শনিবার, ২ নভেম্বর ২০২৪, ১৮ কার্তিক ১৪৩১

ঝুঁকি বাড়াচ্ছে এডিআর রিপোর্টে অবহেলা

প্রকাশিতঃ ২৯ অক্টোবর ২০২৪ | ৯:৫৪ পূর্বাহ্ন


শরীফুল রুকন : ২৪ বছর বয়সী খায়রুন নেসা চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলার বাসিন্দা। পেটে থাকা মৃত ভ্রূণকে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে বের করতে গত ১৯ মে তাকে লোহাগাড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়। অস্ত্রোপচারের প্রস্তুতির অংশ হিসেবে তাকে দেওয়া হয় ‘সেফট্রিয়াক্সন’ ইনজেকশন। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই তার খিঁচুনি শুরু হয়।

খায়রুনের স্বামী আলাউদ্দিন দিশেহারা হয়ে ছুটে যান উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মোহাম্মদ হানিফের কাছে। ডা. হানিফ দ্রুত হাসপাতালের সকল ডাক্তারকে একত্রিত করে চেষ্টা করেন মেয়েটার জীবন বাঁচানোর জন্য।

বিপদ কেটে গেলে আলাউদ্দিন একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘আল্লাহর রহমতে একঘণ্টার চেষ্টার পর খায়রুনকে আশংকামুক্ত ঘোষণা করা হয়।’ খায়রুন নেসা জানান, ‘ইনজেকশনটি দেওয়া পর পরই আমার শরীরে কেমন জানি প্রতিক্রিয়া শুরু হয়।’

এই ঘটনার পরদিন অস্ত্রোপচার না করেই খায়রুন নেসাকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রেফার করা হয়। লোহাগাড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের গাইনি বিশেষজ্ঞ ডা. কানিজ নাসিমা আকতার জানান, “সেফট্রিয়াক্সনের প্রতি খায়রুন নেসার সংবেদনশীলতা ছিল এবং এই ইনজেকশনেই তার অ্যানাফাইলেক্টিক শক (গুরুতর এবং প্রাণঘাতী অ্যালার্জিক প্রতিক্রিয়া) হয়।”

ডা. মোহাম্মদ হানিফ দাবি করেন, ‘সেনসিটিভিটি টেস্ট করে ও সময় নিয়েই খায়রুনকে সেপট্রিয়াক্সন ইনজেকশন দেওয়া হয়। এরপরও অ্যানাফাইলেক্টিক শক হয়েছিল।’ সেফট্রিয়াক্সনের প্রচুর ‘রিঅ্যাকশন’ হয় বলেও জানান তিনি।

এই প্রতিক্রিয়া, যাকে বলে অ্যাডভার্স ড্রাগ রিঅ্যাকশন (এডিআর) রিপোর্ট, এটি ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের কাছে পাঠানো হয়নি। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডা. মোহাম্মদ হানিফ বলেন, ‘আমরা কোনো ওষুধ বা ইনজেকশনের রিঅ্যাকশন রিপোর্ট করি না; শুধু টিকার রিঅ্যাকশনের ক্ষেত্রে রিপোর্ট করি।’

ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর ই-মেইল ও ওয়েবসাইটের মাধ্যমে এডিআর রিপোর্ট সংগ্রহের ব্যবস্থা চালু রেখেছে; কিন্তু ডাক্তাররা এডিআর রিপোর্ট করছেন না। এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে ডা. হানিফ পাল্টা প্রশ্ন করে বলেন, ‘এডিআর রিপোর্ট করার জন্য ওরা আমাদেরকে চিঠি দিয়ে জানায়নি। ওরা যদি আমাদেরকে না বলে, আমরা কেন আগ বাড়িয়ে এডিআর রিপোর্ট পাঠাতে যাব?’

