আবছার রাফি : সংবাদ আর সংবাদের পেছনে অনুক্ষণ লেগে থাকে একুশে পত্রিকার একঝাঁক সাহসী, অনুসন্ধিৎসু সাংবাদিক টিম। ‘সত্য সৃষ্টি সুন্দরের’ স্লোগানে ছুঁটে চলে অবিরত। মাঠ আর অফিস, কোথাও যেন ফুরসত নেই দম ফেলার। এমনই ব্যস্ত সময়ের ফাঁকে ঋতুচক্রের আবর্তে হাজির হল সবারই প্রিয় ঋতু শীতকাল; বাংলার রূপ বৈচিত্র্যের অনেকখানি জায়গা জুড়ে অবস্থান করে শীতকাল। সবার প্রিয় ঋতুর বিদায়ঘণ্টা না বাজতেই যেন একবার ‘মেঘমুক্ত নীল আকাশ’ দেখার জল্পনা-কল্পনায় বিভোর হয়ে পড়ে একুশে পত্রিকার কর্মীরা। কবে হারিয়ে যাওয়া যাবে সবুজ-প্রকৃতির মাঝে, যেখানে দৃষ্টি আটকাবে না সারি সারি দালানে!
গেল সপ্তাহে ঘটা করে ‘অফিস কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত এলো পিকনিকের। প্রকৃতির টানে সবারই লোভ যেন নৈসর্গিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি বান্দরবানের নয়নাভিরাম সৌন্দর্যে। সবার পছন্দের দিনক্ষণ ঠিক রেখে যাত্রাটা শুরু হয় শুক্রবার (১২ ফেব্রুয়ারি) সকালে।
একট্রিপ পিকনিকের সকাল-বিকাল
কুয়াশার চাঁদরে আটকে থাকা সকালের শীতল বাতাস মাড়িয়ে একুশে পত্রিকা পরিবার-সুহ্রদ মিলিয়ে জনা পঁচিশজন হাজির হয়ে গেলেন জামালখান একুশে পত্রিকা কার্যালয়ের সামনে। যেখানে অপেক্ষা করছে একুশে পত্রিকা আয়োজনে ‘একট্রিপ পিকনিক মেঘমালার শহরে’ ব্যানার সম্বলিত পুরবী সার্ভিসের ৫০ জনের ধারণক্ষমতাসম্পন্ন বিশাল চেয়ার কোচ। গাড়িতে উঠেই সবার মুখে মুখে গান, হাসি আর আনন্দ একাকার হয়ে যায়। বাস কিছুদূর চলার পর হাতে এলো আদর্শ নাশতার প্যাকেট, সাথে আপেল-কমলা। পেটের খাবার আর মন-কানের খাবার চলতে লাগলো সমান্তরাল। দারুণ এক অনুভূতি সঙ্গী করে আড়াই ঘণ্টায় পিকনিক টিম পৌঁছে গেলো মেঘমালার শহরে।
যাত্রাবিরতি ও মধ্যাহ্নভোজ
আনন্দ আর খাবার ইচ্ছেটা যেন চলতে লাগলো আড়াআড়িভাবে। তাই বান্দরবান শহরে পৌঁছেই সরাসরি সবাই নির্ধারিত খাবার হোটেলে। অবশ্য কেউ কেউ গেলেন জুমার নামাজ আদায় করতে। দ্রুততম সময়ে ‘এসো বসো আহারে’ মিলিত হলেন সকলে। দেশিয় রান্নার নানা মেন্যুতে ভরপেট খেয়ে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলেননি এমন কেউ নেই। তবে হোটেলের পরিবেশ নিয়ে প্রশ্ন তুললেন খোদ সম্পাদক আজাদ তালুকদারই; বললেন এমন আয়োজনে ভোগ-উপভোগ দুটিই দরকার। এখানে নিদারুণভাবে ভোগের বিষয়টি নিশ্চিত হলেও উপভোগের বিষয়টি ছিল অনুপস্থিত। অবশ্য হোটেল হিলভিউতে ফ্রেশ হওয়া, চা-কফি খাওয়া, ফিরতি পথে কড়াভাজা পরোটা খাওয়ার ব্যাপারটিতে ছিল একইসঙ্গে ভোগ আর উপভোগ। এক্ষেত্রে একুশে পত্রিকার সুজন-সুহ্রদ বান্দরবানের পরিচিত মুখ মোহাম্মদ ইসলাম কোম্পানির উষ্ণ আতিথেয়তা ছিল মনে রাখার মতো।
নীল আকাশের বান্দরবান ও ম্যাজিক বক্স
সময় বিকেল ৩টা। টিকেট কেটে সকলেই উপস্থিত বান্দরবানের সমতল থেকে ২২০০ ফুট উপরে পর্যটনকেন্দ্র নীলাচলে। