
আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু করতে সশস্ত্র বাহিনীকে আবারও গ্রেপ্তারের ক্ষমতা দিচ্ছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। দীর্ঘ ১৬ বছর পর ‘গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) ১৯৭২’ সংশোধন করে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সংজ্ঞায় সশস্ত্র বাহিনীকে অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে। এর ফলে নির্বাচনের সময় পুলিশ বা অন্যান্য বাহিনীর মতো সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরাও নির্বাচনী অপরাধের জন্য যে কাউকে বিনা পরোয়ানায় গ্রেপ্তার করতে পারবেন। নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশন ও রাজনৈতিক দলগুলোর সুপারিশের ভিত্তিতে নেওয়া এই উদ্যোগ রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে চূড়ান্ত হওয়ার পথে।
এই উদ্যোগের বিষয়ে নির্বাচন কমিশনার আব্দুর রহমানেল মাছউদ বলেন, “আমাদের সশস্ত্র বাহিনী দেশবাসীর আস্থা ও বিশ্বাসের প্রতীক। দেশের জনগণ এবং রাজনৈতিক দলগুলোও বিশ্বাস করে, নির্বাচনে সেনাবাহিনী আইন প্রয়োগকারী সংস্থা হিসেবে দায়িত্ব পালন করলে তা সুষ্ঠু নির্বাচনের সহায়ক হবে। এর ফলে নির্বাচনী আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় সশস্ত্র বাহিনীকে কারো নির্দেশের অপেক্ষায় থাকতে হবে না।”
নির্বাচন কমিশনের এই সিদ্ধান্তের সঙ্গে সেনাবাহিনীর প্রস্তুতির বিষয়টিও স্পষ্ট হয়েছে। সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান সম্প্রতি এক অফিসার্স অ্যাড্রেসে সব সেনা সদস্যকে জাতীয় নির্বাচনে আইন অনুযায়ী নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালনের জন্য প্রস্তুত হতে বলেছেন। এর আগে গত ৩ জুলাই মিলিটারি অপারেশনস ডাইরেক্টরেটের কর্নেল মো. শফিকুল ইসলামও এক প্রেস ব্রিফিংয়ে জানিয়েছিলেন, নির্বাচন কমিশনের নির্দেশনা পেলে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন পরিচালনায় সেনাবাহিনী সব ধরনের সহায়তা করতে প্রস্তুত।
২০০১ সালে সপ্তম সংসদ নির্বাচনের আগে আরপিও সংশোধন করে সশস্ত্র বাহিনীকে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সংজ্ঞায় অন্তর্ভুক্ত করে বিনা পরোয়ানায় গ্রেপ্তারের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ২০০৮ সালে নবম সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার পর আওয়ামী লীগ সরকার আইন থেকে সেই বিধানটি বাদ দেয়। এর ফলে নির্বাচনী দায়িত্বে পুলিশ, র্যাব, বিজিবি বা আনসার সদস্যদের যে ক্ষমতা ছিল, সেনাবাহিনীর তা ছিল না।
সেই সময়ে সরকারের সেই সিদ্ধান্তের প্রতিফলন দেখা যায় সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নূরুল হুদার বক্তব্যে, যিনি ২০২২ সালে এক সংলাপে বলেছিলেন, “নির্বাচনে সেনাবাহিনীর একেবারেই প্রয়োজন নেই।” ২০১৮ সালের প্রহসনের নির্বাচনের অভিযোগে একটি মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে তিনি বর্তমানে কারাগারে আছেন।
নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সদস্য ও নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের সাবেক অতিরিক্ত সচিব বেগম জেসমিন টুলি মনে করেন, “‘যেমন ইচ্ছা তেমন নির্বাচন’ কৌশল বাস্তবায়নের জন্যই তৎকালীন ক্ষমতাসীন দল সেনাবাহিনীকে নির্বাচনে কার্যকর ভূমিকায় রাখতে চায়নি। কিন্তু কমিশন মনে করে, সেনাবাহিনী কার্যকর ভূমিকায় থাকলে ভোটাররা নিরাপদ বোধ করবে এবং ভালো নির্বাচন সম্ভব হবে।”
বিশ্লেষকদের পর্যবেক্ষণ, গত তিনটি জাতীয় নির্বাচনে সশস্ত্র বাহিনীকে কোণঠাসা করে রাখা হয়েছিল। ২০১১ সালে ড. এ টি এম শামসুল হুদার নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সংজ্ঞায় সশস্ত্র বাহিনীকে অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব দিলেও আওয়ামী লীগ ও তার শরিক দলগুলো তা প্রত্যাখ্যান করে। একই বছর নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ইসি সেনা মোতায়েনের অনুরোধ করলেও সরকার তাতে সাড়া দেয়নি।
পরবর্তীতে কাজী রকিবউদ্দীন আহমদের কমিশন ২০১৪ সালের সংসদ নির্বাচনে এবং ২০১৫ সালের সিটি নির্বাচনে সেনা মোতায়েন করলেও তাদের ম্যাজিস্ট্রেটের অধীনে রাখা হয় এবং সেনানিবাসে রিজার্ভ ফোর্স হিসেবে সীমাবদ্ধ রাখা হয়। ফলে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ উঠলেও তাদের কার্যকরভাবে ব্যবহার করা হয়নি।
নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের আরেক সদস্য ড. মো. আবদুল আলীম বলেন, “আমাদের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সশস্ত্র বাহিনীর প্রতি দেশবাসীর আস্থা বেশি। নির্বাচনী আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় সশস্ত্র বাহিনী মাঠে থাকলে মানুষ স্বস্তি পাবে। তাঁরা নিরপেক্ষ ও পক্ষপাতহীনভাবে দায়িত্ব পালন করেন, যা অতীতে কারও কারও জন্য ভোট লুটের অন্তরায় ছিল। আর এবার সশস্ত্র বাহিনী থাকবে প্রয়োজনীয় ক্ষমতা নিয়ে।”
প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিনও আসন্ন নির্বাচনে আগের চেয়ে বেশি সংখ্যক সেনা মোতায়েনে আগ্রহী বলে বিএনপির একটি প্রতিনিধিদলকে জানিয়েছেন। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী গত ১১ আগস্ট সাংবাদিকদের জানান, নির্বাচনে ৮০ হাজারের বেশি সেনাসদস্য মোতায়েন করা হবে।
আরপিও সংশোধনের সর্বশেষ অবস্থা সম্পর্কে নির্বাচন কমিশনের সিনিয়র সচিব আখতার আহমেদ জানান, প্রস্তাবটি নিয়ে কাজ চলছে এবং দ্রুত এটি চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য উপদেষ্টা পরিষদে পাঠানো হবে।