‘একটি এডিআর রিপোর্ট আগামীতে হাজারো মানুষের জীবন বাঁচাতে সাহায্য করবে’ বলা হলে এই চিকিৎসক বলেন, এডিআর রিপোর্ট পাঠানো বাধ্যতামূলক না হওয়ায় কেউ দিচ্ছে, কেউ দিচ্ছে না। বাধ্যতামূলক করা হলে আমরা অবশ্যই রিপোর্ট পাঠাব। আমরা তো কত ধরনের রিপোর্ট দিচ্ছি; এটাও দিতে কোন সমস্যা হবে না। কিন্তু নির্দেশনা তো দিতে হবে।’

পুরো বিষয়টি চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন ডা. জাহাঙ্গীর আলমকে জানানো হলে তিনি এডিআর রিপোর্ট করার ফরমটি তাকে হোয়াটসঅ্যাপে পাঠানোর অনুরোধ করেন! এডিআর রিপোর্ট করার জন্য তিনি সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনা দেবেন বলেও জানান।

এই ঘটনাটি দেশের চিকিৎসাসেবার ভেতরের খুব গভীর ও গুরুতর একটি সংকটের চিত্র ফুটিয়ে তুলেছে। এডিআর রিপোর্ট ব্যবস্থার বাস্তব চিত্র দেশের উপজেলা পর্যায়ে সবখানে একই রকম বলে জানা গেছে। কোনো ওষুধ বা ইনজেকশনের কারণে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিলেও সবসময় রিপোর্ট হচ্ছে না বলে সরকারের কাছে কোনো তথ্য-প্রমাণ থাকছে না।

লোহাগাড়ার স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. মোহাম্মদ হানিফের বক্তব্যের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে ঔষধ প্রশাসন অধিপ্তরের পরিচালক ও মুখপাত্র মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘এটা সত্যি- জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের সব হাসপাতাল থেকে আমরা এডিআর রিপোর্ট পাই না। এডিআর রিপোর্ট করা নিয়ে সচেতনতা বাড়াতে আমরা বিভাগীয় পর্যায়ে ওয়ার্কশপ করেছি। এডিআর রিপোর্টগুলো মূলত বিভাগীয় শহরগুলো থেকে আসছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘এডিআর রিপোর্ট পাঠানোর জন্য আমরা কাউকে বাধ্য করতে পারি না। এটা বাধ্যতামূলক করতে হলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে করতে হবে।’

ঔষধ প্রশাসন অধিপ্তরের মুখপাত্রের এই বক্তব্যের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের যুগ্মসচিব (ঔষধ প্রশাসন অধিশাখা) মুহাম্মদ মোজাম্মেল হোসেন খান বলেন, ‘সব হাসপাতাল থেকে এডিআর রিপোর্ট পাঠানো বাধ্যতামূলক করা গেলে আসলেই ভালো হবে। বিষয়টি আমরা গুরুত্বসহকারে দেখব। এই বিষয়টি ঔষধ প্রশাসন থেকে প্রস্তাবনা আকারে আমাদেরকে দেওয়ার জন্য বলব।’

এডিআর রিপোর্টে তথ্যের অভাব

এমনিতেই এডিআর রিপোর্ট কম হচ্ছে, যে সামান্য কিছু হচ্ছে সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক রিপোর্ট থাকছে অসম্পূর্ণ; যার কারণে এসব অসম্পূর্ণ এডিআর রিপোর্ট নিয়ে পরবর্তীতে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না।

অ্যাডভার্সড ড্রাগ রিঅ্যাকশন মনিটরিং (এডিআরএম) সেল গঠিত হয় ২০১৩ সালে। সেলের মাসিক সভার কার্যবিবরণীতে উল্লেখ থাকে কী পরিমাণ এডিআর রিপোর্ট হচ্ছে। তথ্য অধিকার আইনে ২০১৫ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের মে মাস পর্যন্ত হওয়া এডিআরএম সেলের প্রতিটি মাসিক সভার কার্যবিবরণীর কপি পেতে চেয়েছিলেন এ প্রতিবেদক। কিন্তু দেওয়া হয়েছে ২০২৪ সালের এপ্রিল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত কিছু মাসের সভার কার্যবিবরণী। ২০১৯ সাল পর্যন্তও সব মাসের দেওয়া হয়নি।