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর নানা কারুকাজ আর প্রকৃতির সাজ সাজ রব দেখে সহকর্মীরা দিকবিদিক ছুটে চলছে। কেউ তুলছে সেলফি আর কেউ দৃষ্টি মেলে উপভোগ করছে প্রকৃতি আর মেঘের লুকোচুরি। এরই মাঝে কিছুক্ষণ পর সবাই মিলে গোল বৈঠকের মতো সমবেত হল নীলাচলের একপ্রান্তে পাহাড়ের পাদদেশে। এখানেই শুরু হলো ম্যাজিক বক্সের ম্যাজিক। বাংলা, হিন্দি, কাওয়ালী, আঞ্চলিক গান, নাচ, কৌতুক, রাজনীতিবিদের অভিনয়, তিন রকমের হাসি-কান্না, নিজের সম্পর্কে মিথ্যা বলার দৈব পরীক্ষা। বক্স থেকে চোখ বন্ধ করে যার ভাগ্যে যা আসে তাই পারফর্ম করতে হচ্ছিল। এ তালিকায় একেক জনের একেক পারফরমেন্স যেন মুহূর্তেই হাসির ফোয়ারা বইয়ে যায় জনে জন্ব। ম্যাজিক বক্সের সেরা ম্যাজিকটা না বললে যেন নয়, একটা ম্যাজিক বক্সের টোকেনে ছিল ‘কাপল ড্যান্স’। উপস্থিত কয়েকটা কাপল থাকলেও কাকতালীয়ভাবে ‘কাপল ড্যান্স’ টোকেনটা উঠে একুশে পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদক অ্যাডভোকেট রেহানা বেগম রানুর হাতে। তাতে লেখা ড্যান্স করতে হবে সম্পাদক আর নির্বাহী সম্পাদককে। সবার চক্ষু যেন চড়কগাছ! বিস্ময়ের ঘোর কাটে না- এই একটি মাত্র কুপন কী করে এলো এই দম্পতির ভাগ্যে। স্বয়ং ঈশ্বরও যেন চাইছেন তারা ড্যান্স করুক। ঈশ্বরের চাওয়া আর সকলের অনড় অবস্থানের মুখে শেষমেশ ‘কাপল ড্যান্স’ করেই দেখাতে হলো তাঁদের। আর সেটিই যেন হয়ে ওঠে পিকনিক ট্রিপের সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিষয়। এছাড়া সম্পাদকীয় উপদেষ্টা নজরুল কবির দীপুর গান-কৌতুক, তার স্ত্রীর তিন রকমের হাসি, মোস্তফা ইউসুফের চমৎকার করে নিজের তিনটা মিথ্যে বলা, তার স্ত্রী ইশরাত জাহান ইমার প্রেমে পড়ার পরের গান, জাহাঙ্গীর আলমের অদ্ভুত কবিতা আবৃত্তি, টিপু সুলতান সিকদারের ‘এক আকাশে লক্ষ তারা, চাঁদ শুধু একটারে’ এ গানের লাইনকে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় গাওয়ার চেষ্টা, এইচ এম জামাল উদ্দিনের তাৎক্ষণিক রচনা করে দুই লাইনের প্রেমের কবিতা বলা, পারভিনের তিন রকমের কান্না, জসিম উদ্দীনের ডিপজল কণ্ঠে ডায়ালগ, আবছার রাফির কৌতুক, আবুল কালাম মিন্টুর ইসলামি গান, মোখতারের আদিবাসী গান, ইলিয়াসের মধু হই হই বিষ খাওয়াইলা, অর্পণের জীবনে প্রথমবারের মতো গান গাওয়া, জোবায়েদ ইবনে শাহাদতের ওবায়দুল কাদেরের বক্তৃতা, জিন্নাত আইয়ুবের কম্পমান শরীরে প্রেমে পড়ার গান গাওয়া, নুচিং থোয়াই মারমার বুকটা ফাইট্যা যায়, খুকী নাথ মাসির লাগামহীন নিরবতার মাঝেও ফটোসেশন- সবই ছিল আনন্দ-বিনোদনের অমিয় ধারা।
তবে ম্যাজিক বক্সপর্ব থেকে নিজেকে আড়াল করতে শরীফুল রুকনের আত্মগোপন এবং সম্পাদকের উদ্যোগে কিছু করতে হবে না-এমন অভয়বাণীতে ফের তাকে সেই আনন্দ আড্ডায় ফিরিয়ে আনার ব্যাপারটিও কম মজার ছিল না।
বাড়িফেরা ও র্যাফেল ড্র
একদিনের এই পিকনিকে অফিসের ছোট-বড় সকলের বন্ধুত্বপূর্ণ মজা মাস্তি শেষে এবার প্রস্তুতি বাড়ি ফেরার। তখন সময় সন্ধ্যা ৭:০০ টা। যথারীতি সবাই গাড়িতে উঠে পড়া। এবার শুরু পিকনিকের উল্ল্যেখযোগ্য অংশ র্যাফেল ড্র। ২১ টি র্যাফেল ভর্তি একটা ব্যাকেট থেকে পিকনিকের তিন ক্ষুদে সদস্য একে একে তুলতে লাগলো সবার নাম। কার ভাগ্যে কোন পুরস্কার জুটছে; কে হবেন প্রথম – এমনসব চিন্তায় সেখানে বিরাজ করছে টানটান উত্তেজনা। পরিশেষে সবার নজর কে হচ্ছে প্রথম? সবার আশা ভেঙে দিয়ে প্রথম পুরস্কারটি অর্জন করেছেন পত্রিকাটির নির্বাহী সম্পাদক অ্যাডভোকেট রেহানা বেগম রানু।
এ প্রসঙ্গে তিনি চমৎকার, ব্যতিক্রমী এক অনুভূতি তুলে ধরেছেন ফেসবুকে। পিকনিক-আনন্দের দারুণ অনুষঙ্গ সেই অনুভূতিমালা তুলে ধরা হলো এখানে।
একি ষড়যন্ত্র!
