শনিবার, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৩০ ভাদ্র ১৪৩১

একুশের ঈদ-আয়োজন : ইকবাল মাহমুদের চোখে আধুনিক তুরস্ক

প্রকাশিতঃ ২৪ জুন ২০১৭ | ১১:৫৭ অপরাহ্ন

ব্যক্তিজীবনে আমি বরাবরই একটু অগোছালো, উদাসীন। এ উদাসীনতা প্রকটভাবে ধরা পড়ে কোথাও বেড়াতে যাওয়ার সময়। বিশেষত দেশের বাইরে যাওয়ার সময় দেখা যাবে শেষ মুহূর্তে আমার জরুরি কিছু প্রস্তুতি নেয়া হয়নি। তারপর তড়িঘড়ি, পড়ি-মরি করে প্রস্তুতি নিতে গিয়ে যারপর নাই ভোগান্তি।

গেল ২ মার্চ ভোরবেলা ঢাকা থেকে ইস্তানবুলের উদ্দেশ্যে ফ্লাইট। তাই আগেরদিনই সিলেট থেকে যেতে হবে ঢাকায়। সকাল গড়িয়ে দুপুর হয়ে গেছে, কিন্তু ঢাকা যাওয়ার টিকেট করা হয়নি আমার। অবশেষে প্রায় দ্বিগুণ মূল্যে ইউএস বাংলার একটি অভ্যন্তরীণ ফ্লাইটে টিকেট কেটে গেলাম ঢাকায়।

উদাসীনতার গল্পটা এখানেই শেষ হলে ভালো ছিলো। কিন্তু না। ঢাকায় গিয়ে হোটেলে লাগেজ রেখেই ছুটতে হলো মানি এক্সচেঞ্জারের খোঁজে। পাসপোর্টে ডলার এনডোজ করা হয়নি তখনো। যদিও এ যাত্রায় সাথে পেলাম জলিল ভাই, জুনায়েদ ভাই, কাদের ভাইসহ সফরসঙ্গী অনেককেই। কারোরই ডলার এনডোজ করা হয়নি। নয়াপল্টনের এক পরিচিত মানি এক্সচেঞ্জারকে ডেকে আনা হলো। একসাথে অনেকগুলো পাসপোর্টে ডলার এনডোজ করার প্রস্তাব পেয়ে এক্সচেঞ্জার নিজেই ছুটে এলেন আমাদের কাছে। অবশ্য তাঁর একটু বাড়তি দাবি মেটাতে হয়েছিলো।

পরদিন ভোরের আলো ফোটার আগেই তার্কিশ এয়ারলাইন্সের বিমান উড়লো আমাদের নিয়ে। তার্কিশ এয়ারলাইন্স-এর যাত্রীসেবা যারপরনাই ভালো। বিশেষত যাত্রীদের আপ্যায়নে তারা একটু বেশিই উদার মনে হলো। তবে, এ বেশি উদারতা সব সময় ভালো ফলদায়ক হয় না। খাবারের পাশাপাশি সফট এবং হার্ড ড্রিংকস ফ্রি পেয়ে অনেকেই সুযোগের অপব্যবহার করলেন।

যাহোক, স্থানীয় সময় দুপুর একটায় আমরা অবতরণ করলাম তুরস্কের সবচেয়ে বড় শহর ইসতানবুলের কামাল আতাতুর্ক বিমানবন্দরে। সেখানে আমাদের গাইড প্রতিষ্ঠান ‘ট্র্যাভেল শপ তার্কি’র দুজন প্রতিনিধি ফুল দিয়ে আমাদের বরণ করে নিলেন।

এক সপ্তাহের এ সফরের উদ্দেশ্য ছিলো মূলত একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে অংশগ্রহণ। বাংলাদেশের ট্র্যাভেল এজেন্টদের সংগঠন আটাব-এর ২৬তম মার্কেটিং কনফারেন্স। তুরস্ক এবং সাইপ্রাস দু’দেশে হবে কনফারেন্স। তুরস্ক এবং সাইপ্রাসের ট্রাভেল এজেন্ট ও ট্যুর অপারেটরদের সাথে মতবিনিময়ের কর্মসূচিও রয়েছে। বিশ্বপর্যটকদের কাছে বাংলাদেশকে ইতিবাচকভাবে উপস্থাপনের উদ্দেশ্যে ব্যাপক প্রস্তুতি ছিলো আটাবের। আমার কাজ ছিলো মূলত রিপোর্ট করা। রিপোর্টিংয়ের ফাঁকে দুটি দেশের সৌন্দর্য অবলোকনের সুযোগকে ‘রথ দেখা-কলা বেচার’ মতই নিলাম।