২০২৪ সালের মার্চ ও এপ্রিল মাসের কার্যবিবরণী অনুযায়ী, এই দুই মাসে ১৪২টি এডিআর রিপোর্ট আসে, যার মধ্যে ৮৮টিই অসম্পূর্ণ। ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে আগস্টের মধ্যে আসা মোট রিপোর্টের সংখ্যা ছিল ৩৬০টি, এর মধ্যে ১৬০টি অসম্পূর্ণ। ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত বিভিন্ন মাসে ৮১৭টি এডিআর রিপোর্ট আসে, এর মধ্যে ৫০৪টি অসম্পূর্ণ। ২০২১-এর এপ্রিল থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত বিভিন্ন মাসে ৮৯৭টি রিপোর্ট আসে, যার মধ্যে ৫৭৫টি অসম্পূর্ণ। ২০১৯ সালের মে, জুন, নভেম্বর ও ডিসেম্বরে মোট ২৫৯টি এডিআর রিপোর্ট আসে; এর মধ্যে ৮৩টি অসম্পূর্ণ।

ঔষধ প্রশাসনের সরবরাহ করা এডিআরএম সেলের কার্যবিবরণীগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, সবমিলিয়ে মোট এডিআর রিপোর্ট এসেছে ২ হাজার ৪৭৫টি। এর মধ্যে ১ হাজার ৪১০টি অসম্পূর্ণ।

এত বেশি অসম্পূর্ণ রিপোর্ট আসার কারণ জানতে চাইলে ঔষধ প্রশাসন অধিপ্তরের পরিচালক ও মুখপাত্র মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, “আমাদের দেশের মানুষ তো এখনও সচেতন না। এডিআর রিপোর্ট কী, এগুলো বুঝেই না। এগুলো নিয়ে বিভাগীয় পর্যায়ে আমরা ওয়ার্কশপ করেছি। জেলা, উপজেলা পর্যায়ে যাওয়া যায় না। সম্ভবও হয় না। আমাদের বাজেট সমস্যা আছে, জনবল সমস্যা আছে। সিস্টেমের অভাব আছে।”

অসম্পূর্ণ রিপোর্ট আসার কারণে বিপদজনক ও নিম্নমানের ওষুধগুলোর বিষয়ে যথাযথ ব্যবস্থাও নেয়া যায় না বলে জানান তিনি।

মাত্র ১.৩১% হাসপাতাল জমা দিচ্ছে এডিআর রিপোর্ট

ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের সর্বশেষ প্রকাশিত বার্ষিক প্রতিবেদন ২০২২-২০২৩ এ বলা হয়েছে, বর্তমানে অনলাইনে এডিআর সেলে ‘এডিআর রিপোর্ট’ জমা দিচ্ছে দেশের ৭৫টি সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল ও ১০০টি ওষুধ কোম্পানি।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ২০২১ সালের তথ্য অনুযায়ী, সরকারি হাসপাতালের সংখ্যা ৬৫৪টি ও বেসরকারি হাসপাতালের সংখ্যা ৫ হাজার ৫৫টি। এই তথ্য অনুযায়ী, দেশে মোট ৫ হাজার ৭০৯টি হাসপাতাল রয়েছে। এর মধ্যে মাত্র ৭৫টি হাসপাতাল এডিআর রিপোর্ট জমা দিচ্ছে।

অন্যদিকে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের সর্বশেষ প্রকাশিত বার্ষিক প্রতিবেদন ২০২২-২০২৩ এ বলা হয়েছে, বর্তমানে দেশে ২২৯টি অ্যালোপ্যাথিক ওষুধ কোম্পানি উৎপাদনে রয়েছে।

অর্থাৎ বাংলাদেশে মোট হাসপাতালের মধ্যে এডিআর রিপোর্ট জমা দিচ্ছে মাত্র প্রায় ১.৩১% হাসপাতাল, এবং মোট অ্যালোপ্যাথিক ওষুধ কোম্পানির মধ্যে ৪৩.৬৭% কোম্পানি এডিআর রিপোর্ট জমা দিচ্ছে।

‘তবে কি এডিআর রিপোর্টের অভাবেই বিপজ্জনক ওষুধ সম্পর্কে জানা যায় না, যার কারণে সেসব ওষুধ নিষিদ্ধ বা বাতিল করা যায় না?’- এমন প্রশ্নে ঔষধ প্রশাসন অধিপ্তরের পরিচালক ও মুখপাত্র মো. শফিকুল ইসলাম একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘হ্যাঁ। সেটাই।’ এডিআর রিপোর্ট নিয়ে আরও কিছু জানতে চাইলে এডিআরএম সেলের সহকারী পরিচালক মাহবুব হোসেনের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন তিনি।

