
এক সপ্তাহের মধ্যে তিন-তিনটি বড় আগুন। চট্টগ্রামের রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল (সিইপিজেড) থেকে শুরু করে ঢাকার মিরপুর এবং সবশেষ দেশের প্রধান আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো টার্মিনাল। এই তালিকা যদি এখানেই শেষ হতো, তাহলেও হতো। কিন্তু বাস্তবতা হলো, প্রতি বছরই আগুন লাগছে, মানুষ মরছে, পুড়ছে হাজার কোটি টাকার সম্পদ। তাতেও কারো কোনো মাথাব্যথা আছে বলে মনে হয় না।
বন্দরনগরীর বাসিন্দা হিসেবে আগুনের ভয়াবহতা আমাদের চেয়ে বেশি আর কে বুঝে? সীতাকুণ্ডের বিএম কন্টেইনার ডিপোর সেই ভয়াবহ স্মৃতি কি আমরা ভুলতে পেরেছি? সেই অগ্নিকাণ্ড আমাদের শিল্পখাত এবং অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থার কঙ্কালসার চেহারাটা বিশ্বের সামনে উন্মোচন করে দিয়েছিল। সেই ক্ষত শুকানোর আগেই যখন আমরা সিইপিজেডের মতো গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক অঞ্চলে আবার আগুন লাগতে দেখি, তখন বুঝতে বাকি থাকে না যে আমরা আসলে কিছুই শিখিনি।
এর সর্বশেষ পরিণতি ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো টার্মিনালে লাগা আগুন। এবারের লজ্জা শুধু জাতীয় পর্যায়ে সীমাবদ্ধ নয়, এ খবর ছড়িয়ে পড়েছে সারাবিশ্বে। এটি সরাসরি দেশের ভাবমূর্তি, আমাদের আমদানি-রফতানি বাণিজ্যের ওপর আঘাত হেনেছে। প্রশ্ন উঠেছে, দেশের প্রধান আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরেরই যদি এই দশা হয়, তাহলে দেশের বাকি অংশের, বিশেষ করে বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রামের অবস্থা কী?
নিশ্চিত করেই বলা যায়, এই প্রতিটি আগুনই অব্যবস্থাপনার আগুন। কারণ খুঁজলে সেই একই ক্লিশে চিত্রনাট্য—ভবনের অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা বিকল, বিদ্যুতের লাইনে ত্রুটি, দাহ্য পদার্থের স্তূপের পাশে নিরাপত্তাহীনতা, ভেন্টিলেশন সিস্টেমের অভাব, অকেজো হোস পাইপ। বিমানবন্দরের ঘটনাটি দেশের একটি অতি স্পর্শকাতর ও গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা রক্ষায় আমাদের চরম অদক্ষতাকেও বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরেছে। আগুন লাগার পর প্রথম এক ঘণ্টাকে বলা হয় ‘গোল্ডেন আওয়ার’। আগুনের ক্ষেত্রে প্রতি মিনিট গুরুত্বপূর্ণ। অথচ ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের মধ্যে সেই তৎপরতা দেখা যায়নি। তারা যেন দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন, বিস্ফোরণের ভয়ে ভীত ছিলেন। ‘চাচা আপন প্রাণ বাঁচা’—এই নীতিতে পুড়তে থাকল জনগণের সম্পদ। ‘সরকারি মাল, দরিয়া মে ঢাল!’ এই প্রবাদটিই যেন তাদের মূলমন্ত্র।
জনগণের জানমাল রক্ষার দায়িত্বে থাকা এই সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো চূড়ান্তভাবে ব্যর্থ। অথচ জনগণের ট্যাক্সের টাকায় এদের বেতন-ভাতা হয়। হোক সে ফায়ার সার্ভিস, বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ কিংবা চট্টগ্রামের সিডিএ; দুর্নীতি, অদক্ষতা আর অব্যবস্থাপনা যেন এদের আসল পরিচয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের তথ্যমতেই, গত বছর সারা দেশে ২৬ হাজার ৬৫৯টি অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে, যাতে প্রায় ৪৪৬ কোটি টাকার সম্পদের ক্ষতি হয়েছে। এর কত অংশ চট্টগ্রামের, সেই হিসাব হয়তো আলাদা করা নেই, কিন্তু বিএম ডিপো কিংবা সিইপিজেডের মতো ঘটনাই বলে দেয়, এই ক্ষতির এক বড় অংশীদার আমরা।
