রবিবার, ১৮ মে ২০২৫, ৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

ইন্টারনেটের পাইকারি দাম কমছে, গ্রাহক পর্যায়ে সুফল নিয়ে প্রশ্ন

একুশে প্রতিবেদক | প্রকাশিতঃ ২৭ এপ্রিল ২০২৫ | ২:৫৪ অপরাহ্ন


দেশের ইন্টারনেট সরবরাহ ব্যবস্থার বিভিন্ন স্তরে ব্যান্ডউইথের দাম ১০ থেকে ২০ শতাংশ কমানোর ঘোষণা দিয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত ও বেসরকারি একাধিক প্রতিষ্ঠান। তবে এই দাম কমানোর সুফল সাধারণ গ্রাহক পর্যন্ত কতটা এবং কবে নাগাদ পৌঁছাবে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। ইন্টারনেট সেবাদাতা এবং মোবাইল অপারেটররা বলছেন, ইন্টারনেটের দাম বহু বিষয়ের ওপর নির্ভরশীল, শুধু পাইকারি পর্যায়ে দাম কমলেই গ্রাহকের খরচ কমবে এমনটা নিশ্চিত নয়।

দাম কমানোর এই উদ্যোগ শুরু হয় রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ সাবমেরিন কেবল পিএলসি (বিএসসিপিএলসি)-র মাধ্যমে। গত ২২ মার্চ তারা তাদের সব ধরনের সেবার দাম ১০ শতাংশ কমানোর ঘোষণা দেয়। দেশের ব্যান্ডউইথের প্রায় অর্ধেক আসে এই কোম্পানির মাধ্যমে। যদিও তখন সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো বলেছিল, বেসরকারি আইটিসিগুলোর তুলনায় বিএসসিপিএলসির দাম বেশি হওয়ায় এই ছাড়ে খুব বেশি সুবিধা হবে না।

এরপর ইন্টারনেট সেবাদাতা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ফাইবার অ্যাট হোম ইন্টারন্যাশনাল টেরেস্ট্রিয়াল কেবল (আইটিসি) ও ইন্টারন্যাশনাল ইন্টারনেট গেটওয়ে (আইআইজি) পর্যায়ে ১০ শতাংশ এবং নেশনওয়াইড টেলিকমিউনিকেশন ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক (এনটিটিএন) পর্যায়ে ১৫ শতাংশ দাম কমানোর কথা জানায়। সর্বশেষ ২২ এপ্রিল সামিট কমিউনিকেশনসও এক বিজ্ঞপ্তিতে আইআইজি পর্যায়ে ১০ শতাংশ এবং এনটিটিএন পর্যায়ে ১৫ থেকে ২০ শতাংশ ছাড় দেওয়ার ঘোষণা দেয়।

এই ঘোষণার প্রেক্ষাপটে প্রধান উপদেষ্টার ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তিবিষয়ক বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব ২১ এপ্রিল এক ফেসবুক পোস্টে জানান, ইন্টারনেট সেবার তিন থেকে চারটি স্তরে দাম কমানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে এবং মোবাইল অপারেটরদের নীতিগত সহায়তা দেওয়ায় তাদের দাম না কমানোর কোনো যৌক্তিক কারণ নেই।

ইন্টারনেট ব্যান্ডউইডথ বিদেশ থেকে সাবমেরিন কেবল ও আইটিসির মাধ্যমে দেশে আসে। সেখান থেকে আইআইজি অপারেটররা ব্যান্ডউইডথ কিনে মোবাইল অপারেটর ও ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সেবাদাতাদের (আইএসপি) কাছে বিক্রি করে। আর গ্রাহক পর্যন্ত সংযোগ পৌঁছানোর অপটিক্যাল ফাইবার স্থাপন ও রক্ষণাবেক্ষণ করে এনটিটিএন অপারেটররা। মূলত এই আইআইজি ও এনটিটিএন স্তরেই সাম্প্রতিক দাম কমানোর ঘোষণাগুলো এসেছে।