যোগাযোগ করলে নগণ্য সংখ্যক এডিআর রিপোর্ট পাওয়ার বিষয়টি স্বীকার করে সহকারী পরিচালক মাহবুব হোসেন বলেন, ‘এডিআর রিপোর্ট বেশি হলে শুধু বিপজ্জনক ওষুধ নয়, সাব-স্ট্যান্ডার্ড (নিম্নমানের) ওষুধ সম্পর্কেও আরও বেশি জানা সম্ভব হতো।’ তিনি বলেন, ‘এডিআর রিপোর্ট বাড়ানোর জন্য আমরা কাজ করছি। তবে রাতারাতি পরিবর্তন আনা সম্ভব নয়।’

এডিআর রিপোর্ট কমের নেপথ্যে

অ্যাডভার্সড ড্রাগ রিঅ্যাকশন এডভাইজরি কমিটির (এডিআরএসি) ১৭তম সভা অনুষ্ঠিত হয়েছিল গত ১১ জুন। ওই সভার কার্যবিবরণীতে উল্লেখ আছে, সভায় ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের পরিচালক ও এডিআরএসি’র সদস্য সচিব ড. মো. আকতার হোসেন জানান, অনেক চিকিৎসক এডিআর রিপোর্টিং ফরম পূরণ করতে অনেক সময় লেগে যায় বলে অভিযোগ করেছেন। তাই ফরমটি সংক্ষিপ্ত করার প্রস্তাব করেন তিনি। তখন সভায় উপস্থিত চট্টগ্রাম মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সদ্য সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. মো. ইসমাইল খান বলেন, বর্তমান ফরমটি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মূল্যায়ন পদ্ধতি অনুযায়ী তৈরি করা। এটি সংক্ষিপ্ত করলে আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্মে তথ্য আদান-প্রদানে সমস্যা হবে।

এডিআর রিপোর্ট কম হওয়ার নেপথ্যের আরও কারণ জানিয়ে ঔষধ প্রশাসনের এডিআরএম সেলের সহকারী পরিচালক মাহবুব হোসেন বলেন, ‘এডিআর রিপোর্ট করার জন্য ডাক্তার ও হাসপাতাল কর্মীরা তেমন প্রশিক্ষিত নন। সঠিক এডিআর প্রতিবেদন নিশ্চিত করতে হাসপাতাল কর্মীদের প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। তাদেরকে অনলাইন সিস্টেমে ডেটা এন্ট্রি করার পদ্ধতি সম্পর্কে সঠিকভাবে বুঝিয়ে দিতে হবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘এই প্রক্রিয়াটি ধাপে ধাপে সম্পন্ন করতে হবে এবং একসাথে সব হাসপাতালে পৌঁছানো সম্ভব নয়। জেলা পর্যায়ে সিভিল সার্জনের নেতৃত্বে একটি কমিটি রয়েছে যাদের এই কাজটি তদারকি করার কথা। আশা করা যায়, ক্রমান্বয়ে সকল হাসপাতাল এই প্রক্রিয়ার আওতায় আসবে।’

এডিআর রিপোর্ট নিয়ে কী করে ঔষধ প্রশাসন?
DGDA
ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নজরদারির জন্য বাংলাদেশের ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর ২০১৩ সালে এডিআরএম সেল গঠন করেছে। এই সেলটি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আপসালা মনিটরিং সেন্টারের ১২০তম সদস্য হিসেবে যুক্ত হয়েছে। অর্থাৎ, ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করে বিশ্লেষণ করার জন্য বাংলাদেশ এখন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার।

ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের সর্বশেষ প্রকাশিত বার্ষিক প্রতিবেদন ২০২২-২০২৩ এ বলা হয়েছে, ‘এডিআর রিপোর্টগুলোর ক্যাজুয়ালটি এসেস (অসুস্থ ব্যক্তির শারীরিক অবস্থার মূল্যায়ন) করে ব্যবস্থা গ্রহণ এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ভিজিফ্লোতে (VigiFlow হচ্ছে ফার্মাকোভিজিল্যান্স সফটওয়্যার) রিপোর্টগুলো আপলোড করা হচ্ছে।