দেশে আগুন নিয়ন্ত্রণ এবং এ-সংক্রান্ত আইন প্রয়োগের দায়িত্ব ফায়ার সার্ভিস বিভাগের। কিন্তু অভিযোগ আছে, এটি একটি দুর্নীতিগ্রস্ত বিভাগে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশ নির্মাণ বিধিমালা (বিএনবিসি)-তে স্পষ্ট বলা আছে, একটি ভবন—তা রেস্তোরাঁ, হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা বিমানবন্দর যাই হোক—নির্মাণের ক্ষেত্রে কী ধরনের অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা থাকতে হবে। বিমানবন্দরের মতো স্থাপনার নিজস্ব অগ্নিনির্বাপণ সক্ষমতা থাকা বাধ্যতামূলক।
এগুলো দেখভালের দায়িত্ব ফায়ার সার্ভিসের। অভিযোগ রয়েছে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে যথাযথ পরিদর্শন ছাড়াই টাকার বিনিময়ে লাইসেন্স দেওয়া হয়। তারা অগ্নিঝুঁকিপূর্ণ ভবনের তালিকা তৈরি করে ‘নোটিস’ দিয়েই দায় সারে। অতীতে গাউছিয়া বা নিউ সুপার মার্কেটকে ‘অতিঝুঁকিপূর্ণ’ ঘোষণার পরও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি, যার পরিণতি আমরা দেখেছি। এই একই চিত্র কি চট্টগ্রামের নেই? এখানকার আগ্রাবাদ বা খাতুনগঞ্জের মতো বাণিজ্যিক এলাকার ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলো কি সিডিএ বা ফায়ার সার্ভিসের চোখে পড়ে না?
দুঃখজনকভাবে, এই ব্যর্থতার দায় শুধু সরকারি প্রতিষ্ঠানের নয়। জনগণের সচেতনতাও এখানে বড় প্রশ্ন। আমরা কোটি টাকা খরচ করে ফ্ল্যাট কিনি, কিন্তু ২০ হাজার টাকা খরচ করে একটি ‘ফায়ার ডোর’ লাগাতে নারাজ। অথচ এই ফ্ল্যাটগুলোতেই বাস করেন সমাজের শিক্ষিত ডাক্তার, প্রকৌশলী ও অধ্যাপকরা। বেইলি রোড, বনানী কিংবা সীতাকুণ্ড—যেকোনো বড় অগ্নিকাণ্ডে মৃত্যুর প্রধান কারণ ধোঁয়া। একটি সঠিক ফায়ার ডোর কয়েক ঘণ্টা আগুন ও ধোঁয়া আটকে রাখতে পারে, যা মানুষকে নিরাপদে বেরিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দেয়। কিন্তু এই সামান্য বিনিয়োগে আমাদের চরম অনীহা।
প্রতিটি ঘটনার পর যা হয়, এবারও তাই হয়েছে। আগুনের কারণ অনুসন্ধানে কমিটি করা হয়েছে। আর সেই কমিটির সদস্যরা হলেন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বা সেই বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষেরই কর্মকর্তারা। ভাবুন, একটি অপরাধের তদন্তে সম্ভাব্য অপরাধীদেরই তদন্ত কমিটির সদস্য করা হয়েছে! রিপোর্ট কী আসবে তা অনুমেয়। ভুক্তভোগী ব্যবসায়ী, আমদানিকারক বা আগুন বিশেষজ্ঞদের নিয়ে কমিটি করার প্রয়োজন কেউ বোধ করেনি। জনগণের ট্যাক্সের টাকায় চলা এই আমলাতন্ত্রে জনগণের কাছে জবাবদিহি করার কোনো ব্যবস্থাই রাখা হয়নি।
আমরা এলডিসি থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের উৎসব করছি। কর্ণফুলী টানেল আর এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে দেখিয়ে আমরা ‘উন্নয়নের’ গল্প বলছি। কিন্তু এই উন্নয়ন কতটা ফাঁপা, তা একটি আগুনই দেখিয়ে দেয়। সভ্য হতে গেলে শুধু মাথাপিছু আয় বাড়লে চলে না, স্বভাব-চরিত্রেরও উন্নতি প্রয়োজন। সর্বগ্রাসী দুর্নীতি, ন্যূনতম অগ্নিনিরাপত্তা ছাড়া বহুতল ভবন নির্মাণ এবং জবাবদিহিহীন সরকারি সেবা—এগুলোর কোনোটিই সভ্য দেশের আচরণ নয়। বারবার পুড়ে ছাই হওয়ার এই চক্র ভাঙতে হলে প্রয়োজন সর্বস্তরে আমূল পরিবর্তন ও কঠোর জবাবদিহিতার সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা—যার কোনো বিকল্প আজ আর আমাদের সামনে খোলা নেই।
লেখক : ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, একুশে পত্রিকা।