এই দাম কমানোর পরিপ্রেক্ষিতে আইএসপিদের সংগঠন আইএসপিএবি ১৯ এপ্রিল একটি ঘোষণা দেয়। তারা জানায়, ৫০০ টাকার প্যাকেজে গ্রাহকরা এখন ৫ এমবিপিএসের বদলে ১০ এমবিপিএস গতি পাবেন। তবে অন্য কোনো প্যাকেজের দাম কমানো বা গতি বাড়ানোর ঘোষণা তারা দেয়নি।

আইএসপিএবির সভাপতি মো. ইমদাদুল হক বলেন, পাইকারি দাম কমার সুফল গ্রাহক পর্যন্ত পৌঁছাতে হলে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসিকে রাজস্ব ভাগাভাগির হার কমাতে হবে। তিনি অভিযোগ করেন, আইআইজিরা আইএসপিদের কাছে প্রতি এমবিপিএস প্রায় ২০০ টাকায় বিক্রি করলেও বিটিআরসি ৩৬৫ টাকা দর ধরে ১০ শতাংশ রাজস্ব ভাগ নেয়। একইভাবে এনটিটিএন পর্যায়েও বাজারমূল্যের চেয়ে বেশি দাম ধরে রাজস্ব আদায় করা হয়। তার মতে, ঘোষিত মূল্যছাড় যদি বর্তমান বাজারমূল্যের ওপর কার্যকর হয়, তবেই আইএসপিরা সুবিধা পাবে এবং তা গ্রাহক পর্যন্ত পৌঁছানো সম্ভব হবে। আগামী মাসের ইনভয়েস পেলে বিষয়টি পরিষ্কার হবে বলে তিনি উল্লেখ করেন।

দেশে ব্রডব্যান্ডের চেয়ে মোবাইল ইন্টারনেট ব্যবহারকারী অনেক বেশি। বিটিআরসির ফেব্রুয়ারির হিসাব অনুযায়ী, মোবাইল ইন্টারনেট গ্রাহক ১১ কোটি ৬০ লাখ, আর ব্রডব্যান্ড গ্রাহক ১ কোটি ৪০ লাখ।

বিএসসিপিএলসির দাম কমানোর পর শুধু সরকারি মোবাইল অপারেটর টেলিটক ঈদুল ফিতর থেকে ১০ শতাংশ মূল্যছাড় দিয়েছে, যাদের গ্রাহক সংখ্যা তুলনামূলকভাবে অনেক কম (৬৫.৫ লাখ)।

বৃহৎ অপারেটর গ্রামীণফোনের হেড অব কমিউনিকেশনস শারফুদ্দিন আহমেদ চৌধুরী বলেন, ইন্টারনেটের দাম শুধু ব্যান্ডউইথের ওপর নির্ভর করে না। তরঙ্গ, টাওয়ার, ফাইবার, বিদ্যুৎসহ নানা উপাদানের সম্মিলিত খরচের ভিত্তিতে চূড়ান্ত দাম নির্ধারিত হয়। তিনি টেলিযোগাযোগ খাতে উচ্চ কর হারের কথাও উল্লেখ করেন। তবে গ্রাহকদের কথা মাথায় রেখে তারা বিষয়টি সামগ্রিকভাবে মূল্যায়ন করছেন বলে জানান।

রবি আজিয়াটার চিফ করপোরেট অ্যান্ড রেগুলেটরি অফিসার সাহেদ আলম সরকারের পদক্ষেপকে স্বাগত জানিয়ে বলেন, বিভিন্ন স্তরে খরচ কমানোর প্রতিফলন মোবাইল ইন্টারনেটের মূল্যে দেখা যাবে এবং গ্রাহকেরাও সুফল পাবেন। তবে এর জন্য কিছুটা সময় প্রয়োজন। তিনি কার্যকর মূল্যহ্রাসের ওপর জোর দেওয়ার কথা বলেন।

ফলে, সরবরাহ চেইনের বিভিন্ন ধাপে দাম কমার ঘোষণা এলেও জটিল খরচ কাঠামো, নিয়ন্ত্রক সংস্থার রাজস্ব ভাগাভাগির নীতি এবং উচ্চ করহারের কারণে বিপুল সংখ্যক মোবাইল ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর জন্য ইন্টারনেটের দাম কবে নাগাদ বা আদৌ কমবে কিনা, তা নিয়ে সংশয় থেকেই যাচ্ছে।