বুধবার, ৫ নভেম্বর ২০২৫, ২১ কার্তিক ১৪৩২

১৬ বিলিয়ন ডেটা ফাঁস: আপনার অ্যাকাউন্ট কি সুরক্ষিত?

এ কে এম ফজলুল করিম | প্রকাশিতঃ ৭ জুলাই ২০২৫ | ১১:১৩ পূর্বাহ্ন


আমরা আজ এমন এক ডিজিটাল যুগে বসবাস করছি, যেখানে আমাদের দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত ইন্টারনেটের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ব্যাংকের লেনদেন, সামাজিক যোগাযোগ, বিনোদন থেকে শুরু করে সরকারি পরিষেবা—সবকিছুই এখন অনলাইন-নির্ভর। কিন্তু এই ডিজিটাল নির্ভরতার সাথেই ছায়ার মতো বাড়ছে এক অদৃশ্য বিপদ—সাইবার আক্রমণ। সম্প্রতি বিশ্বজুড়ে ঘটে যাওয়া ১৬ বিলিয়নেরও বেশি ডেটা ফাঁসের একটি ঘটনা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে যে, আমাদের ডিজিটাল পরিচয় এখন কতটা ঝুঁকির মুখে। এই ডেটা ফাঁস শুধু সংখ্যায় বিশাল নয়, এর ভয়াবহতা অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে। এই মহাবিপদের সময়ে আমাদের অনেকের মনেই প্রশ্ন জাগছে, এই ডেটা ফাঁস বা ‘ব্রিচ’ আসলে কী, কেন এটি এত ভয়ঙ্কর এবং এই অদৃশ্য শত্রুর ডিজিটাল থাবা থেকে কীভাবে আমরা নিজেদের সুরক্ষা নিশ্চিত করব?

ডেটা ব্রিচ হলো এমন একটি ঘটনা, যেখানে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের ব্যক্তিগত বা সংবেদনশীল তথ্য অননুমোদিতভাবে প্রকাশ হয়ে যায়, চুরি হয় বা হ্যাকারদের হাতে চলে যায়। সহজ কথায়, আপনার ডিজিটাল তথ্যভান্ডারের চাবি হ্যাকারদের হাতে চলে যাওয়া। অতীতের ডেটা ব্রিচগুলোতে বেশিরভাগ সময় শুধু পাসওয়ার্ড বা ইমেইল ঠিকানা ফাঁস হতো। কিন্তু সম্প্রতি ঘটে যাওয়া ১৬ বিলিয়ন ডেটা ব্রিচকে বিশেষজ্ঞরা ‘গ্রেটেস্ট অফ অল টাইম’ (G.O.A.T.) বা ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ বলছেন। এর কারণ হলো এর নজিরবিহীন বিস্তৃতি এবং ভয়াবহতা। এবারের ডেটা ফাঁসের ঘটনায় শুধু আপনার পাসওয়ার্ডই নয়, বরং আপনি কোন ওয়েবসাইটে (URL) সেই পাসওয়ার্ড ব্যবহার করেছেন, আপনার ইউজারনেম বা ইমেইল কোনটি—এই তিনটি তথ্য একসাথেই ফাঁস হয়েছে। এর মানে হলো, হ্যাকাররা চাইলেই সরাসরি আপনার অ্যাকাউন্টে লগইন করতে পারবে, কারণ তাদের কাছে প্রয়োজনীয় সব তথ্যই রয়েছে।

সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হলো, ফাঁস হওয়া এই ১৬ বিলিয়ন ডেটার সবগুলোই নতুন, যা ঝুঁকির পরিমাণকে আরও অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে। ফেসবুক, অ্যাপল, গুগল, নেটফ্লিক্স, টেলিগ্রামের মতো বিশ্বখ্যাত সার্ভিস থেকে শুরু করে বিভিন্ন সরকারি এজেন্সি এবং বড় বড় ডেভেলপারদের অ্যাকাউন্ট পর্যন্ত এই হামলার শিকার হয়েছে। এর অর্থ হলো, আপনার পছন্দের এবং বহুল ব্যবহৃত প্ল্যাটফর্মটিও এই ঝুঁকির বাইরে নয়। ধারণা করা হচ্ছে, ‘ইনফো স্টিলারস’ নামক এক ধরনের ক্ষতিকর সফটওয়্যার বা ম্যালওয়্যারের মাধ্যমে এই বিপুল পরিমাণ তথ্য চুরি করে ডার্ক ওয়েবে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে।

অনেকের মনেই প্রশ্ন আসতে পারে, আমার ফেসবুক বা জিমেইল অ্যাকাউন্ট হ্যাক করে হ্যাকারের কী লাভ? আপনার অ্যাকাউন্টে হয়তো সরাসরি আর্থিক তথ্য নাও থাকতে পারে, কিন্তু এর গুরুত্ব কোনো অংশে কম নয়। হ্যাকাররা আপনার ব্যক্তিগত তথ্য ব্যবহার করে আপনাকে ব্ল্যাকমেইল করতে পারে। এই তথ্য ব্যবহার করে তারা আরও বিশ্বাসযোগ্য ‘ফিশিং’ আক্রমণ করে আপনার ক্রেডিট কার্ড বা ব্যাংকের মতো আরও সংবেদনশীল তথ্য হাতিয়ে নিতে পারে। আপনার পরিচয় ব্যবহার করে তারা নতুন অ্যাকাউন্ট খুলতে পারে বা আপনার অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করেই স্প্যাম ছড়ানো, ফিশিং লিংক পাঠানো বা অন্যান্য অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড চালাতে পারে।

এই ভয়ঙ্কর ডেটা ফাঁস থেকে নিজেকে কিছুটা হলেও সুরক্ষিত রাখতে আপনাকে অবিলম্বে কিছু কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। ডিজিটাল জগতে সতর্কতাই আপনাকে নিরাপদ রাখতে পারে। প্রথম এবং সবচেয়ে জরুরি কাজটি হলো, আপনার ফেসবুক, জিমেইল, অ্যাপল আইডি, নেটফ্লিক্সসহ সব গুরুত্বপূর্ণ অ্যাকাউন্টের পাসওয়ার্ড অবিলম্বে পরিবর্তন করা। পাসওয়ার্ডটি অবশ্যই শক্তিশালী হতে হবে, যেখানে বড় হাতের অক্ষর, ছোট হাতের অক্ষর, সংখ্যা ও বিশেষ চিহ্নের মিশ্রণ থাকবে। মনে রাখবেন, একই পাসওয়ার্ড একাধিক অ্যাকাউন্টে ব্যবহার করা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ।

শুধু শক্তিশালী পাসওয়ার্ডই যথেষ্ট নয়। সাইবার নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একটি শক্তিশালী পাসওয়ার্ডের চেয়েও বেশি কার্যকর হলো টু-ফ্যাক্টর অথেন্টিকেশন (2FA) বা দ্বি-স্তর যাচাইকরণ ব্যবস্থা। এটি আপনার অ্যাকাউন্টের জন্য একটি অতিরিক্ত সুরক্ষাবলয় তৈরি করে। 2FA সক্রিয় থাকলে, হ্যাকাররা আপনার ইউজারনেম ও পাসওয়ার্ড জেনে গেলেও আপনার অ্যাকাউন্টে লগইন করতে পারবে না। কারণ, লগইন করার সময় আপনার মোবাইল নম্বরে বা গুগল অথেন্টিকেটরের মতো অ্যাপে একটি কোড আসবে, যা ছাড়া অ্যাকাউন্টে প্রবেশ করা সম্ভব নয়।

