ কারখানা এখন লোকসানে চলছে। ক্রেতাদের কাছ থেকে নতুন ক্রয়াদেশ পাওয়া যাচ্ছে না।’ তিনি এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন পিছিয়ে দেওয়ার জন্য সরকারের কাছে পুনরায় আহ্বান জানিয়ে বলেন, এটি বাস্তবায়িত হলে রপ্তানি খাত আরও বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

রপ্তানির এই সংকটের প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যানেও। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) ব্যাক-টু-ব্যাক এলসি খোলা ১০ দশমিক ৬৩ শতাংশ কমেছে। একইভাবে শিল্পের মূলধনি যন্ত্রপাতি, মধ্যবর্তী পণ্য ও কাঁচামাল আমদানির এলসি নিষ্পত্তিও কমেছে।

দেশের বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি এখন গত দুই দশকের মধ্যে সবচেয়ে কম। চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে এই প্রবৃদ্ধি ছিল মাত্র ৬ দশমিক ২৯ শতাংশ। চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রথম দুই মাস (জুলাই ও আগস্ট) ঋণ প্রবৃদ্ধি না হয়ে বরং ঋণাত্মক ধারায় চলে গিয়েছিল।

মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান এ বিষয়ে বলেন, ‘বেশির ভাগ ব্যাংক ঋণ শুরু হয় আমদানির এলসি খোলা থেকে। গত দুই বছর আমদানি পরিস্থিতি ভালো নেই। ব্যাংকগুলো সে অর্থে নতুন কোনো ঋণই দিচ্ছে না। ব্যাংকাররা এখন ঋণ না দিয়ে সরকারি বিল-বন্ডে বিনিয়োগকে বেশি নিরাপদ ও লাভজনক মনে করছেন।’

তিনি আরও বলেন, ‘গত দেড় দশকে বেসরকারি খাতে যে উচ্চ ঋণ প্রবৃদ্ধি ছিল সেটিও অস্বাভাবিক। জালজালিয়াতির মাধ্যমে ব্যাংক থেকে ঋণ বের করে নেওয়া হয়েছে। যে ১১-১২টি বেসরকারি ব্যাংক থেকে অস্বাভাবিক মাত্রায় ঋণ বের হতো, সেগুলো এখন পঙ্গু। …এ ব্যাংকগুলোর ১ টাকা ঋণ দেওয়ার সক্ষমতাও নেই। এ পরিস্থিতিতে ঋণ প্রবৃদ্ধি না হওয়াটিই বরং স্বাভাবিক।’