ইস্তানবুলে নেমেই প্রথম বিপত্তি আবহাওয়া। এয়ারপোর্টের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষেই টের পেলাম দেশ থেকে নেয়া গরম কাপড়ে শীত নিবারণ হবে না। এয়ারটাইট বাসে করে আমাদের নিয়ে যাওয়া হলো একটি ইন্ডিয়ান রেস্তোরাঁয়, দুপুরের খাবারের জন্য। যাওয়ার পথে বাসেই গাইড জানালেন, আজ আবহাওয়া একটু বেশিই ঠাণ্ডা। তাপমাত্রা ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ইউরোপ-আমেরিকায় মাইনাস তাপমাত্রায় যারা অভ্যস্ত তাদের জন্য হয়তো এটা গা সওয়া। কিন্তু আমার মত অনেকেরই দেখলাম চোখ কপালে ওঠেছে। বাস থেকে নেমে ঠাণ্ডায় পা চলছিলো না। পাশের দোকানে ঢুকে আরো কিছু শীতের কাপড় কিনে নিলাম।

এয়ারপোর্ট থেকে ইসতানবুল শহরে ঢোকার সময় দুচোখ জুড়িয়ে যাচ্ছিলো বিস্ময় আর প্রশান্তিতে। কী অপরূপ সাজানো-গোছানো এক পরিপাটি দেশ। যেন কোনো শিল্পীর তুলির আচড়ে পরম মমতায় সাজানো হয়েছে পুরো দেশটি। ঐতিহ্য আর আধুনিকতার অপূর্ব মিশেলে দিন দিন নজরকাড়া রূপ পাচ্ছে আধুনিক তুরস্ক।

ইসতানবুলের ঐতিহ্যবাহী সুলতান আহমেদ স্কয়ারের পাশেই একটি পাঁচ তারকা হোটেলে আমাদের থাকার ব্যবস্থা। বিকেলে হোটেলে কয়েক ঘণ্টা বিশ্রামশেষে সন্ধ্যায় আমাদের নিয়ে যাওয়া হলো মারমার সাগরে সাগরবিহারে। সাগরের চারদিকে চোখ ধাঁধানো আলোয় ছুটে চলা জাহাজের মাদকতায় ভুলেই গিয়েছিলাম শীতের কষ্ট। স্থানীয় শিল্পীরা নেচে গেয়ে তুরস্কের ঐতিহ্য অনুযায়ী আমাদের আমোদিত করার চেষ্টা করলেন। মাঝসাগরে রাতের খাবার, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আর হৈ হুল্লোড়ের ফাঁকে তুরস্কের ট্র্যাভেল এজেন্টদের জাতীয় সংগঠন ‘তুরসাব’ কর্মকর্তারা আমাদের স্বাগত জানালেন।

রাতের বিশ্রামশেষে পরদিন সকালে হোটেলের নিজস্ব ক্যাফেতে নাশতার আয়োজন ছিলো আমাদের জন্য আরেক বিস্ময়। বিশ্বের নানান দেশ ও জাতির ঐতিহ্যসমৃদ্ধ প্রায় দেড়শ’ পদের আইটেম ছিলো নাশতার বুফে আয়োজনে। সকালবেলা কয় পদই আর খাওয়া যায়। তারপরও অধিকাংশ আইটেমের স্বাদ নেয়ার চেষ্টা ছিলো আমিসহ সহযাত্রী কয়েকজন তরুণের।