সহকারী পরিচালক মাহবুব হোসেন বলেন, ‘দেশে যেসব এডিআর রিপোর্ট হচ্ছে, সবগুলো ভিজিফ্লোতে আপলোড করা হয় না। রিপোর্ট পাওয়ার পর ক্যাজুয়ালিটি এসেস করে সিরিয়াস রিপোর্টগুলো আমরা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাথে শেয়ার করি।’

‘এই রিপোর্টগুলো পেয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা তুলনা করে দেখে অন্য দেশগুলোর সাথে মিল আছে কি না। যদি প্রাণহানির ঝুঁকি আছে এমন কিছু হয়, তখন তারা ওষুধটির বিষয়ে সতর্কতা জারি করে।’

বাংলাদেশের তথ্য নিয়ে কখনো কোন ওষুধের বিষয়ে সতর্কতা জারি হয়েছে কি না প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘না, আমাদের দেশের তথ্য নিয়ে কখনো এমন হয়নি। আমাদের রিপোর্ট খুব কম; যার কারণে উল্লেখ করার মতো কিছু হয়নি এখনো।’

বাংলাদেশ থেকে এ পর্যন্ত কতটি এডিআর রিপোর্ট বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কাছে পাঠানো হয়েছে, সেই তথ্য দিতে পারেননি সহকারী পরিচালক মাহবুব হোসেন। তবে তিনি বলেন, ‘চলতি বছর শুধু ইপিআই ভ্যাকসিন নিয়ে ৪-৫টি এডিআর রিপোর্ট বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে পাঠানো হয়েছে; ওষুধ নিয়ে কোনো রিপোর্ট পাঠানো হয়নি।’

জানেন ৬৫% ডাক্তার, পারেন মাত্র ৪%

২০১৯ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর একটি হোটেলে অনুষ্ঠিত “বাংলাদেশ ফার্মাসিউটিক্যালস ইন্ডাস্ট্রি এবং বর্তমান বিষয়” শীর্ষক চতুর্থ স্যামসন এইচ চৌধুরী স্মৃতি সম্মেলনে এডিআর রিপোর্টিং নিয়ে বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. সায়েদুর রহমান (গত ২৭ আগস্ট তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছেন)। গবেষণার ফলাফল তুলে ধরে ওই প্রবন্ধে জানানো হয়, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ১১.৯% রোগী ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নিয়ে আসে। বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে বহির্বিভাগের ৩.৭৫% ও ভর্তি রোগীর ৩.৪০% ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার শিকার। ক্ষতিকর ওষুধ সেবনে ক্ষতির মাত্রা ১.১৪% হারে বাড়ে।

অধ্যাপক ডা. সায়েদুর রহমান সেদিন আরও জানান, ৬৫% ডাক্তার এডিআর রিপোর্ট সম্পর্কে জানেন; ৮% রিপোর্টিং ফরম দেখেছেন; আর এডিআর রিপোর্ট করতে জানেন মাত্র ৪% ডাক্তার। হতাশাজনকভাবে, কেউই এডিআর রিপোর্টিং ফরম জমা দিতে প্রশিক্ষিত নন।

অধ্যাপক ডা. সায়েদুর রহমান আরও জানান, এডিআর রিপোর্ট না করার ফলে জনস্বাস্থ্যের ওপর গুরুতর প্রভাব পড়তে পারে। বিশ্বব্যাপী হাসপাতালে ভর্তি রোগীর মধ্যে প্রতি সাতজনে একজন ওষুধের প্রতিকূল প্রতিক্রিয়ায় ভোগেন। এ ধরনের ঘটনার কারণে হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের মৃত্যুহার ০.২৪ থেকে ২.৯ শতাংশ। যুক্তরাষ্ট্রে মৃত্যুর চতুর্থ প্রধান কারণ এডিআর। এডিআর-এর প্রভাব স্বাস্থ্য অর্থনীতির উপরও পড়ে। ২০০০ সালে যুক্তরাষ্ট্রে একটি অনুমান অনুযায়ী, এডিআর-এর অর্থনৈতিক প্রভাব ১৭৭ বিলিয়ন ডলারের বেশি ছিল। কিন্তু বাংলাদেশে এ ধরনের কোনো গবেষণাই নেই।

ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের মুখপাত্র গত ৫ বছরে ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় মৃত্যুর কোনো তথ্য দিতে পারেননি। বিভিন্ন সময় ভুল চিকিৎসায় রোগীর মৃত্যুর অভিযোগ সংক্রান্ত খবর গণমাধ্যমে এলেও শেষ পর্যন্ত বেশিরভাগ ঘটনার তদন্ত থেমে যায় বা নানান কারণে অভিযোগ প্রমাণ করা যায় না। তবে ২০১৮ সালে চট্টগ্রাম নগরের ম্যাক্স হাসপাতালে ভুল ওষুধ প্রয়োগের কারণে শিশু রাইফার মৃত্যু হয়; সরকারি তদন্তেও এর সত্যতা উঠে আসে। এই ঘটনায় করা মামলায় ৪ জন চিকিৎসকের বিরুদ্ধে বিচার চলছে চট্টগ্রামের আদালতে।

আবার ওষুধের ক্ষতিকর প্রতিক্রিয়ায় মৃত্যুর ঘটনা গোপন করার অভিযোগও আছে। ঔষধ প্রশাসনের নাম প্রকাশে নারাজ একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, এর পেছনে কিছু ওষুধ কোম্পানির ভূমিকা রয়েছে। কোথাও ওষুধের ক্ষতিকর প্রতিক্রিয়ায় কেউ আক্রান্ত হলে কোম্পানির লোকজন চিকিৎসকের সাথে যোগাযোগ করে বিষয়টি চেপে যাওয়ার চেষ্টা করেন এবং এডিআর রিপোর্টিং সিস্টেমে উল্লেখ না করার জন্য চাপ দেন। ফলে, এডিআর ফরমে মৃত্যুর ছক ফাঁকা থেকে যায়।

ঔষধ প্রশাসনের কর্মকর্তারা বলছেন, ওষুধের ক্ষতিকর দিক কমানোর জন্য ছোট-বড় সব পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া চিহ্নিতকরণ এবং কর্তৃপক্ষের কাছে রিপোর্ট করা জরুরি। ঔষধ প্রশাসন ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইট থেকে ইয়েলো কার্ড সংগ্রহ করে ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ব্যক্তিগতভাবে বা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে রিপোর্ট করা যায়। চিকিৎসকের পাশাপাশি রোগীদেরও রিপোর্ট করার সুযোগ আছে।

চট্টগ্রামের ডেপুটি সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ ওয়াজেদ চৌধুরী বলেন, ‘ট্রেনিং ও সচেতনতার অভাবে আমাদের দেশে এডিআর রিপোর্টিং কম হয়। তাই অন্তত হাসপাতালগুলোতে এডিআর রিপোর্টিংয়ের ওপর প্রশিক্ষণের আয়োজন করা উচিত।’

জাতীয় ঔষধ নীতি-২০১৬ প্রণয়নের বিশেষজ্ঞ কমিটির আহ্বায়ক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি অনুষদের সাবেক ডিন অধ্যাপক আ ব ম ফারুক একুশে পত্রিকাকে বলেন, “আমাদের এত বেশি জনসংখ্যার দেশে প্রতি মাসে কয়েক হাজার এডিআর রিপোর্ট আসার কথা। অভিযোগ জানানোর ব্যাপারে রোগীরা সচেতন নন। অন্যদিকে চিকিৎসকেরাও কাজটি ঠিকমতো করেন না। সংশ্লিষ্ট সবাইকে এ ব্যাপারে সক্রিয় করে তোলার মূল দায়িত্ব ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের।’

ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের নবনিযুক্ত মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মো. শামীম হায়দারের সাথে যোগাযোগ করলে গত ২৫ অক্টোবর তিনি মুঠোফোনে একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘আমি মাত্র দুইদিন অফিস করেছি। ঔষধ প্রশাসনের বিষয়গুলো বুঝতে আমার একটু সময় লাগবে। এডিআর রিপোর্ট ব্যবস্থা শক্তিশালী করাসহ যা যা করা লাগবে, জনস্বার্থে আমরা অবশ্যই সব করবো।’

পার্শ্ব প্রতিবেদন : বিশেষজ্ঞহীন ঔষধ প্রশাসন বিপজ্জনক