ফেসবুকের ক্ষেত্রে, ‘সেটিংস ও প্রাইভেসি’ অপশনে গিয়ে ‘নিরাপত্তা ও লগইন’ বিভাগে আপনি টু-ফ্যাক্টর অথেন্টিকেশন চালু করার অপশন পাবেন। সেখানে আপনি এসএমএস অথবা অথেন্টিকেটর অ্যাপ—এই দুটি পদ্ধতির যেকোনো একটি বেছে নিতে পারেন। একইভাবে, আপনার গুগল অ্যাকাউন্টের ‘সিকিউরিটি’ সেকশনে গিয়ে ‘2-Step Verification’ চালু করতে পারবেন। হোয়াটসঅ্যাপেও এই সুবিধাটি রয়েছে, যা ‘Two-Step Verification’ নামে পরিচিত। সেখানে একটি ৬-সংখ্যার পিন সেট করে এবং একটি রিকভারি ইমেইল যুক্ত করে আপনার অ্যাকাউন্টকে সুরক্ষিত করতে পারবেন।

আপনার ডিজিটাল নিরাপত্তাকে আরও শক্তিশালী করতে এখন পাসওয়ার্ডবিহীন লগইনের বিকল্পও চলে এসেছে। গুগল, অ্যাপল বা মাইক্রোসফটের মতো প্ল্যাটফর্মগুলো এখন আপনার স্মার্টফোন, ল্যাপটপের ফিঙ্গারপ্রিন্ট সেন্সর বা ফেস রিকগনিশনকে (যেমন উইন্ডোজ হ্যালো) ‘হার্ডওয়্যার কি’ হিসেবে ব্যবহার করার সুবিধা দিচ্ছে। এগুলো ব্যবহার করলে আপনাকে আর পাসওয়ার্ড টাইপ করতে হবে না, বরং আপনার বায়োমেট্রিক তথ্যই পাসওয়ার্ডের কাজ করবে, যা অনেক বেশি সুরক্ষিত।

এর পাশাপাশি কিছু সাধারণ সতর্কতাও মেনে চলা জরুরি। যেমন, অচেনা বা অনির্ভরযোগ্য ওয়েবসাইটে ক্রেডিট কার্ডের তথ্য না দেওয়া, যেকোনো লিংকে ক্লিক করার আগে বা কোনো ফাইল ডাউনলোড করার আগে সতর্ক থাকা এবং আপনার সফটওয়্যার ও অপারেটিং সিস্টেম নিয়মিত আপডেট করা। একটি ভালো অ্যান্টিভাইরাস সফটওয়্যার ব্যবহার করাও একটি বুদ্ধিমানের কাজ।

যদি দুর্ভাগ্যক্রমে আপনার ফেসবুক আইডি হ্যাক হয়েই যায়, তবে আতঙ্কিত না হয়ে ব্রাউজারে [facebook.com/hacked](https://facebook.com/hacked) লিখে প্রবেশ করুন। সেখানে ‘My Account Is Compromised’ অপশনটি বেছে নিয়ে ফেসবুকের দেওয়া নির্দেশনা অনুসরণ করলে আপনার আইডিটি ফিরে পাওয়ার একটি ভালো সম্ভাবনা থাকে।

পরিশেষে, আমাদের মনে রাখতে হবে, সাইবার জগতে আমাদের কোনো তথ্যই শতভাগ সুরক্ষিত নয়। তবে সঠিক জ্ঞান, প্রযুক্তিগত সতর্কতা এবং ব্যক্তিগত অভ্যাস পরিবর্তনের মাধ্যমে আমরা ঝুঁকির মাত্রা উল্লেখযোগ্যভাবে কমাতে পারি। ‘সাবধানের মার নেই’—এই প্রবাদটি ডিজিটাল জগতেও সমানভাবে প্রযোজ্য। আপনার আর্থিক ও ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষিত রাখতে সর্বদা সতর্ক থাকুন এবং টু-ফ্যাক্টর অথেন্টিকেশনের মতো নিরাপত্তা ব্যবস্থাগুলো অবশ্যই ব্যবহার করুন। মনে রাখবেন, আপনার ডিজিটাল নিরাপত্তা আপনারই হাতে।