সুলতান আহমেদ স্কয়ারের আশেপাশেই ইস্তানবুলের সবচেয়ে বিখ্যাত স্থাপনাগুলো। হিপোড্রম, ব্লু মস্ক, হাজিয়া সোফিয়া, আর টপক্যাপি প্যালেস সবই কাছাকাছি দূরত্বে। এখন যেটাকে সুলতান আহমেদ স্কয়ার বলা হয়, সেটাই আসলে কন্সটান্টিনোপোলের হিপোড্রম। এখানেই বাইজান্টাইন সভ্যতার রাজধানী কন্সটান্টিনোপোলের মানুষজন তাদের অবসর সময় কাটাতো। এখানেই একসময় ঘোড়ার দৌড়ের প্রতিযোগিতা হত, যেটা দেখতে অজস্র্র মানুষের ভিড় নামত। এখন দেখলে অবশ্য তার কিছুই টের পাওয়া যাবে না। এখন সেখানে পর্যটকদের মেলা, দিন-রাত চারদিক থাকে লোকে লোকারণ্য।

ব্লু মস্ক বা সুলতান আহমেদ মসজিদ কিন্তু বাইরে থেকে দেখতে নীল না। এর নামের মর্ম বুঝতে আপনাকে ভেতরে যেতে হবে। ভেতরের টাইলসগুলো নীল, সূর্যের আলোতে ভেতরে এক অদ্ভুত সুন্দর নীলাভ আভা তৈরি হয়। একটা বড় আর আটটা ছোট গম্বুজ, সাথে ছয়টা মিনার, অটোমান সভ্যতার অনেক মসজিদের সাথেই এর স্থাপত্যশৈলীর মিল আছে। নামাজ পড়ার সময়টা ছাড়া নারী-পুরুষ যে কেউই ঢুকতে পারে এখানে। এমনকি নামাজের সময় ছাড়া মসজিদের ভেতরে সিনেমার স্যুটিংও চলে।

ব্লু মস্কের ঠিক উল্টো দিকেই হাজিয়া সোফিয়া, পুরনো দিনের সপ্ত আশ্চর্য্যরে একটি। হাজিয়া সোফিয়ার বেশ মজার ইতিহাস আছে। কন্সটান্টিনোপোলের শাসনামলে, এটা ছিল একটা গির্জা। পরবর্তীতে অটোমানরা তুরস্ক দখল করে এটাকে মসজিদ বানিয়ে ফেলে। ১৯৩৫ সালে কামাল আতাতুর্ক ক্ষমতায় এসে মসজিদ বন্ধ করে এটাকে জাদুঘরে রূপান্তর করার ঘোষণা দেন। সে সময় থেকেই এটা সবার জন্য উন্মুক্ত। ভেতরে ঢুকলে দেখা যাবে যে বিভিন্ন জায়গায় মূর্তির ছবি এবং চিত্রকর্মগুলো তুলে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছিল। ইসলামী নিদর্শনের ফাঁকে ফাঁকেই যীশু এবং ‘মা মেরী’র ছবি উঁকি দেবে।

তুরস্কে তিন দিন অবস্থানকালে ব্লু মস্ক, তাকসিম স্কয়ার, গ্র্যান্ড বাজার, স্পাইস বাজার, বসফরাস চ্যানেলসহ ঐতিহ্যবাহী নানান জায়গায় ঘুরে বেড়িয়েছি আমরা। বিশ্ববিখ্যাত অটোম্যান সভ্যতার নানান স্মৃতিচিহ্ন যেমন টিকে আছে গৌরব আর ঐতিহ্যের প্রতীক হয়ে, তেমনি আধুনিক তুরস্কের জনক আমৃত্যু সেক্যুলার মোস্তফা কামাল আতাতুর্ক পাশার স্মৃতিচিহ্নগুলোও বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে পরম মমতায়। আদর্শিক মতদৈ¦ততা এখানে গৌণ, ইতিহাসের নির্মোহ পাঠ ছড়িয়ে আছে ইস্তানবুলের পরতে পরতে।