লটারি ভাগ্যে বিশ্বাস করি না সেই ছোটকাল থেকে। তাই কোনো অনুষ্ঠানে লটারিপর্ব শুরুর আগে কুপনটা কারো হাতে ধরিয়ে দিয়ে চলে যেতাম। কিন্তু এই প্রথম লটারিপর্ব এড়ানো গেল না-একুশে পত্রিকার পিকনিকের লটারি বা র্যাফেল ড্র বলে কথা!
মেঘমালার শহরে একট্রিপ পিকনিকের অংশ এই র্যাফেল ড্র’র শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত থাকতে হয়েছে। বিশেষ আর সান্ত্বনা মিলিয়ে একুশে পত্রিকা পরিবারের সবার জন্যই ছিল পুরস্কার। তবে শেষ মুহূর্তে বিশেষ ১০ টি পুরস্কারের দিকেই সবার মনোযোগ।
দশম-নবম-অষ্টমের পথ বেয়ে সামনের পুরস্কারগুলো যতই এগোচ্ছিল, ততই বাড়ছে উত্তেজনা। আর আমার কৌতূহল তো সপ্তমে! সপ্তম, ষষ্ঠ, পঞ্চম, চতুর্থ, তৃতীয়, দ্বিতীয় কোথাও আমার নাম নেই- তবে কি আমিই প্রথম! ঘোর কাটেই না-এ কেমন নজিরবিহীন ঘটনা!
একুশে পত্রিকা পরিবারের একনিষ্ঠ জাতীয় বিতার্কিক ইশরাত জাহান ইমা এবার সত্যি সত্যি প্রথম পুরস্কার জয়ী হিসেবে আমার নামটাই ঘোষণা করলো! তবুও বিশ্বাস হয় না আমার! ষড়যন্ত্র না তো!
কিন্তু ইমার সৎ, সুদক্ষ পরিচালনায় রাইয়ান, তানিশা, তাসিন তিন পুষ্প গোলাপের নিখুঁত-নিপুন কুপন তোলায় কোনো খাদ কিংবা পারসিয়েলিটি থাকার কথা নয়, থাকতে পারে না-তাই বিস্ময়ের ঘোর কেটে বিশ্বাস করতেই হলো- ষড়যন্ত্র নয়, আদতে আমার ভাগ্য ফিরেছে। লটারিমন্ত্র! দিনশেষে আমিই সবচেয়ে ভাগ্যবান! তবুও বলি কুড়িয়ে পাওয়া ভাগ্য নয়, কর্মের ভাগ্যে, কর্মগুণেই যেন কাটে বাকি সময়।
নোট : আনন্দঘন লটারিপর্ব, পুরস্কার প্রদান শেষ। পুরস্কারের জন্য সবার নাম উঠলেও উঠেনি কেবল একটি নাম; একুশে পত্রিকা সম্পাদক আজাদ তালুকদার। কেন এমন হলো, কোথায় গেল নামটি-একুশে পত্রিকা পরিবারের সদস্যদের প্রশ্ন-কৌতূহলের মুখে শেষতক জানা গেল, লটারিপর্ব থেকে সম্পাদক আজাদ তালুকদার সন্তর্পণে নিজের নামটি সরিয়ে ফেলেছিলেন। আজাদ তালুকদার এমনই। তিনি ভোগ নয়, উপভোগ করেন। তিনি আনন্দ নিয়ে নয়, আনন্দ দিয়েই স্বস্তি খুঁজেন। হ্যাঁ, তাই তো তিনি সবার মতো হবেন কেন?