হাজিয়া সুফিয়া টপাকপি প্যালেস মিউজিয়াম পরিদর্শন করে মনে হলো পুরো সফরটাই স্বার্থক হয়েছে। প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ (স.) এর পায়ের ছাপ, বিভিন্ন নবী রাসূল ও সাহাবীদের ব্যবহৃত সরঞ্জামাদি, পোশাক, তরবারি, কাবাঘরের চাবি, মুসা (আ.)-এর লাঠি, ইব্রাহিম (আ.)-এর পাগড়ি, আবু বকর-ওমর ও ওসমান (র.) এর তরবারি, ফাতেমা (র.) ও ইমাম হাসানের পোশাক ইত্যাদি নিজ চোখে দেখা ছিলো আমাদের জন্য পরম সৌভাগ্যের। এক সময় পুরো আরবজাহান শাসন করেছিলো তুর্কিরা। ওসমানীয় সা¤্রাজ্যের রাজধানী ছিলো ইস্তানবুল। সেসময় মক্কা-মদীনা থেকে প্রচুর ইসলামের নিদর্শন এনে ইস্তানবুলে জাদুঘরে সংরক্ষিত করেছে তারা। ১৯২৩ সাল পর্যন্ত ইস্তানবুলই ছিলো তুরস্কের রাজধানী।

মসজিদের শহর বলা হয় ইস্তানবুলকে। কয়েকশ’ গজ পরপরই দেখা মেলে একটি মসজিদ। প্রতিটি মসজিদের স্থাপত্যশৈলী প্রায় একই রকম। মাঝে মাঝেই আমি বিভ্রান্ত হয়ে যাচ্ছিলাম। তাকসিম স্কয়ারকে আধুনিক ইস্তানবুলের হৃৎপি- বলা হয়। জায়গাটা তরুণ-তরুণীরা জমজমাট করে রেখেছে। কেউবা খেলছে, কেউবা আড্ডায় মশগুল, আর কেউবা বাজনা বাজিয়ে গান গাইছে। বিদেশি কোম্পানিগুলোও তরুণ-তরুণীদের এ মিলনমেলার সুযোগ নিয়েছে। ম্যাকডোনাল্ডস, সাবওয়ে, পিজ্জাহাট, বার্গার কিং সবকিছুই একদম পাশাপাশি।

সবশেষে সুলতান সুলেমানের মসজিদ ও কবর দেখে ইতিহাসের পুনর্পাঠ হলো। সুলতান সুলেমান মসজিদে একটি বিয়ের অনুষ্ঠান দেখে দারুণ পুলক অনুভব করেছিলাম। বিয়েতে কোন জাঁকজমক-জৌলুস নেই। পাত্র-পাত্রী ও তাদের অল্প ক’জন স্বজন-শুভার্থী আসেন মসজিদে। বিয়ে পড়ানোর পর পাত্র-পাত্রী হাত ধরাধরি করে চলে যান নতুন সংসারে। জানা গেলো প্রতিদিন সুলতান সুলেমান মসজিদে এমন বহু বিয়ে পড়ানো হয়। এটাই তাদের প্রচলিত রীতি-সংস্কৃতি।

ইস্তানবুলের পথে পথে সিরীয় শরণার্থীদের স্বপরিবারে ভিক্ষার দৃশ্য দেখলে মনটা কেঁদে ওঠে। যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়া থেকে প্রাণভয়ে বানের পানির মত মানুষ ঢুকেছে পার্শ্ববর্তী তুরস্কে। ছোট্ট শিশুকে কোলে নিয়ে অজানা গন্তব্যে বেরিয়ে পড়া এসব মানুষের চেহারার দিকে তাকালেই মনে হয় এরা হতদরিদ্র নয়। দেশে হয়তো বিপুল ঐশ্বর্য ফেলে এক কাপড়ে পালিয়ে আসতে হয়েছে প্রাণরক্ষার্থে। তাদের কারো কারো হাত-পা কিংবা কপালে রক্তমাখা ব্যন্ডেজ।
ইস্তানবুলকে বলা হয় ইউরেশিয়ার এলাকা। অর্থাৎ এর এক অংশ ইউরোপ আর অপর অংশ এশিয়া মহাদেশভুক্ত। একটির চেয়ে আরেকটি সুন্দর। মূলত ইউরোপভুক্ত অংশ ব্যবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্র। তাই বেশিরভাগ মানুষের কর্মস্থল সেখানে। সারাদিন কাজ করে সন্ধ্যায় এশিয়া অংশের দিকে রাস্তায় বাড়ি ফেরা মানুষের দীর্ঘলাইন দেখা যায়।
(চলবে..)
ইকবাল মাহমুদ : সিলেট ব্যুরো প্রধান, একাত্তর টেলিভিশন